ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ফুলের টবে শিক্ষার্থীর স্বপ্নের বীজ

প্রকাশিত: ০৮:৪০, ২৩ মার্চ ২০১৯

 ফুলের টবে শিক্ষার্থীর স্বপ্নের বীজ

স্কুলের বারান্দায় সারিবদ্ধ ফুলের টব। প্রতিটি টবে লেখা মালিকের নাম। সকালে ক্লাস শুরুর বেশ আগেই দলে দলে শিশু শিক্ষার্থীরা ওই স্কুলে যেন দৌড়ে ঢুকছে। তারপর যে যার মতো নিজ নামের টব আগ্রহ নিয়ে দেখছে। কার টবে কেমন চারা গজিয়েছে। কেউবা টবে যত্ন করে পানি দিচ্ছে। কেউবা টবের মাটি পরিচর্যা করছে। কেউবা পাশের টবের ফুলের চারা কেমন, কতটুকু গঁজিয়েছে তা নিয়ে যেন আগ্রহভড়ে দেখছে। মঙ্গলবার পাবনা পৌর এলাকার ইছামতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ফুলের চারা নিয়ে শিশুদের মাতামাতি দেখে মনে হলো ফুল নয় তারা যেন টবে স্বপ্নের বীজ বুনছে। এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ জানায়, আগে সকালে স্কুলে আসতে ইচ্ছা করত না। এখন গাছের টানেই রোজ স্কুলে আসতে হয়। স্কুলে না এলে তার গাছ যে পানির অভাবে মারা যাবে! প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের স্কুলমুখী ও নৈতিক দায়িত্ববোধে উদ্দীপ্ত করতে পাবনায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ফুলের টব ও বীজ বিতরণের ব্যতিক্রমী কর্মসূচী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। কর্মসূচীর অংশ হিসেবে সদর উপজেলায় সরকারী, বেসরকারী স্কুলের দশ হাজার শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে একটি করে ফুলের টব ও ফুল গাছের বীজ দেয়া হচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে উপজেলার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধারাবাহিকভাবে চলছে এ কার্যক্রম। আয়োজকরা জনান, প্রতিটি স্কুলের নির্দিষ্ট স্থানে ফুলের টব রেখে তাতে ঐ শিক্ষার্থীই রোপণ করছে বীজ। বীজ থেকে চারা উৎপাদন, যত্ন, ফুল ফোটানো সবই করতে হবে এই শিশুদের। এতে শিশুদের মধ্যে প্রকৃতি ও গাছের প্রতি মমত্ববোধ, নিজের কাজ নিজে করার কর্তব্যবোধ যেমন সৃষ্টি হবে তেমনি স্কুলে আসার প্রতি আগ্রহ ও বাড়বে বলে প্রত্যাশা করছেন তারা। পাবনা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন জানান, যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে শিশুরা প্রকৃতি থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে। শৈশব থেকেই আমরা শিশুদের ওপর পড়ার চাপ আর নির্দিষ্ট রুটিনের একঘেঁয়ে জীবনে আটকে ফেলছি। এ কারণেই শিশুদের সঠিক মানসিক বিকাশ ঘটছে না। এ থেকে মুক্তি দিতেই আমাদের এ উদ্যোগ। এমন অনেক শিশুকে আমরা পেয়েছি যারা কোনদিন গাছ তো দূরের কথা মাটিও ছুঁয়ে দেখেনি। তাদের প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিত করতে পেরে আমরাও আনন্দিত। খোঁজ নিয়ে জানা ঘেছে, ব্যাতিক্রমী এ ধ্যানধারণার প্রবক্তা পাবনা সদর উপজেলার সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আসলাম হোসেন। যদি ও তিনি বিনয়ের সঙ্গে সব কৃতিত্ব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়নাল আবেদিন সাহেবকে দিয়ে বলেন, ছাত্রছাত্রীদের আনন্দঘন পরিবেশে স্কুলে ধরে রাখা ও তাদের মধ্যে দায়িত্ববোধ সৃষ্টির জন্য স্কুলে স্কুলে ফুলের টব ও বীজ বিতরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি শহরের ইছামতি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পাইলট প্রকল্প হিসেবে ফুলের টব ও সূর্যমুখী ফুলের বীজ বিতরণ করা হয়। শিক্ষার্থীদের পরিচর্যা নেয়া ও শিখানো হয়। শিক্ষার্থীদের টবের ৯৫ ভাগ ফুলের অঙ্কুরোদগম হয়েছে। এক্ষেত্রে উপজেলা কৃষি অফিস তাদের সহায়তা করেছে। তিনি আর ও তার স্বপ্নের কথা জানান, আগামীতে ও যে শিশু প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হবে তার নামে ১টি করে ফুলের টব ও বীজ দেয়া হবে। ৫ বছর পর সে যখন সমাপনী পরীক্ষা দিবে তখন তাকে ফুলসহ টবটি দিয়ে দেওয়া হবে। শিক্ষার্থীদের যার টবে আগে অঙ্কুরোদগম হবে তাকে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের বই পুরস্কার দেয়া হবে। আর যার টবে আগে ফুল আসবে তাকে ও পরুস্কার দেয়া হবে। পরিচ্ছন্নতার জন্য ও পুরস্কৃত করা হবে। এ কর্মসূচী নেয়ার সময় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর মা জানান তাদের সন্তান পরিশ্রম করতে পারবে না। তাদের সে সময় বুঝিয়ে রাজি করেছিলাম। এখন এ স্কুলের প্রতিটি টবে এক দেড় ফুট ফুলের চারা দাঁড়িয়ে গেছে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরাও এখন বেজায় খুশি। যে স্কুলে সব সময় ২০ ভাগ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকত এখন তা শূন্যের কোটায়। প্রশাসনের এ উদ্যোগ ব্যাপক সাড়া পড়ায় উপজেলার অন্য ১৮৪টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে টব ও ফুলের বীজ বিতরণ করা হয়েছে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি উপজেলার শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামে টব ও বীজ বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক মোঃ জসিম উদ্দিন। এ কর্মসূচীর ব্যয় নির্বাহ সম্পর্কে সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আসলাম হোসেন জানান, প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে সরকারী স্লিপ প্রগ্রামের একটি অংশ ও উপজেলার বরাদ্দ নিয়ে এ ব্যয় করা হচ্ছে। তিনি প্রতিটি স্কুলে তদারকিতে ব্যাপক আশাবাদী। পাবনার অবসরপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডাঃ তাহসিন আজীজ জানান, বাচ্চাদের প্রকৃতির সান্নিধ্যে মাটির কাছাকাছি না আনলে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিকমতো কাজ করে না। অল্পতেই তারা সর্দি, কাশি এবং এলার্জিজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়। মাটি ও চারাগাছ নিয়ে খেলাধুলায় তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ার পাশাপাশি প্রকৃতির সংস্পর্শে সঠিকভাবে মানসিক বিকাশ ঘটবে। পাবনা জেলা প্রশাসক মোঃ জসিম উদ্দিন বলেন, প্রযুক্তিনির্ভর যান্ত্রিকসভ্যতার যুগে শিশুদের প্রকৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করার এ উদ্যোগ কৃষি কাজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি করবে। শিশুদের মধ্যে সবুজায়নের আগ্রহ সৃষ্টি হলে তারা বাড়িতেও বাগান তৈরিতে উৎসাহিত হবে যা প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক হবে। -কৃষ্ণ ভৌমিক, পাবনা থেকে
×