ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার অভিযোগ ॥ চাঁদার পরিমাণ বাড়িয়ে রাস্তায় লেগুনা চলাচলের অনুমতি

প্রকাশিত: ০৮:৪৪, ২৩ মার্চ ২০১৯

  অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার অভিযোগ ॥ চাঁদার পরিমাণ বাড়িয়ে রাস্তায়  লেগুনা চলাচলের অনুমতি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ চাঁদার পরিমাণ বাড়িয়ে রাজধানীর রাজপথে ফের লেগুনা চালানোর অনুমতি পেয়েছেন এই হালকা যানের মালিকরা। অভিযোগ উঠেছে, এই বাড়তি চাঁদা দিতে যাত্রীদের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। একাধিক লেগুনা চালক দাবি করেন, চাঁদার পরিমাণ বাড়াতেই লেগুনা বন্ধ করা হয়েছিল। নতুন করে রাস্তায় নামানো লেগুনার খরচ বেড়েছে, তাই ভাড়াও বাড়ানো হয়েছে। জানা গেছে, পুনরায় লেগুনা চালানোর ক্ষেত্রে পুলিশ, মালিক ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়েছে। সমঝোতার ভিত্তিতেই ফের চলছে লেগুনা। গত ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া সম্ভাব্য দুর্ঘটনা রোধ ও বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে রাজধানীর সব রুটের লেগুনা বন্ধের ঘোষণা দেন। তবে এরপরও বিভিন্ন এলাকায় ভেতরের রাস্তায় লেগুনা চলতে দেখা যায়। অবশ্য প্রধান সড়কগুলোতে লেগুনা চলতে দেয়নি পুলিশ। তবে কোথাও এক সপ্তাহ, কোথাও ১৫ দিন অথবা কোথাও এক মাস বন্ধ থাকার পর আবার শহরজুড়ে লেগুনা চলছে। রাজধানীর একাধিক লেগুনার মালিক, চালক, বিভিন্ন স্ট্যান্ডের লাইনম্যানের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে রাজধানীর জিগাতলা, ধানমন্ডি , মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, ৬০ ফিট, আগারগাঁও, ফার্মগেট, দৈনিক বাংলা, বাসাবো, ফকিরাপুল, মতিঝিল, মালিবাগ, গুলিস্তান, তেজগাঁও ও বাড্ডা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, লেগুনা আগের মতোই সব রুটে নির্বিঘ্নে চলাচল করছে। গত ৯ মার্চ জিগাতলায় কয়েকজন লেগুনা চালকের সঙ্গে কথা হয়। তারা জিগাতলা থেকে ফার্মগেট রুটে লেগুনা চালান। এদের মধ্যে একজন সালাম (ছদ্মনাম) বলেন, ‘লেগুনা বন্ধ করে দেয়ার পর প্রায় এক মাস চলেনি। এরপর মালিকরা ও নেতারা পুলিশের সঙ্গে দেনদরবার করে। পুলিশ অনুমতি দিতে চায়নি। পরে অনুমতি দিয়েছে। তবে আগের চেয়ে লাইনের (রুটে) খরচ বেশি নিচ্ছে। আগে শুক্র ও শনিবার ছাড়া প্রতিদিন একটি লেগুনা থেকে ৫৫০ টাকা নিত। এখন সেটা ৯০০ টাকা করেছে। তবে এখনও শুক্রবার ৪০০-৫০০ নেয়। কারণ, এই দুই দিন সরকারী ছুটি, যাত্রী কম থাকে।’ তিনি বলেন, ‘টাকা লাইনম্যানরা তোলে। আমরা লাইনম্যানের কাছে টাকা দিই। শুনছি এই টাকা পুলিশের বিভিন্ন জায়গা যায়। এই লাইনে তিন থানা আছে, তারা পায়, ট্রাফিক পুলিশ পায়। তবে আমরা পুলিশের কাছে টাকা সরাসরি দেই না, লাইনম্যানদের কাছে দেই।’ তিনি অভিযোগ করেন, ‘এই লাইনের টাকা বাড়ানোর জন্যই লেগুনা বন্ধ করছিল। এখন টাকা বাড়িয়ে আবার লেগুনা চলতে দিচ্ছে।’ যাত্রীবেশে এই চালকের পাশের সিটে বসে এই প্রতিবেদক রুটের বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজ নেন। তবে চালক কথার মাঝে কয়েকবার বলেন, ‘সব কথা বলা যায় না, সমস্যা আছে।’ ফার্মগেটে সালাহ উদ্দিন নামে এক চালকের সঙ্গে কথা হয়। তিনিও জিগাতলা-ফার্মগেট রুটে লেগুনা চালান। সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘লেগুনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আমি বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। চালু হয়েছে, তাই আবার আসছি। লাইনের খরচ আগের চেয়ে বেড়েছে, তবে এই রুটে যাত্রীও আছে।’ জিগাতলা ছাড়াও ফার্মগেটে থেকে মোহাম্মদপুর, ৬০ ফিট ও কৃষিমার্কেট এলাকায় লেগুনা চলাচল করে। এসব রুটের যাত্রীদের পছন্দের বাহন লেগুনা। কারণ স্টপেজে এসেই দ্রুত লেগুনা পাওয়া যায় এবং তুলনামূলক দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানো যায়। কয়েকজন যাত্রী জানান, যখন লেগুনা বন্ধ ছিল, তখন তাদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। তবে লেগুনার চালক ও মালিকদের বিভিন্ন সময় ঝামেলায় পড়তে হয়। তারা হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগ রয়েছে। পরিবহন সংগঠন ও পুলিশের নিয়ন্ত্রণে থেকেই তাদের লেগুনা চালাতে হয়। ফার্মগেট-৬০ ফিট রুটে লেগুনা চালান গোলাপ নামে এক তরুণ। তিনি বলেন, ‘আমরা ভাড়ায় লেগুনা চালাই। দিনে ১২শ’ থেকে ১৩শ’ টাকা গাড়ির মালিককে জমা দিতে হয়। এরপর লাইন খরচ ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকা দেয়ার পর যা থাকে তা আমাদের ভাগ করে নিতে হয়।’ গত বছরের সেপ্টেম্বরে যখন লেগুনা বন্ধ হয়ে যায়, তখন ৬০ ফিট থেকে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত লেগুনা চলত। এসময় আয় কম ছিল, খুব কষ্টে পরিবার নিয়ে চলেছেন তিনি। পুনরায় লেগুনা চালু হওয়াতে খুশি। তবে লাইনের খরচ আগের তুলনায় বেড়েছে বলেও জানান এই চালক। ফার্মগেটে নুরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি লাইনম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গত ১৫ মার্চ সন্ধ্যায় তিনি বলেন, ‘আমি লেগুনা দেখে রাখি। যাতে কেউ রাস্তার মধ্যে গাড়ি পার্কিং না করে তা খেয়াল রাখি। আমাকে প্রতিদিন ৪শ’ টাকা বেতন দেয়।’ লেগুনার লাইনের খরচ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ফার্মগেট থেকে যে কয়টি রুটে লেগুনা চলে এর মালিক বা চালকরা প্রতি রুটের টাকা ফার্মগেটে জমা দেয়। এখান থেকে টাকা ভাগ করে বিভিন্ন জায়গায় দেয়া হয়।’ কারা টাকা নেয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি তেমন কিছু জানি না। তবে তিন থানায় টাকা দিতে হয়। চুন্নু নামে একজন পরিবহন নেতা এই বিষয় দেখভাল করেন। তারও গাড়ি আছে।’ এরপর পরিবহন নেতা চুন্নু মিয়ার সঙ্গে এই প্রতিবেদক যোগাযোগ করেন। তিনি পুলিশকে টাকা দেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। চুন্নু মিয়া বলেন, ‘আমাদের লেগুনা চালাতে রাস্তায় কোন টাকা লাগে না। নতুন যেসব চালক রয়েছে তারা এসব বলে।’ তবে লাইনের বিভিন্ন খরচের জন্য লেগুনার চালকদের কাছ থেকে টাকা নেন বলে স্বীকার করেন তিনি। বলেন, ‘লাইনের কিছু খরচ আছে, যেগুলো আমি পকেট থেকে দিই না। সেগুলো নিয়ে থাকি।’ এসময় তিনি একজন হালকা যান পরিবহনের ঢাকা জেলার এক নেতার নাম বলেন। তিনি চালকদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করেন বলে অভিযোগ করেন চুন্নু মিয়া। ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘না, ভাড়া বাড়েনি। আগে যা ছিল তা-ই।’ তবে দেখা গেছে, জিগাতলা থেকে ফার্মগেটে আগে ১৫ টাকা ভাড়া ছিল। এখন নেয়া হয় ১৮ টাকা। যাত্রীরা বেশি নেয়ার কারণ জানতে চাইলে বলা হয়, রাস্তায় খরচ বেড়েছে, তাই ভাড়া বেশি নিতে হচ্ছে। একই চিত্র দেখা গেছে, মোহাম্মদপুর থেকে শ্যামলী রুটে চলাচলকারী লেগুনায়। এই রুটেও ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। আগে এই রুটে ভাড়া ছিল ১০ টাকা। এখন ১২ টাকা করা হয়েছে। এক্ষেত্রেও লাইনের খরচের ব্যাখ্যা দেন চালকরা। দৈনিক বাংলা মোড়ে কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে লেগুনা নিয়ে কথা হয়। তারা বলেন, শিক্ষার্থী, নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের অল্প পথে যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম লেগুনা। ফকিরাপুলে কথা হয় শরীফ নামে এক লেগুনার মালিকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ব্যাংক ঋণ করে লেগুনা কেনা। ৩০ দিন লেগুনা এমনিতেও চলে না। কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তা বুঝতে চায় না। বন্ধ থাকলেও কিস্তি দিতে হয়। এক থেকে দেড় মাস বন্ধে আমার অনেক ক্ষতি হয়েছে। আমরা চাই সরকার লেগুনা বৈধভাবে চলার ব্যবস্থা করে দেবে।’ বাংলাদেশে হালকা যান পরিবহন মালিক সমিতির তথ্যমতে, ২০০২ সালে জোট সরকার রাজধানী থেকে ৩৭ হাজার টু-স্ট্রোক থ্রি-হুইলার উঠিয়ে দেয়। এরপর বাণিজ্যিকভাবে হিউম্যান হলার বা লেগুনা ব্যবহারের জন্য পাঁচ হাজার ৪৭৩টি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দেয় সরকার। এর মধ্যে কিছু গাড়ির রুট পারমিটও দেয়া হয়। ঢাকার বিভিন্ন রুটে হিউম্যান হলার চলাচলের অনুমতি বা রুট পারমিট দেয় মহানগর আঞ্চলিক পরিবহন কমিটি বা মেট্রো আরটিসি। ঢাকায় হিউম্যান হলার নিবন্ধন নিয়েছে ৫ হাজার ১৫৬টি। এর আগে ২০১৭ সালে ২১৭টি, ২০১৬ সালে ৭৮৭টি, ২০১৫ সালে ৫০২টি, ২০১৪ সালে ১০৯টি, ২০১৩ সালে ১১৫টি, ২০১২ সালে ১৪৫টি এবং ২০১১ সালে ৫৬৯টি হিউম্যান হলারের অনুমোদন দেয়া হয়। ২০১০ সালের আগে অনুমোদন পায় ২ হাজার ৭১৮টি হিউম্যান হলার। ঢাকা জেলা হালকা যানবাহন ও সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আলতাফ হোসেন জানান, ঢাকা মহানগরে লেগুনার ৬৫টি রুট রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ হালকা যান পরিবহন মালিক সমিতি নিয়ন্ত্রণ করে ৬৩টি। তবে ঢাকা মেট্রোপলিটনে এই রুট সংখ্যা আরও বেশি হবে। ঢাকা জেলার এই সমিতির সঙ্গে মহানগরের অনেকে নেই। আলতাফ হোসেনকে অনেকেই মানেন না। আলতাফ হোসের মূলত গুলিস্তান ও এর আশপাশের এলাকায় লেগুনা নিয়ন্ত্রণ করেন। ডিএমপির ট্রাফিক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এখনও কিছু কিছু স্থানে লেগুনা চলাচল করতে দেয়া হচ্ছে না। কোথায় কোথায় লেগুনা চলবে, আর কোথায় চলবে না, তার পর্যালোচনা চলছে। এসব হালকা যানের রুট পুনর্বিন্যাসের কাজ চলছে বলে জানান ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (দক্ষিণ) মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ। তিনি বলেন, ‘বিকল্প পরিবহনের ব্যবস্থা না করে এগুলো বন্ধ করা যাবে না। তাতে মানুষের দুর্ভোগ হবে।’ বিভিন্ন লেগুনা রুট থেকে পুলিশের টাকা নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এরকম কোন অভিযোগ আমাদের জানা নেই। এই অভিযোগ ভিত্তিহীন।’ সূত্র: বাংলাট্রিবিউন
×