ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এত কিছুর পরও শৃঙ্খলা ফিরছে না সড়কে

প্রকাশিত: ১০:০১, ২৩ মার্চ ২০১৯

এত কিছুর পরও শৃঙ্খলা ফিরছে না সড়কে

রাজন ভট্টাচার্য ॥ বারবার পুলিশী অভিযানেও নিয়ন্ত্রণে আসছে না ঢাকার গণপরিবহন। সড়কে বেপরোয়া চালকরা। পাল্লা দিয়ে চলছে বাস। চুক্তিতে গাড়ি তুলে দেয়া হচ্ছে চালকদের হাতে। দরজা খোলা রেখে যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো-নামানোর চিত্রও আগের মতোই। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে কোন নির্দেশনাই মানছেন না মালিক-শ্রমিকরা। ফের অভিযান জোরদার করায় চালকের লাইসেন্স না থাকা, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, রুট পারমিট, ফিটনেস না থাকাসহ নানা অনিয়ম বেরিয়ে আসছে। ডাম্পিং করা হচ্ছে অনেক বাস। প্রশ্ন হলো এত কিছুর পরও সড়ক নিরাপদ হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব সেক্টরের আন্তরিকতা না থাকলে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা কোনভাবেই সম্ভব হবে না। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের অভিযান হবে বারবার। মালিক-শ্রমিক পক্ষসহ বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) নানা পদক্ষেপের কথা বলবে। কিছুদিন পর আবারও যেই সেই। অর্থাৎ আবারও অন্ধকারে ঢাকবে সব। তাই রাজনৈতিক বিবেচনার উর্ধে উঠে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিআরটিএ ও যাত্রী অধিকার আদায়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের তথ্য মতে, বর্তমানে ঢাকায় প্রায় ১৫ লাখ নিবন্ধিত যানবাহন চলাচল করছে। পাশাপাশি দুই লাখ অবৈধ পরিবহনও চলছে। আছে অবৈধ ও মাদকাসক্ত চালকের দৌরাত্ম্যও। যাদের সামাজিক শিক্ষা ও বাস্তবতা সম্পর্কে কোন ধ্যান-ধারণা নেই। এর মধ্যে অন্তত ৮৭ ভাগ চালক আইন লঙ্ঘন করে রাস্তায় গাড়ি চালান। সব মিলিয়ে সড়ক আর কোনভাবেই নিরাপদ বলা যাবে না। তাই একের পর এক ঘটছে দুর্ঘটনা। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যখন সবাই সোচ্চার এরমধ্যে শুক্রবার সকালে সাবেক মন্ত্রী ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের গাড়ি চাপা দিয়েছে বলাকা পরিবহনের একটি বাস। অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন দেশের প্রবীণ এই বাম নেতা। পুলিশ জানিয়েছেন, মহাখালী এলাকায় মেননের গাড়ি চাপা দেয়া বলাকা পরিবহনের বাস চালককে আটক করা হয়েছে। বাসটির বৈধ কাগজপত্র ছিল না। এর আগেও এই বাসের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এছাড়া চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্সও ছিল না। রাজধানীজুড়ে গণপরিবহনের নৈরাজ্য রোধে যখন চিরুনি অভিযান চলছে তখনও পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলার চেষ্টা করছে অবৈধ যানবাহন। সর্বশেষ ১৯ মার্চ বাস চাপায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরারের মৃত্যুর পর আবারও নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও পরিবহন মালিক সমিতিসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। অবৈধ চালক ও যানবাহনের বিরুদ্ধে যেমন নগরজুড়ে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছে তেমনি পথচারীদের জন্যও আসছে নানান সতর্কবার্তা। অর্থাৎ নিরাপদ থাকতে হলে সতর্ক হয়ে পথ চলতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পথচারীদের সতর্ক হয়ে পথ চলার কোন বিকল্প নেই। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের নেতারা বলছেন, বেপরোয়া সড়ক পারাপার দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। নিরাপদ রাস্তা পারাপার নিশ্চিত করা সম্ভব হলে ঢাকায় অন্তত ৮০ ভাগ দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোঃ আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, আমাদের (ট্রাফিক পুলিশ) দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। ট্রাফিক ব্যবস্থার জন্য আমাদের কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতেই হবে। বারবার বলছি, কাজ হচ্ছে না। এখন আমাদের কঠোরভাবে আইনী প্রয়োগে যেতে হবে। এখন থেকে দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ালে পথচারীর বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। অভিযানেও নিয়ন্ত্রণ আসছে না ॥ রাজধানীতে ট্রাফিক আইন অমান্য করায় ৩৪৪ বাসের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। এরমধ্যে ৩২৭ বাসের বিরুদ্ধে মামলা এবং ১৭টি বাস ডাম্পিং করা হয়েছে। ডিএমপির চলমান ট্রাফিক শৃঙ্খলা সপ্তাহের মধ্যেই রাজধানীর প্রগতি সরণির যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাস চাপায় আবরার নামে বিইউপি শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর অভিযান জোরদার করে ট্রাফিক বিভাগ। বৃহস্পতিবার দিনব্যাপী অভিযানে ট্রাফিক আইন অমান্য করায় ৩৪৪ বাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। শুক্রবার ডিএমপির মিডিয়া এ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোঃ মাসুদুর রহমান ট্রাফিক বিভাগের বরাত দিয়ে জানান, কাগজপত্র ও ফিটনেসজনিত ত্রুটির কারণে ৩২৭ বাসের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন দাখিল এবং ১৭টি ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ট্রাফিক পূর্ব বিভাগ ৬২, পশ্চিম বিভাগ ২৬, উত্তর বিভাগ ১৫২ ও ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগ ৮৭টি বাসের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন দাখিল করে। এছাড়া ট্রাফিক পূর্ব বিভাগ ৪, পশ্চিম বিভাগ ১২ ও ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগ একটি বাস ডাম্পিংয়ে পাঠায়। ঢাকার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় পথচারীদের সতর্ক হয়ে পথ চলার আহ্বান জানিয়ে নৌ সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, নগরীর রাস্তা আর পথচারীদের জন্য নিরাপদ নয়। এজন্য ঘরে বসে থাকারও সুযোগ নেই। তাই সবাইকে সতর্ক হয়ে পথ চলতে হবে। বেপরোয়া রাস্তা পারাপার যে কোন সময় বিপদ ডেকে আনতে পারে। সড়কে পরিবহন শৃঙ্খলা ফেরাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও পরিবহন মালিক শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। শুক্রবার ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বাসের রেষারেষির চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। তেমনি সিটি কর্পোরেশন ও ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে নির্ধারণ করা ১৩০টি বাস স্টপেজের বেশিরভাগ স্থানে বাস না থামাতে দেখা গেছে। যে কেউ যে কোন স্থান থেকে ইচ্ছা করলেই বাসে ওঠানামা করতে পারছেন। তেমনি দরজা খোলা রেখে চলছে বেশিরভাগ বাস। নগরীর মতিঝিল, মালিবাগ, কাকরাইল, শাহবাগ, ফার্মগেট, মগবাজার, মৌচাক, পল্টন, শান্তিনগর, বাংলামোটর, ইস্কাটন, মহাখালী, খিলগাঁও, বাসাবো, রাজারবাগসহ বিভিন্ন সড়কে ঘুরে এ চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। নূর এ মক্কা, আট নম্বর, ছয় নম্বর, ছালছাবিল, অনাবিল, রাইদা, তুরাগ পরিবহন, নিউ ভিশন, সিটি সার্ভিস, জাবালে নূর, মিডলাইন, বাহন, লাব্বায়েক, প্রভাতি বনশ্রী, গাজীপুর পরিবহনসহ বিভিন্ন কোম্পানির বাস ইচ্ছেমতো চলাচল করতে দেখা যায়। জানতে চাইলে নূর এ মক্কা পরিবহনের বাস চালক আজিজুল জানালেন, পরিবহন মালিক সমিতির পক্ষ থেকে নতুন কোন নির্দেশনা আমাদের কাছে আসেনি। তাই আগের নিয়মে আমরা গাড়ি চালাচ্ছি। তিনি বলেন, চালকরা কখনই ইচ্ছা করে দুর্ঘটনা ঘটান না। নিজেদের ত্রুটি বিচ্যুতির কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, যাত্রী, চালকসহ সংশ্লিষ্ট সবাই সচেতন হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, গত বছর নিরাপদ সড়কের জন্য নেয়া সিদ্ধান্তগুলোর কিছু বাস্তবায়ন হয়েছে। মালিকরা সবাই ঐক্যবদ্ধ না থাকায় আমরা চুক্তিভিত্তিক বাস চালানো বন্ধ করতে পারিনি। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনার জন্য চুক্তিতে গাড়ি চালানো অন্যতম কারণ। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে মালিক-শ্রমিক ঐক্যপরিষদের নতুন কমিটি গঠন হয়েছে। আমরা সড়ক নিরাপদ করার স্বার্থে বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তা কার্যকর করা হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সবাইকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে ডিএমপি কমিশনার সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে না পারার ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে বলেন, দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যাই। জবাব দিতে পারি না। কিন্তু এটার পরিবর্তন হওয়া দরকার। জনগণ যাতে ফুটওভার ব্রিজ ও জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার করে, সেজন্য ট্রাফিক বিভাগকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিচ্ছি। দুর্ঘটনা ঘটানোয় বাস যেমন আটক করেন তেমনি দুর্ঘটনার কারণ হলে পথচারীকেও আটক করুন। আটক করে মিডিয়াকে দেখান, দেশের মানুষকে দেখান যে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে, জেব্রা ক্রসিং ব্যতীত রাস্তা পার হতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, বাসের দরজা যদি বন্ধ করে রাখেন এক স্টপেজ থেকে আরেক স্টপেজ তাহলে প্যাসেঞ্জার উঠতে পারবে না। এই অবস্থায় যাত্রীও বা কেন বাসটি দাঁড় করাবে? নির্দিষ্ট বাস স্টপেজ ছাড়া যাত্রী নামাবেন না, উঠাবেন না। আমি ট্রাফিক বিভাগের প্রতি নির্দেশ দিচ্ছি- কোন পরিবহন যদি এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে যেখানে-সেখানে বাস দাঁড় করায় ও যাত্রী ওঠানামা করায়, দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাহলে ওই পরিবহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। দোষ যদি হয় পথচারীর, তাহলে বাস ও বাসের চালক কেন আটক হবে? ভিডিও করুন, শুধু জরিমানা নয়, আটক করুন। আইনগত ব্যবস্থা নিন। যেখানে মালিক-শ্রমিকের দায়িত্ব আছে সেখানে পথচারীরও দায়িত্ব আছে। এই কাজগুলো এখন আমাদের করতে হবে। তিনি বলেন, তিনটি বিষয় আমরা ক্লিয়ার রাখতে চাই। এক. ফিটনেসবিহীন লক্কড়-ঝক্কড় বাস আর ঢাকা শহরে চলতে দেব না। নির্ধারিত বাস স্টপেজের বাইরে বাস দাঁড়াতে পারবে না। দরজা বন্ধ রাখুন। জেব্রা ক্রসিং এর আগে বাস দাঁড় করুন, যাত্রী সাধারণ ও পথচারীকে নিরাপদে রাস্তা পার হতে দিন। দুই. অভিযান জোরদার হবে। তিন. দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ালে পথচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা। রাজধানীর ৮৭ ভাগ চালক আইন মানেন না ॥ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমানে সারাদেশে নিবন্ধিত প্রায় ৩৯ লাখ যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনিবন্ধিত, ভুয়া নাম্বারধারী ও অযান্ত্রিক যান মিলে প্রায় ৫০ লাখ যান চলছে। যার ৭২ শতাংশ ফিটনেস অযোগ্য। অন্যদিকে সারাদেশে ৭০ লাখ চালকের মধ্যে বিআরটিএর লাইসেন্স আছে মাত্র ১৬ লাখ চালকের। রাজধানীতে ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাস ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করে বেপরোয়া চলাচল করে। ফলে এসব বাসে দুর্ঘটনায় কারও হাত, কারও পা, কারও মাথা, কারও জীবন পর্যন্ত চলে যাচ্ছে। সংগঠনের সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ সেলের তথ্যমতে, সারাদেশে জানুয়ারি ’১৮ থেকে ২০ এপ্রিল ’১৮ পর্যন্ত ১ হাজার ৭৭৯ সড়ক দুর্ঘটনায় এক হাজার ৮৪১ জনের প্রাণহানিও ৫ হাজার ৪৭৭ আহত হয়েছে। পঙ্গুত্ববরণ করেছেন ২৮৮ জন। সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, আমরা এসব দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা নয় পরিকল্পিত হত্যাকা- বলতে চাই। কেননা আমাদের সড়কে সব অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা জিইয়ে রেখে নৈরাজ্যকর পরিবেশে যাতায়াতে বাধ্য করা হচ্ছে। নগরীর প্রতিটি বাস-মিনিবাসের ব্যবসা মূলত চালকরা নিয়ন্ত্রণ করছেন। দৈনিক চুক্তিভিত্তিক ইজারায় প্রতিটি মালিক তার বাস চালকের হাতে তুলে দিয়েছেন। এতেই চালকরা যাত্রী উঠানোর জন্য বাসে বাসে ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এমন পরিস্থিতিতে বাস চালাতে গিয়ে বাসের নিচে কে পড়ল কার হাত বা পা গেল তা দেখার সময় নেই তাদের। সচেতনতা ৮০ ভাগ দুর্ঘটনা রোধ করতে পারে ॥ নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ও চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, যাত্রীরা সতর্ক হলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। সচেতনতা এ ক্ষেত্রে ৮০ ভাগ দুর্ঘটনা কমাতে পারে। চালকের শরীরী ভাষা লক্ষ্য করেই একজন যাত্রী বুঝতে পারবেন চালক ক্লান্ত কি না। যেমনÑ চালক যদি ক্লান্ত থাকেন বা তার ঘুম পায়, তাহলে প্রথমেই তিনি ডান-বাঁয়ে ঘাড় নাড়িয়ে ঝিমুনি কাটাতে চেষ্টা করবেন। তার পরের ধাপে ঘাড়ের এক পাশে হাত দিয়ে চাপ দিতে থাকবেন। এরপর যদি চালক হাত মুঠো করে নিজের চুল টানতে থাকেন, তখন বুঝতে হবে তিনি আর জেগে থাকতে পারছেন না। তখন সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি বা বাস রাস্তায় থামিয়ে দিতে হবে। চোখে-মুখে পানি দিয়ে, চা-কফি খেয়ে অন্তত আধা ঘণ্টা ঘুমিয়ে নেয়ার সুযোগ দিতে হবে চালককে। এভাবে বিশ্রামের সুযোগ পেলে চালক পরবর্তী দু-তিন ঘণ্টা সুস্থির-সজাগ থেকে গাড়ি চালিয়ে নিতে পারবেন। ফিটনেসবিহীন যানবাহন দুই লাখের বেশি ॥ বুয়েটের এআরআই জানাচ্ছে, ২০১৬ সালের মার্চ থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৬৬টি দুর্ঘটনায় ৬৯৯ জন নিহত এবং এক হাজার ২২৭ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫৪টি দুর্ঘটনাই বাসের কারণে ঘটেছে। এছাড়া ১৩০ মোটরসাইকেল, ১১৩টি ট্রাক, ৭৩টি পিকআপ এবং ৫৬টি ব্যক্তিগত গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। এআরআইয়ের হিসাবে, ওই সময়ে রাজধানীতে দুর্ঘটনা, আহত ও নিহতের সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে বাসের কারণে দুর্ঘটনাও। ২০১৬ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় ১২৩টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৩৭ জন, আহত হয়েছেন ৩৩৭ জন। ২০১৭ সালে ঢাকায় ২৬৩টি দুর্ঘটনা ঘটার তথ্য দিচ্ছে এআরই। তাতে ২৭৬ জন নিহত হওয়ার পাশাপাশি ৩৫৮ জন আহত হয়েছিল। সে বছর ১৪৫টি দুর্ঘটনায় বাসের সম্পৃক্ততা ছিল। ২০১৮ সালে ঢাকায় ২৮০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৮৬ জন নিহত হয়। আহত হয়েছিল ৫৩২ জন। সে বছর ১৩৪টি দুর্ঘটনার কারণ বাস। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালানোর কারণে মালিকপক্ষের টাকা পরিশোধের চাপ নিয়ে রাস্তায় নামেন চালকরা। সেইসঙ্গে লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালকের সংখ্যা বাড়ছে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় চালকরা বেপরোয়া হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ্যাক্সিডেন্ট রিচার্স ইনস্টিটিউট এর তথ্যমতে, রাজধানীতে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা দুই লাখের বেশি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্ঘটনার সংবাদ পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ। ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলার কারণেই বেশিরভাগ দুর্ঘটনায় বাস জড়িয়ে যাচ্ছে জানান তিনি। এসব যানের অনিয়ন্ত্রিত চলাচল দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ। ঢাকা শহরে বাসের সিস্টেমটা একটু বিশৃঙ্খল। বাসের চালকরা অনিয়ন্ত্রিত, বেপরোয়া চলাচল করে বেশি। যাত্রীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস চালায়। তাদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণগুলো বেশি হয়। তিনি বলেন, ঢাকায় দুর্ঘটনা ঘটানোর ক্ষেত্রে বাসের পরই রয়েছে ট্রাক ও মোটরসাইকেল। দুর্ঘটনার জন্য প্রধান দায়ী বাস ॥ বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) গবেষণায় বলা হয়েছে, রাজধানীতে অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনা বাসের কারণে ঘটছে। রাজধানীতে সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর সবকটিতেই বাসের বেপরোয়া চালনাকে দায়ী করা করেছে এআরআই। এছাড়া বেসরকারী বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও ঢাকায় বেপরোয়া বাস চালক নিয়ে সতর্কবার্তা অনেক আগে থেকেই দেয়া হচ্ছিল। সর্বশেষ মঙ্গলবার রাজধানীর নর্দ্দা এলাকায় বাস চাপায় ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী নিহত হন। জেব্রা ক্রসিং দিয়ে নিয়ম মেনে সড়ক পারাপারের সময় মৃত্যুদূত হয়ে সামনে আসে ঘাতক বাস। কেড়ে নেয় নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করা মেধাবী ছাত্র আবরারের প্রাণ। চালক গ্রেফতার হওয়ার পর দেখা গেছে, তার ভারি পরিবহন চালনের লাইসেন্স ছিল না।
×