ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অগ্নিঝরা মার্চ

প্রকাশিত: ১০:০৫, ২৩ মার্চ ২০১৯

অগ্নিঝরা মার্চ

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ প্রতি বছর এই দিনটি পাকিস্তান দিবস রূপে পালিত হতো। একাত্তরের এই দিন ইতিহাসের ব্যতিক্রমী দিন। পাকিস্তান দিবসের পরিবর্তে পালিত হয় প্রতিরোধ দিবস। এইদিনে হাজার হাজার বাংলাদেশের পতাকা বিক্রি হয়েছিল। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত জনসমাবেশ থেকে স্বাধীনতার জন্যে সশস্ত্র প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। যে কোন কিছুর বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দাবি বাস্তবায়ন করাই আজ সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর পবিত্র কর্তব্য। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন চলছে। ১৯৭১ সালের আগ পর্যন্ত ২৩ মার্চ উদ্যাপিত হতো পাকিস্তান দিবস বা লাহোর প্রস্তাব দিবস হিসেবে। এদিন পাকিস্তানের পতাকায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকত রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, দোকানপাট সব। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্দেশ দিয়েছিলেন, আর নয়, এবার পাকিস্তান দিবসের পরিবর্তে ২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উঠবে। প্রতিটি যানবাহনে, ভবনে, সব কার্যালয়ে, উচ্চ আদালতে উত্তোলিত হবে ওই পতাকা। এই নির্দেশনার আলোকে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পূর্বঘোষিত ও সুস্পষ্ট পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পতাকা উত্তোলন দিবস পালনের ঘোষণা করা হয়। এটি প্রদীপ্ত সূর্যের মতো সত্য যে শুধু পল্টনেই নয়, সমগ্র দেশের প্রতিটি বিভাগ, জেলা ও মহকুমা শহরেও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে একযোগে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করা হয় । প্রতিরোধ আন্দোলনের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তাঁর নিজ বাসভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করেন। এ সময় তিনি আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সালাম গ্রহণ করেন। শুধু প্রেসিডেন্ট ভবন, ক্যান্টনমেন্টগুলো ও তেজগাঁও বিমানবন্দর ছাড়া আর কোথায় পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করা হয়নি। দূতাবাসগুলোতে প্রথমে তাদের জাতীয় পতাকার সঙ্গে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করা হলেও জনরোষের কারণে পরবর্তীতে তা নামিয়ে ফেলে এবং কিছু কিছু দূতাবাসে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। টেলিভিশনে উর্দু সঙ্গীতও বাজানো হয়নি। সংস্কৃতিকর্মী ও বুদ্ধিজীবীরা বিভিন্ন প্রতিবাদ সভা-সমাবেশ অব্যাহত রাখেন। এই দিন সম্পর্কে আসগর খান লিখেছেন, ‘এ দিনই বলতে গেলে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। সর্বত্র বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে, কোথাও পাকিস্তানী পতাকার চিহ্ন নেই’। পাকিস্তান দিবসের পরিবর্তে পালিত হয় প্রতিরোধ দিবস। সকাল ৯.২০ মিনিটে পল্টন ময়দানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি গেয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে ‘স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ’-এর গণবাহিনীর কুচকাওয়াজ শুরু হয়। এ সময় তারা স্বাধীন বাংলার পতাকাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সালাম ও মার্চপাস্ট করে সম্মান জানায়। সম্মিলিত গণবাহিনী ঢাকার রাজপথ ধরে কুচকাওয়াজ সহকারে গার্ড অব অনার দেয়ার জন্যে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আসে। বঙ্গবন্ধু তাদের সালাম গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু বারবার মিছিলকারীদের উদ্দেশে শুভেচ্ছা জানিয়ে ভাষণ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন ৭ কোটি মানুষের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলবে। বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতা শেষে নিজে স্লোগান ধরেন ‘জয় বাংলা’ আমার দেশ তোমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ, জাগো জাগো বাঙ্গালী জাগো, সংগ্রাম সংগ্রাম চলছে চলবে। পল্টন ময়দানে ভাসানী ন্যাপ, শহীদ মিনারে ছাত্র ইউনিয়ন, বায়তুল মোকাররমে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বিশাল জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। জনসমাবেশগুলোতে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র প্রস্তুতি গ্রহণের উদ্দেশে জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। চট্টগ্রামে অধ্যাপক আজিজুর রহমান মল্লিক, অধ্যাপক সৈয়দ আহসান, ড. আনিসুজ্জামান প্রমুখের নেতৃত্বে বিক্ষোভ সমাবেশ ও প্রতিবাদ-মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। সৈয়দপুরে সেনাবাহিনী ও গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষে কয়েকজন হতাহত হয়। সন্ধ্যায় সেখানে কারফিউ জারি করে অবাঙালী ও সেনাবাহিনী স্থানীয় মানুষের জীবন এবং সম্পত্তির ওপর হামলা, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ করে। ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের নেতৃত্বে থাকা লে. জেনারেল মাসুদুল হককে ঢাকা সেনানিবাসে গৃহবন্দী করা হয়। তার স্থলে জয়দেবপুরে পাঠানো হয় ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট কমান্ডার লে. জেনারেল রকিবকে। প্রেসিডেন্ট ভবনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খোন্দকার মোশতাক আহমদ ও ড. কামাল হোসেন ইয়াহিয়ার উপদেষ্টা এমএম আহমেদ, বিচারপতি কর্নেলিয়াস, লে. জে. পীরজাদা ও কর্নেল হাসানের সঙ্গে সকাল-বিকেল দুই দফা বৈঠক করেন। এতে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ একটি খসড়া শাসনতন্ত্র পেশ করেন। লে. জে. পীরজাদা এ শাসনতন্ত্রের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়গুলো মেনে নেয়া হবে বলে আভাস দেন। পাকিস্তানী বিশিষ্ট আইনজ্ঞ এ কে ব্রোহি সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন, সামরিক শাসন প্রত্যাহার এবং ক্ষমতা হস্তান্তরে আইনগত কোন বাধা নেই। পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট ভবনের এক মুখপাত্র বলেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণের প্রস্তুতি চলছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এক দিনের মধ্যে এ বিষয়ে ঘোষণা দিচ্ছেন। অন্যদিকে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সেনাকর্মকর্তাদের সঙ্গে ইস্টার্ন কমান্ড সদর দফতরে আলোচনা বৈঠক এবং বৈঠক-পরবর্তী ভাষণ দেন। করাচীতে ভুট্টো-সমর্থকদের বাঙালী কলোনিতে হামলা, অগ্নিসংযোগ, গুলিবর্ষণ ও লুটতরাজ চলে, হতাহত হয় কয়েকজন।
×