ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

৪০ বছরে ইরানের বিস্ময়কর উন্নয়ন

প্রকাশিত: ০১:০৩, ২৩ মার্চ ২০১৯

৪০ বছরে ইরানের বিস্ময়কর উন্নয়ন

অনলাইন ডেস্ক ॥ ১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তীব্র আন্দোলনের মুখে ইরানের স্বৈরশাসক রেজা শাহ পাহলভী সরকারের পতন ঘটে এবং দেশটিতে ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে দুনিয়া-কাঁপানো ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হয়। এ বিপ্লবের ফলে অবসান ঘটে প্রায় আড়াই হাজার বছরের রাজতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থার। শাহ সরকারের পতনে ক্ষুব্ধ হয়ে আমেরিকা-ব্রিটেনসহ পশ্চিমা দেশগুলো ইরানের ইসলামি বিরুদ্ধে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিতে থাকে। ইরাকের সাবেক স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনের মাধ্যমে তারা ইরানের ওপর চাপিয়ে দেয় এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ৮ বছর স্থায়ী ওই যুদ্ধে শহীদ হয়েছে লাখ লাখ ইরানি। এছাড়া, সন্ত্রাসী বোমা হামলা চালিয়ে শহীদ করা হয় ইরানের শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন আলেম, রাজনৈতিক নেতা, বিজ্ঞানীসহ বহু উচ্চ-পদস্থ কর্মকর্তাকে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা, নিষেধাজ্ঞার পর নিষেধাজ্ঞা এবং নানা অবরোধ সত্ত্বেও বিপ্লবী ইরান উন্নয়নের অনেক মৌলিক ক্ষেত্রে দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দেয়ার মত বহু সাফল্য অর্জন করেছে। কৃষি, শিক্ষা, শিল্প, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য-চিকিৎসা, মহাকাশ গবেষণা ও সামরিক খাতে ইরানের উন্নয়ন বিশ্ববাসীকে বিস্মিত করে চলেছে। অতি সম্প্রতি ইরান মহাশূন্যে পাঠিয়েছে নিজস্ব প্রযুক্তির দু'টি কৃত্রিম উপগ্রহ। ইরানের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো এখন লক্ষ্যবস্তুর মাত্র কয়েক মিটারের মধ্যেই নিখুঁত আঘাত হানতে সক্ষম। বিজ্ঞান-গবেষণায় ইসলামি ইরান এখন বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকটি দেশের অন্যতম। এই নিবন্ধে কয়েকটি ক্ষেত্রে ইরানের সার্বিক উন্নয়নের একটি সংক্ষিণ বিবরণ তুলে ধরা হলো: কৃষি উন্নয়ন ইসলামি বিপ্লবের পর বিগত ৪০ বছরে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইরানের অর্থনীতির চালিকাশক্তিগুলোও পাল্টে যাচ্ছে। এক সময় তেল রফতানি ছিল ইরানের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। কিন্তু সেই তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে ক্রমশ বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে দেশটি। বর্তমানে কৃষিখাতে দেশটির উন্নয়নের চিত্র রীতিমত বিস্ময়কর। ২০১৭ সালে বিশ্বে কৃষি পণ্যের বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে তৃতীয় অবস্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছে ইরান। এছাড়া ইরানের তুলনামূলক রফতানি সম্ভাবনাময় খাতগুলোর তালিকায় শীর্ষে উঠে এসেছে দেশটির কৃষি খাত। ইরানের বাণিজ্য উন্নয়ন সংস্থা (টিপিও) প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে এই চিত্র পাওয়া গেছে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বা ফাও’র তথ্য মতে, ইরান হচ্ছে বিশ্বের প্রধান পাঁচটি দেশের মধ্যে একটি যে দেশটি কমলা, মাল্টা ও লেবুজাতীয় ফল উৎপাদনে সেরা অবস্থানে রয়েছে। এছাড়া শশা, ক্ষীরা, খেজুর, বেগুন, ডুমুর, পেস্তা, নাশপাতি, আখরোট ও তরমুজ উৎপাদনে বিশ্বের সেরা পাঁচ দেশের মধ্যে রয়েছে ইরান। বিশ্ব র্যাংকিংয়ে ইরানি কৃষিপণ্য পৃথিবীর অন্যতম মূল্যবান কৃষিপণ্যের একটি জাফরান। যাকে ইরানের ‘লাল স্বর্ণ’ বলা হয়ে থাকে। কারণ, বিশ্বের মোট উৎপাদিত জাফরানের প্রায় ৯০ শতাংশই উৎপাদিত হয় মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিতে। বিশ্বের সবচেয়ে দামি খাবার ক্যাভিয়ার বা ‘কৃষ্ণ সোনা’ উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষ স্থানে রয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। বিশ্বে উটপাখির মাংস উৎপাদনে ইরান দ্বিতীয়। বৈশ্বিকভাবে ডিম উৎপাদনের র্যাংঙ্কিংয়ে ১২তম অবস্থানে রয়েছে ইরান। মৌচাকের সংখ্যায় বিশ্বে ইরানের অবস্থান চতুর্থ এবং মধু উৎপাদনে অষ্টম। খেজুর উৎপাদনে বিশ্বে ইরানের অবস্থান দ্বিতীয় এবং বিশ্বের বৃহত্তম খেজুর রফতানিকারক দেশ ইরান। বিশ্বে বর্তমানে তৃতীয় বৃহত্তম কিসমিস রফতানিকারক দেশ ইরান। বিশ্বের শীর্ষ আঙ্গুর উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় ৮ম স্থান অধিকার করেছে ইরান। পৃথিবীতে যত দামী ফল বিশেষ করে বাদামজাতীয় ফল রয়েছে তার মধ্যে পেস্তা অন্যতম। এই ফলটির নাম আসলেই যে দেশটির কথা সবার আগে উচ্চারিত হয় তার নাম ইরান। আখরোট উৎপাদনে ইরান বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।শিল্প ও বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন বিপ্লবের ৪০ বছর পরে এসে ইরান বায়োপ্রযুক্তি, ন্যানোপ্রযুক্তি, ওষুধ শিল্পসহ বিজ্ঞানের সব ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি করেছে। ইরান এখন মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বেশি গাড়ি নির্মাণকারী দেশ। পরিবহন খাতে বিরাট উন্নতি ঘটিয়েছে। এছাড়া, মধ্যপ্রাচ্যের ভেতরে ইরান হচ্ছে নির্মাণ, গৃহস্থালিতে ব্যবহার্য জিনিসপত্র, খাদ্য ও কৃষিপণ্য উৎপাদন, অস্ত্র ও তথ্যপ্রযুক্তি, বিদ্যুৎ এবং পেট্রোকেমিক্যাল উৎপাদনে সবচেয়ে অগ্রগামী দেশ। ২০০৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ‘সাফির’ নামে সর্বপ্রথম একটি রকেট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে ইরান সর্বপ্রথম কক্ষপথে তার কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপনে সাফল্য অর্জন করে। নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি স্যাটেলাইট ও দেশে নির্মিত লাঞ্চারের মাধ্যমে রকেট উৎক্ষেপণে বিশ্বে যে সাতটি দেশ সক্ষম ইরান এখন তার একটি। এছাড়া, ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লুরাইড উৎপাদন ও পুরো ‘পরমাণু জ্বালানি চক্র’ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম এলিট ক্লাবের সদস্য দেশ ইরান। ইসলামিক ওয়ার্ল্ড সায়েন্স সাইটেশান সেন্টার বা আইএসসি'র প্রধান মুহাম্মাদ জাওয়াদ দেহকানি বলেছেন, আন্তর্জাতিক গবেষণা অনুযায়ী বিপ্লব পরবর্তীকালে ইরান বৈজ্ঞানিক দিক থেকে বিপ্লব পূর্ববর্তীকালের তুলনায় ১৯ গুণ বেশি এগিয়ে গেছে। এ দিক থেকে ইরান এখন বিশ্বে ১৬তম অবস্থানে রয়েছে। জেনেটিক বিজ্ঞানে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে প্রথম স্থান এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ১৬তম স্থানে রয়েছে। অ্যারোস্পেইস সায়েন্সেও আঞ্চলিক ক্ষেত্রে প্রথম এবং বিশ্বে ১৫তম অবস্থানে রয়েছে। এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে মহাকাশ বিজ্ঞান গবেষণা র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে রয়েছে ইরান। মহাশূন্যে নিজস্ব প্রযুক্তিতে নির্মিত স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে সক্ষম দেশের মধ্যে ইরানের অবস্থান নবম এবং মহাকাশযানে প্রাণী পাঠানোর ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান ষষ্ঠ। স্টেমসেল গবেষণার ক্ষেত্রে ইরান প্রথম সারির ১০টি দেশের মাঝে অবস্থান করছে। স্টেমসেল রিপ্লেস করার ক্ষেত্রে বিশ্বে ইরানের অবস্থান দ্বিতীয়। ন্যানোপ্রযুক্তি খাতে ইরানের প্রবৃদ্ধি বিস্ময়কর। ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার কারিগরি ও প্রযুক্তিক্ষেত্রে এখন ন্যানোপ্রযুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রায় সকল বিভাগেই এই ন্যানো প্রযুক্তি এখন গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে। ন্যানো প্রযুক্তিতে ইরান বিশ্বের দশটি দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। মেডিসিন, ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মাসিউটিক্যালস, পশু চিকিৎসা, পরিবেশ বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান, মলিকিউল এমনকি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়েও এই প্রযুক্তির ব্যবহার লক্ষণীয়। ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ইরানে এখন অন্তত ৩০০টি পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। এসব পণ্য ইরানের বাইরে ১৭টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। গবেষণাগারের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, শিল্প সরঞ্জাম, টেক্সটাইল সরঞ্জাম, লন্ড্রি বা ডিজারজেন্ট পণ্য সামগ্রী, কৃষি ও ভবন নির্মাণ সরঞ্জাম ইত্যাদি ন্যানো প্রযুক্তি জাত পণ্যের অন্তর্ভুক্ত। টেক্সটাইল শিল্প পণ্যের ক্ষেত্রে হাসপাতালে ব্যবহৃত বেডশিটের কথা বলা যেতে পারে। ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার করে নির্মিত এইসব বেডশিট অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল মানে কোনোরকম ব্যাকটেরিয়া এসব চাদরে আক্রমণ করতে পারবে না। শিশুদের জামা কাপড়ও এই ন্যানো প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা হয়। স্যাটেলাইট-রশ্মি, মাইক্রোওয়েভ রশ্মি প্রতিরোধক কাপড়ও ন্যানো প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা হয়। বায়ুমণ্ডলীয় ঠাণ্ডা প্লাজমা শিল্প মেশিনের কথা না বললেই নয়। এই শিল্পে এখন তাঁত শিল্পসহ খাবার, চিকিৎসা, প্যাকেজিং এবং স্ট্রেরিলাইজেশনিং করা হয়। এমনকি পরিবেশ বিজ্ঞানেও এই প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সামরিক শক্তি ইরান সারা বিশ্বে এখন যেসব কারণে বিশেষ আলোচিত তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এর সামরিক শক্তি। সামরিক শক্তি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনায় না গিয়েও বলা যায়- ইরানের হাতে রয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ সক্রিয় সেনা সদস্য। এছাড়া আছে সাড়ে তিন লাখ রিজার্ভ সেনা। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী বাসিজ, যার সদস্য সংখ্যা দশ লাখের বেশি। এতে পুরুষের পাশাপাশি নারী সদস্যও রয়েছে। সব মিলিয়ে ইরান যেকোনো সময় দশ লাখের বেশি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনা মোবিলাইজ করতে পারে এবং এ সুবিধা বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকটি দেশের জন্য রয়েছে। ইরানের হাতে রয়েছে নিজস্ব সামরিক শিল্প-কারখানা যেখানে ট্যাংক, আর্মড পারসোনেল ক্যারিয়ার, গাইডেড মিসাইল, সাবমেরিন, সামরিক নৌযান, গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার, রাডার সিস্টেম, হেলিকপ্টার এবং জঙ্গিবিমান তৈরি করা হয়। এছাড়া ইরানের কারখানায় তৈরি করা হচ্ছে- হুত, কাউসার, জেলাল, ফতেহ-১১০, শাহাব-৩ ও সিজ্জিল ক্ষেপণাস্ত্র এবং নানা ধরনের ড্রোন। ক্ষেপণাস্ত্র শক্তি ইরানের আক্রমণাত্মক ও প্রতিরক্ষা কৌশলের প্রধান স্তম্ভ হল অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র। ক্ষেপণাস্ত্র শক্তিতে দেশটির অবস্থান এখন বিশ্বে চতুর্থ। ইরান বিশ্বের যত বড় পরাশক্তির হাতেই আক্রান্ত হোক না কেন দেশটির ব্যালিস্টিক ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্টা আঘাতগুলো হজম করা হবে খুবই কঠিন এবং অসহনীয়। তাই ইরানের শত্রুরা এ দিকটি বিশেষ বিবেচনায় রেখে সামরিক হামলার কথা খুব কমই ভাবতে বাধ্য। উল্লেখ্য ইরান এরআগে নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি করেছে- ইমাদ ও ফজরের মতো উন্নত প্রযুক্তির ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। আর বিপ্লবের ৪০তম বার্ষিকী উপলক্ষে উন্মোচন করেছে ইরান ‘হুভেইযে’ ও ‘দেজফুল’ নামে দুটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। চিকিৎসাক্ষেত্রে উন্নয়ন চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় এখন ইরানের নাম। চিকিৎসা ক্ষেত্রে পরমাণু প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যাধুনিক ও জটিল। ইরানি বিজ্ঞানীরা অত্যন্ত জরুরি এ ক্ষেত্রে দর্শনীয় সাফল্য অর্জন করেছেন। ইরানি বিজ্ঞানীরা শক্তিশালী মৌলিক কোষ তৈরি করতে সক্ষম হওয়ায় ইরান এ ক্ষেত্রে বিশ্বের পাঁচটি দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। ক্যান্সার চিকিৎসায়ও ইরানি বিজ্ঞানীরা উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছেন। বর্তমানে এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে মেডিক্যাল ট্যুরিজম ক্ষেত্রে কঠোর প্রতিযোগিতা চলছে। এই প্রতিযোগিতায় ইরানের অবস্থান বিশ্বের শীর্ষ দশটি দেশের মধ্যে রয়েছে। এছাড়া, ভ্যাকসিন উৎপাদনে মধ্যপ্রাচ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে ইরান। শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়ন শিক্ষাক্ষেত্রে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে ইরান সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী অবস্থানে রয়েছে। দেশটির শতকরা ৯৭ ভাগ মানুষ শিক্ষিত। ইসলামি শিক্ষা-দর্শনের ভিত্তিতে দেশের প্রয়োজনের প্রতি দৃষ্টি রেখে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর ফলে ইসলামি দর্শনের পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় ইরানের অগ্রগতি এখন এককথায় বিস্ময়কর। বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে নানা রকমের বাধা-বিপত্তি, পাশ্চাত্যের অসহযোগিতা ও বিশেষ অর্থনৈতিক অবরোধ সত্ত্বেও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত ইরানি বিজ্ঞানীরা চরম আত্মত্যাগ ও সাধনার পরিচয় দেয়ায় দেশটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে বৈপ্লবিক উন্নতি ও সাফল্য অর্জন করেছে। ২০১৭ ‘হাইলি সাইটেড রিসারচারস’ শীর্ষক তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন ইরানি বিজ্ঞানীরা। এছাড়া, ইরানের অন্তত ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। গ্রামীণ উন্নয়ন আট কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ইরানের ৭৪ শতাংশ মানুষ শহরে এবং ২৬ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। তবে, শহরের মতো গ্রামের মানুষও সকল মৌলিক নাগরিক সুবিধাদি ভোগ করছে। স্বল্প আয়ের জনগণ কম খরচে ও ঋণসুবিধা পেয়ে বাড়ির মালিক হচ্ছে। বিপ্লবের পর পরই প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, পানি, স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল-ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করে তাৎক্ষণিক নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এখন ইরানের গ্রামের মানুষও স্বাস্থ্য বিমার আওতায় চলে এসেছে। তিন বছর আগে অর্থাৎ ফার্সি ১৯৯৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইরানের গ্রামাঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫৫ হাজার, বিপ্লবের আগে ছিল ২২ হাজার ২৪৬টি। গত চার দশকে ডে-নাইট স্কুল ৯টি থেকে বেড়ে হয়েছে ১৩৮৭টি। শাহ সরকারের আমলে গ্রামে খেলার মাঠ ছিল মাত্র ১২টি, বর্তমানে ২ হাজার ১৮২টি। বিপ্লবের আগে গ্রামে পাকা রাস্তা ছিল মাত্র ২০০ কিলোমিটার, বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার কিলোমিটার। আধাপাকা রাস্তা ছিল ৮ হাজার ২০০ কিলোমিটার আর এখন ১ লাখ ২৯ হাজার কিলোমিটার। বিপ্লবের আগে ইরানের গ্রামাঞ্চলের জন্য কোনো ফায়ার সার্ভিস কেন্দ্র ছিল না, বর্তমানে ৩৮০টি গ্রামে ফায়ার সার্ভিস সেবা চালু আছে। সেসময় ইরানের ৩১২টি গ্রামে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল। বর্তমানে ইরানের ৫ হাজার ৩১২টি গ্রামের মানুষ টেলিফোন ব্যবহার করে। দেশটিতে গত ৪০ বছরে ৩৩ হাজার ৫০০ পল্লী উন্নয়ন পরিষদ গড়ে তোলা হয়েছে। রেজা শাহ’র আমলে ইরানের পল্লী অঞ্চলের জন্য চিকিৎসক ছিলেন ১ হাজার ৩৮২ জন, বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৫ হাজার ৩৫৩ জন। এভাবে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই ইরানের গ্রামীণ জীবনে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। গ্যাস ও তেল সম্পদ বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে আরও একটি কারণে ইরানের সবিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ইরানকে বলা হয় এনার্জি সুপারপাওয়ার। ইরানের হাতে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি (শতকরা ১৫ ভাগ) গ্যাস-সম্পদের মজুদ। বর্তমানে রাশিয়ার চেয়েও ইরানে গ্যাসের মুজদ বেশি। জ্বালানি তেলের মজুদের দিক দিয়ে বিশ্বে ইরানের অবস্থান চতুর্থ। দেশটির হাতে রয়েছে সারা বিশ্বের মোট তেল সম্পদের শতকরা ১০ ভাগ। মনে করা হয় ইরানে আরও বহু এলাকা রয়েছে যেখানে তেল-গ্যাসের খনি আবিষ্কৃত হবে। তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেকের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল সরবরাহকারী দেশ হচ্ছে ইরান। পর্যটন খাত পাহাড়, সাগর, নদ-নদী আর জঙ্গলাকীর্ণ বৈচিত্র্যময় ভূমি এবং আবহাওয়ার কারণে ইরানে পর্যটকের ভিড়ও লেগে থাকে সারা বছর। শুধু পারস্য উপসাগরের কিশ দ্বীপ ভ্রমণ করে প্রতি বছর ১০ লাখের বেশি বিদেশি পর্যটক। এশিয়ার বহু দেশ, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা থেকেই আসে বেশি পর্যটক। ইউনেস্কোর হিসাব মতে, ইরান বিশ্বের ১০ম প্রধান পর্যটনের দেশ; অভ্যন্তরীণ পর্যটনেও ইরান বিশ্বের অন্যতম। এছাড়া, চলচ্চিত্র, ক্রীড়া, সাহিত্য, সংস্কৃতি, নারীর উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা, অবকাঠামোসহ নানাক্ষেত্রে বিগত ৪০ বছরে ইরান ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। সাফল্যের রহস্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পসহ কোনো কোনো মার্কিন কর্মকর্তা বলেছিলেন, ইরানের ইসলামি বিপ্লব ৪০ বছরে উপনীত হতে পারবে না এবং তার আগের গ্রীষ্মেই ইরানে দেখা দেবে সরকার-বিরোধী গণ-অভ্যুত্থান! মার্কিন যুদ্ধবাজ নেতা জন বোল্টন বলেছিলেন, তিনি ২০১৯ সালে ইরানের ইসলামি সরকারের পতনের পর তেহরানে ক্রিসমাস উৎস করবেন সরকার বিরোধী ইরানি মোনাফিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বা এমকেও'র অনুচরদের নিয়ে! কিন্তু মার্কিন কর্মকর্তাদের এ জাতীয় বক্তব্য ভুল প্রমাণ করে ইরান বিভিন্ন ক্ষেত্রে একের পর এক সাফল্য অর্জন করেছে। সর্বক্ষেত্রে ইরানের উত্তরোত্তর সাফল্যের রহস্য সম্পর্কে দেশটির সর্বোচ্চ নেতা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী বলেছেন: "আমি সুনিশ্চিতভাবে, দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে যতটা তথ্য আমার কাছে আছে, তার ভিত্তিতে নিশ্চিতভাবে বলতে চাই, এই জাতি এবং এই নতুন ও তরুণ প্রজন্ম সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তারা আর অবজ্ঞার শিকার বা অপমানিত হতে চায় না। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাচ্ছিল্য মেনে নেবে না। পরাশক্তিগুলোর পেছনে কিংবা শত্রুদের পদলেহন করবে না। সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা তাদের প্রিয় স্বদেশকে গর্ব, সম্মান ও মর্যাদার শিখরে নিয়ে যাবে।"
×