ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অস্তিত্বহীন শাখা নদী, পানিশূন্য ধু-ধু মাঠ

ঐতিহ্য হারাচ্ছে রাজশাহীর পদ্মা- নদীবক্ষে বালুচর

প্রকাশিত: ০৮:৪৩, ২৪ মার্চ ২০১৯

ঐতিহ্য হারাচ্ছে রাজশাহীর পদ্মা- নদীবক্ষে বালুচর

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ অনেক আগেই রূপ হারিয়েছে রাজশাহীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া এক সময়ের খরস্রোতা পদ্মা নদী। কালের পরিক্রমায় এখন ঐতিহ্যটুকুও হারাতে বসেছে। বর্ষায় কিছুদিনের জন্য পদ্মায় পানি প্রবাহ থাকলেও আষাঢ়-শ্রাবণ শেষেই কমতে থাকে পানি। এরপর থেকে কমতে কমতে চৈত্রে এসে পরিণত হয় ধু-ধু বালুচরে। শুধু পদ্মা নয়, পদ্মার প্রবাহ ঘিরে এককালের সজাগ থাকা শাখা নদীগুলোর এখন আর কোন অস্তিত্বই নেই। পদ্মায় পানি না থাকার কারণেই হারিয়ে যেতে বসেছে এ অঞ্চলের সব নদ-নদী। এদিকে ক্রমেই রাজশাহী শহর থেকে প্রতিনিয়ত সরে যাচ্ছে পদ্মার পানির গতিপথ। কারণ, শহরের তীরঘেঁষে চর জেগেছে। এছাড়া গোদাগাড়ী উপজেলার বালিয়াঘাটা থেকে সুলতানগঞ্জ পর্যন্ত মহানন্দা নদীর প্রায় ১৫ কিলোমিটার এবং সুলতানগঞ্জ মোহনা থেকে প্রেমতলী পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার পদ্মা নদীর ৬০ ভাগ এলাকায় এখন পানিশূন্য। মোট নদীর ৪০ ভাগ এলাকায় পানি থাকলেও গভীরতা খুবই কম। নদীর মাঝপথে অসংখ্য ডুবোচরের কারণে নৌ চলাচল করতে পারে না। আর রাজশাহী অংশে এখন পদ্মা রূপ নিয়েছে অসংখ্য খ- খ- খালে আর বালুরাসিতে। এদিকে শুষ্ক মৌসুমে প্রতিবছরই বড় এই নদীটি পানিশূন্য হয়ে পড়ার কারণে রাজশাহী অঞ্চলের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে সাতটি নদী। ফলে জেলার ১০টি নদীর মধ্যে মানুষ এরই মধ্যে সাত নদীর নাম ভুলতে বসেছেন। দখল-বেদখলে রাজশাহীর ভৌগোলিক মানচিত্র থেকে এসব নদীর চিহ্ন মুছে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। শুকিয়ে গেছে এ অঞ্চলের আরও ১১টি নদী। আর জৌলুস হারিয়ে ক্রমেই অচেনা রূপ ধারণ করছে। ভুলিয়ে দিতে চাইছে তার রূপের তুলনা। এই পদ্মার বুকে এখন চলছে নৌকার বদলে গরু-মহিষের গাড়ি। রাজশাহীর ওপর দিয়ে প্রবাহিত পদ্মা নদী এখন পুরোই পানিশূন্য। বালুর স্তরে স্তরে আটকে আছে মাঝিদের নৌকা। শুষ্ক মৌসুম শুরুর আগেই কাঠ হয়ে গেছে। দিনে দিনে অপার সৌন্দর্য হারিয়ে এখন পদ্মা যেন ঠেকেছে মরুভূমিতে। অনেক আগেই শুকিয়ে গেছে রাজশাহীসহ বরেন্দ্র অঞ্চলের খাল-বিল, নালা। একইসঙ্গে ভূগর্ভস্ত পানির স্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে। পদ্মায় পানি শূণ্যের প্রভাবে গভীর নলকূপেও ঠিকমতো মিলছে না পানি। শঙ্কা দেখা দিয়েছে সেচ ও পানীয় জলের সঙ্কট। পদ্মা শুকিয়ে কাঠ হওয়ায় এরই মধ্যে মৎস্য সম্পদ ও পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। সম্প্রতি রাজশাহীর অংশে পদ্মা নদীতে গিয়ে দেখা গেছে যেন রূপ পাল্টানো অন্য পদ্মা। কোথাও পানি নেই। যতদূর চোখ যায় শুধু বালুরাশি। ওপারের চরের মানুষ দীর্ঘপথ মাড়িয়ে পায়ে হেটে আসছেন এপারে। ওপারের মালামাল আসছে পদ্মার বুক চিরে গরু মহিষের গাড়িতে করে। কোথাও কোথাও শিশুদের ক্রিকেট খেলার দৃশ্যও দেখা যায়। হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি মাহবুব সিদ্দিকীর গবেষণা গ্রন্থ ‘ফিরিয়ে দাও সেই প্রবাহ’তে শাসনের নামে মুছে ফেলা রাজশাহীর সাতটি নদীর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। নদীর অববাহিকার মানুষের জীবনযাত্রা এবং গড়ে ওঠা নদীকেন্দ্রিক সভ্যতার পরিচয়ও এতে সন্নিবেশিত হয়েছে। নদীগুলো হচ্ছে নারদ, সন্ধ্যা, স্বরমঙ্গলা, দয়া, বারাহী, হোজা ও মুসা খাঁন। সবকটি নদীর উৎসমুখ রাজশাহীতে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে ভারতের গঙ্গা থেকে পানি প্রত্যাহারের রাজশাহীর পদ্মা নদীর এই শাখা-প্রশাখা নদীগুলোর মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাস্তবেও মিলেছে এমন চিত্র। অস্তিত্ব মিলেনি ওই সব নদীর। নদী গবেষকরদের মতে ১৯৮৫ সালে বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে পদ্মার তীর দিয়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হয়। তখন নগরীর বুলনপুর এলাকা থেকে তালাইমারী পর্যন্ত ১২টি স্লুইস গেট নির্মাণ করা হয়। নদীগুলোর উৎসমুখেও এই গেট বসানো হয়। এরপর থেকে ধীরে ধীরে নদীগুলোর উৎসমুখ মরে যেতে থাকে। পরবর্তীতে পদ্মা পানিহীন হয়ে পড়লে ওই সাত নদীর চূড়ান্তভাবে মৃত্যু ঘটে। এক পর্যায়ে নদীর পরিচয় হারিয়ে যায়। মানুষ ভুলে যায় নদীর নাম। রাজশাহী নগরীর তালাইমারী এলাকায় ছিল স্বরমঙ্গলা নদীর উৎসমুখ। খরস্রোতা এই নদীটি নগরীর কাজলা-জামালপুর ও নামোভদ্রা এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হতো। এই জামালপুর মৌজায় পড়েছে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট)। রুয়েট ক্যাম্পাসের উত্তর-পূর্ব অংশ এখনও নাওডোবা নামে পরিচিত। হারিয়ে যাওয়া নদীগুলোর মধ্যে নারদ ঐতিহাসিক নদ। এর মোট তিনটি প্রবাহ ছিল। প্রথম প্রবাহ রাজশাহীতে, দ্বিতীয় এবং তৃতীয়টি নাটোরে। রাজশাহী শহর থেকে ৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে শাহপুর গ্রামে পদ্মা নদী থেকে এটির উৎপত্তি। নারদের তৃতীয় প্রবাহটি নাটোরের বাগাতিপাড়ার আটঘরিয়া গ্রামের নন্দকুজা নদী থেকে উৎপত্তি লাভ করে ১৫ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে নাটোরের ধরাইল গ্রামে নারদের দ্বিতীয় প্রবাহে মিলিত হয়েছে। এই নদী রাজশাহীর প্রায় ৩৫ কিলোমিটার প্রবাহ পথে পাঁচটি নীলকুঠি ছিল। বর্তমানে এর উৎসমুখসহ প্রায় ১৫ কিলোমিটার অংশ সম্পূর্ণ বেদখল হয়ে ফসলি মাঠ ও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। বাকি অংশ এখনও নদীর আদলে মৃতপ্রায়। নদীর এই অংশ স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখলে নিয়ে দিঘিতে রূপান্তর করে মাছ চাষ করছে। এদিকে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোকলেছুর রহমান জানান, রাজশাহী পানি বিজ্ঞান উপবিভাগের আওতায় থাকা রাজশাহী বিভাগের ১৩টি প্রধান নদীর মধ্যে ১১টি নদীর তলদেশ শুকিয়ে গেছে। এগুলোতে এখন পানির কোন প্রবাহ নেই। এই নদীগুলো হলো রাজশাহীর বারনই, বাগমারার ফকিরনী, নাটোরের সিংড়ার গুর নদী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটের পাগলা নদী, রহনপুরের পুনর্ভবা নদী, নওগাঁর ছোট যমুনা, নওগাঁর আত্রাই নদী, সারিয়াকান্দির বাঙালী নদী, বগুড়ার করতোয়া, নাগর নদ ও সোনামুখীর তুলসীগঙ্গা নদী। সামান্য পানিপ্রবাহ রয়েছে বগুড়ার মথুরাপাড়া দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, রাজশাহীর পদ্মা এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দা নদীতে। তবে এদের শাখা নদীগুলো শুকিয়ে গেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন, নদীর ধর্মই হচ্ছে পরিবর্তন। নদীর গতিপথ পরিবর্তনই হচ্ছে তার বৈশিষ্ট্য। সেদিক থেকে বলা যায়, নদী সবসময়ই তার গতিপথ পরিবর্তন করে। এখন যেমন শহর থেকে নদীর গতিপথ সরে যাচ্ছে। শহরের পাশেই বড় বড় চর পড়ছে। তার ঠিক উল্টোটা ঘটছে নদীর ওই পাশে। নদীর ওই পাশে চর খানপুর ও চর খিদিরপুরে ভাঙন হচ্ছে। ভাঙতে ভাঙতে ওই পাশে বিলীনের পথে। ফলে পানির প্রবাহ ঠিক থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। পানির প্রবাহ ঠিক না থাকলে এই রকম ভাঙ্গা-গড়া চলতেই থাকবে। আর আমরা প্রতিনিয়ত দূরাবস্থার সম্মুখীন হবো। এজন্য পানির প্রবাহ বাড়াতে হবে। আর এই হিসাবটাও করতে হবে পুরো গঙ্গা রিভার বেসিন অনুযায়ী। শুধু ফারাক্কা থেকে কত কিউসেক পানি আসছে, তার ওপর বিষয়টা নির্ভর করে না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমেছে। আবার পদ্মায় পানির প্রবাহ ঠিকমতো না থাকায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপও পড়ছে। ফলে পানির লেভেল নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। এর ফলে ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে যদি ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা বাড়তেই থাকে, তাহলে এক সময় মরুকরণের দিক ধাবিত হতে পারে এই অঞ্চল। তাই এখনই পদ্মার পানির প্রবাহ নিশ্চিতের কোন বিকল্প নেই। তবে এত হতাশার মধ্যেই রাজশাহীর পদ্মা নিয়ে সুখবর দিয়েছেন রাজশাহী সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। রাজশাহীতে নদীবন্দর করতে আগ্রহী হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী-জানিয়ে মেয়র লিটন বলেন গত ৩ মার্চ রাজশাহী সেনানিবাসে আলাপচারিতার সময় প্রধানমন্ত্রী এ আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে সম্প্রতি মেয়র লিটন জানিয়েছেন আগামীতে পদ্মা নদীতে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করার পরিকল্পনা রয়েছে। তাহলে রাজশাহীতে আন্তর্জাতিকমানের নদীবন্দর করা সম্ভব হবে। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশরনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, আমার দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা রাজশাহীতে আন্তর্জাতিক নদীবন্দর গড়ে তোলা। রাজশাহীর পাশেই যেহেতু ভারত, তাই এখানে নদীবন্দর হলে ভারতে পণ্য আমদানি-রফতানি সহজ হবে। রাজশাহীতে শিল্পায়ন গড়ে তোলাও সহজ হবে।
×