ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

জেব্রা ক্রসিং!

প্রকাশিত: ০৯:১২, ২৪ মার্চ ২০১৯

জেব্রা ক্রসিং!

হিংস্রতা, বন্যতা, ক্রুরতা নেই তার মধ্যে। নিরহঙ্কারী, কোমলতায় পূর্ণ উঁচু গলার অধিকারী নিরীহ প্রাণী বৈকি। সব প্রাণীর চেয়ে কয়েকগুণ উঁচু যার গলা, তা নিয়ে অহঙ্কারী হওয়ারই কথা। কিন্তু সে তা নয়। হেলেদুলে চলতেই বুঝি লাগে ভাল তার। সাদা-কালো ডোরা গায়ের রং তাকে অন্যরকম সৌন্দর্যের মধ্যে আপ্লুত করে। প্রাণীদের মধ্যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে এই বিশ্বভুবনের অরণ্যে, চিড়িয়াখানায় বসবাস করে আসছে যুগ-যুগান্তর ধরে। সেই জেব্রার গায়ের রং হয়ে আছে নিরাপদ পারাপারের প্রতীক। মানুষ তথা পথচারী সড়ক পারাপারে তার গায়ের রঙে চিহ্নিত ‘ক্রসিং’ ধরে পার হয়। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য বিভাগ ও জেলা সদরে পথচারী পারাপারে যে চিহ্নটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে, তার নাম ‘জেব্রা ক্রসিং’। আর তা পাড়ি দেয়ারও আছে নিয়মকানুন বা বিধিবিধান। তা মেনে চলা পথচারীর দায়িত্ব। কিন্তু বাংলাদেশে আইন মানার প্রতি কারও তেমন গরজ দেখা যায় না। বিধিবিধান, নিয়মকানুনও নয়। আইন বা নিয়মনীতি ভাঙ্গার মধ্যেই যেন আত্মগৌরব বা আত্মতৃপ্তি অনেকের। উন্নত ও সভ্য দেশে পথচারীদের রাস্তা পারাপারের সবচেয়ে আধুনিক, নিরাপদ এবং সহজসাধ্য পথ হচ্ছে জেব্রা ক্রসিং। রাস্তার সাদা-কালো ডোরা চিহ্নিত স্থান দিয়ে বয়সী এবং প্রতিবন্ধীরাও সহজে সড়ক পারাপার হতে পারেন। বাংলাদেশে জেব্রা ক্রসিং চালু হয়েছে ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে। স্বাধীনতার পর রাজধানী ঢাকার ব্যস্ত সড়কগুলোতে পথচারী পারাপারের জন্য কর্তৃপক্ষ তা চালু করে। চার দশকের বেশি সময়ে পথচারীর কাছে তা গুরুত্ববহ হয়ে উঠলেও নিয়মনীতির ‘থোড়াই কেয়ার’ করে যেমন যানবাহন, তেমনি পথচারী। খোদ রাজধানীতেই জেব্রা ক্রসিংয়ের অবস্থা বেহাল। পারাপারের নিয়ম মানে না সংশ্লিষ্টরা। পথচারীরা পারাপারের সময়েও চালক যানবাহন না থামিয়েই দ্রুত চলে যায়। অনেক সময় জেব্রা ক্রসিংয়ে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী তোলা হয় যানবাহনে। আর সদ্য বিকশিত মোটরসাইকেল চালকরাও মানে না জেব্রা ক্রসিংয়ের নিয়মনীতি। কোন গুরুত্বই বহন করে না তাদের কাছে পথচারী পারাপারের এই পদ্ধতি। জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পারাপার বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। অথচ বলা হয়, নিরাপদে সড়ক পাড়ি দেয়ার জন্যই এই ক্রসিং। ক’দিন আগে রাজধানীর প্রগতি সরণিতে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে সম্পূর্ণ আইন মেনে রাস্তা পার হওয়ার সময় দুই বাসের পাল্লাপাল্লিতে প্রাণ হারান বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরী। এ ঘটনায় মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে, যার রেশ চলেছে সড়কজুড়ে। নিরাপদে সড়ক পাড়ি দেয়াও আর নিরাপদ নয়। বেপরোয়া চালক সেখানেও কেড়ে নিতে পারে যে কোন সময় যে কারও প্রাণ। অথচ বিধি অনুযায়ী জেব্রা ক্রসিংয়ের আগে থামবে বাস, ওপরে নয়। এসব মানতে কার্পণ্য করা হচ্ছে বহুকাল ধরেই। এ ঘটনা আবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, পথচারী কত বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতিতে পারাপার হয়। প্রশ্ন উঠতেই পারে, তবে পথচারী পারাপার হবে কীভাবে। পদচারী সেতু বা ফুট ওভারব্রিজ কি এর একমাত্র সমাধান? কিন্তু দেখা গেছে, এসব সেতু যেভাবে নির্মিত হয়েছে, তা অত্যন্ত সেকেলে। এটা তো সর্বজনবিদিত যে, জেব্রা ক্রসিং কার্যক্রমের একটি অন্যতম শর্ত হলো সিগন্যাল সিস্টেম ঠিক রাখা। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, এই পদ্ধতি এখনও ঠিক করা সম্ভব হয়নি। হাতের ইশারায় পথ চলতে হয়। এতে পথচারী ও চালকের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে। ট্রাফিক শৃঙ্খলা পরিচালনার দায়িত্বে যারা, তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে দুর্বলতার কারণে দুর্ঘটনা ঘটলেও দায় চাপানো হচ্ছে অন্যের ওপর। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সিদ্ধান্ত নেয়ার ঘাটতি ও দুর্বলতা নীতিনির্ধারকদের। এর সঙ্গে সাধারণ পথচারী ও চালকদের কোন সম্পর্ক নেই। রাস্তা চলতে এই মহানগরীতে মনে হয় কেউ কিছু জানে না। তাই জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ গ্রহণও জরুরী। সেইসঙ্গে ট্রাফিক পদ্ধতির ত্রুটি সারানোর বিকল্প নেই।
×