ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

কোল্লা পাথরের করিম ভাই

প্রকাশিত: ০৯:২০, ২৪ মার্চ ২০১৯

কোল্লা পাথরের করিম ভাই

এ যেন হুমায়ূন আহমেদের সেই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক-এর বাস্তবায়ন! যেই নাটকে একজন মানুষ যার জীবনের একমাত্র ব্রত ছিল সারাদেশ ঘুরে নাম না জানা মুক্তিযোদ্ধাদের করর সংরক্ষণ করা। ১৯৯৪ সালে মুক্তিযোদ্ধা মেজর আখতারের বই ‘বার বার ফিরে যাই’-এ প্রথম জানতে পারি ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলায় অবস্থিত এই ‘কোল্লা পাথর’, দেশের একমাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিক্ষেত্রের কথা। কিন্তু যাই যাই করে আর যাওয়া হয়ে উঠে না। তাই মনে হলো, এইবার না গেলে আর জীবনে হয়তো যাওয়া হবে না। ‘বার বার ফিরে যাই’ এর তথ্য অনুযায়ী সমাধিক্ষেত্রটি আজমপুর রেলস্টেশনের কাছেই, এই তথ্য ছাড়া আর কিছুই মনে ছিল না। তবে আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে, পথের মানুষদের জিজ্ঞেস করে, আমরা সহজেই দেশের একমাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিক্ষেত্র খুঁজে বের করতে পারব। অত্যন্ত দুঃখজনক যে, বাস্তবে এই ‘কোল্লা পাথর’ সমাধিক্ষেত্রটি খুঁজে বের করতে আমাদের বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। আশপাশের অনেকেরই কোন ধারণা নেই এর অবস্থান সম্পর্কে! এই ‘কোল্লা পাথর’ সমাধিক্ষেত্রটি সালদা নদী রেলস্টেশনের খুব কাছেই অবস্থিত। এই সমাধি ক্ষেত্রে শহীদ মানিক বীর প্রতীক, সুবেদার বেলায়েত বীর উত্তম, নায়েক সুবেদার মইনুল হোসেন বীর উত্তম যার নামে মইনুল রোড, প্রকৌশলী নজরুল ইসলামসহ পঞ্চাশজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কবর রয়েছে। এই ‘কোল্লা পাথর’, সমাধিক্ষেত্রের কাছেই সংরক্ষিত রয়েছে সন্মুখযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থান। ১৯৭১ সালে এখানেই সংঘটিত হয়েছিল অনেক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। তেমনি এক সন্মুখযুদ্ধে পাকিস্তানী বাঙ্কার ধ্বংস করার পর সালদা নদী সাঁতরে পার হয়ে সুবেদার বেলায়েত বীর উত্তমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা এই স্থানটি দখল করেন। কয়েকশ মিটার দূরে। সালদা নদীর অন্য পারেই ভারত, যেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্ত পার হয়ে প্রতিনিয়ত আক্রমণ চালাত বর্বর পাকিস্তানী বাহিনীর ওপর। সেই যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন তৎকালীন ক্যাপ্টেন গাফফার বীর উত্তম। কিছুদিন পরেই এই সালদা নদীর আরেক যুদ্ধে শহীদ হন সুবেদার বেলায়েত বীর উত্তম আর মারাত্মকভাবে আহত হন মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে কুশলী সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম। আর ১৯৭১ সালে এই অসাধ্য সাধন করেছিলেন, করিম নামের এক ২৫ বছরের এক বীর মুক্তিযোদ্ধা! জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজের জমিতে প্রতিটি কবর তিনি চিহ্নিত করে রেখাছিলেন সেই সময়, আর তারই ফলশ্রুতিতে আজ আমরা পেয়েছি এই মহান বীরদের শেষ ঠিকানা। আমাদের দেশে যখন সরকারী জমি আর নদী দখলের প্রতিযোগিতা চলছে, তখন কল্পনা করতেও কষ্ট হয় যেÑ এই দেশে করিম ভাইয়ের মতো (অ)সাধারণ (মহা)মানুষরা নিজের পৈতৃক জমি থেকে প্রায় এক বিঘার বেশি জমি শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি রক্ষার্থে ‘দান’ করে দিয়েছেন। সত্যিই কি বিচিত্র এই দেশ! হুমায়ূন আহমেদের সেই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক রচনা এবং প্রচারের প্রায় চার দশক আগেই করিম ভাই একাই সেই অসাধ্য সাধন করে গেছেন এবং এই বয়সেও করে যাচ্ছেন। তার এই মহৎ কাজের সঙ্গে আছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ গবেষক’ লে. কর্নেল সাজ্জাদ জহির বীর প্রতীক। আসুন, আমরাও করিম ভাইয়ের পদরেখা অনুসরণ করি এবং সাধ্যমতো ইতিহাসের দায়ভার কিছুটা হলেও লাঘব করি। প্রতি বছর সরকার ‘একুশে পদক’ এবং ‘স্বাধীনতা পদক’ প্রদান করে থাকেন, জাতীয় ক্ষেত্রে এবং মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য। আমার মতো আরও অনেকেই মনে করেন যে, ‘একুশে পদক’ বা ‘স্বাধীনতা পদক’ কোল্লা পাথরের করিম ভাই’ এর অনেক আগেই প্রাপ্য। লেখক : প্রকৌশলী এবং মুক্তিযুদ্ধ গবেষক [email protected]
×