ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

অগ্নিঝরা মার্চ

প্রকাশিত: ১১:০৩, ২৪ মার্চ ২০১৯

অগ্নিঝরা মার্চ

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ অসহযোগ আন্দোলনের ২৪তম দিনে যথারীতি বিক্ষুব্ধ মিছিলে মিছিলে উত্তাল শহরের রাজপথগুলো। বঙ্গবন্ধু তাদের উদ্দেশে বলেন, আমার মাথা কেনার শক্তি কারো নেই। বাংলার মানুষের সঙ্গে, শহীদের রক্তের সঙ্গে আমি বেইমানি করতে পারব না। আমি কঠোরতর নির্দেশ দেয়ার জন্য বেঁচে থাকব কিনা জানি না। দাবি আদায়ের জন্য আপনারা সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন। সংবাদমাধ্যমকেও একই কথা বলেন। এরপর তিনি কোথায় থাকবেন তা না জানলেও সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। ঢাকার বাইরে পাক বাহিনীর এরিয়া কমান্ডাররা গণহত্যার তা-বলীলা শুরু করে দেয়। মুজিব-ইয়াহিয়ার বৈঠক বাতিল করা হয় এবং ধীরে ধীরে পাকিস্তানি নেতারা করাচির বিমান ধরা শুরু করেন, যা সম্পর্কে সিদ্দিক সালিক বলেন ধং রিংব নরৎফং ভষবব ঃড় ঃযবরৎ হবংঃং নবভড়ৎব ঃযব পড়সরহম ংঃড়ৎস। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সমাগত বিভিন্ন মিছিলকারীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় বিরামহীনভাবে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, আর আলোচনা নয়, এবার ঘোষণা চাই। তিনি বলেন, আগামীকালের মধ্যে সমস্যার কোন সমাধান না হলে বাঙালীরা নিজেদের পথ নিজেরা বেছে নেবে। আমরা সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। কোন ষড়যন্ত্রই আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। সরকারের প্রতি তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, বাংলার জনগণের ওপর কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হলে তা বরদাস্ত করা হবে না। ২৩ মার্চ রাত থেকে ২৪ মার্চ সকাল পর্যন্ত পাক সেনাবাহিনী সৈয়দপুর সেনানিবাসের পার্শ্ববর্তী বোতলাগাড়ী, গোলাহাট ও কুন্দুল গ্রাম ঘেরাও করে অবাঙালীদের সঙ্গে নিয়ে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। এতে ১০০ জন নিহত হয় এবং ১০০০ জনের বেশি মানুষ আহত হয়। শহরে কারফিউ দিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্য এবং অবাঙালীরা সম্মিলিতভাবে বাঙালীদের বাড়িঘরে আগুন দেয় এবং হত্যাকা- চালায়। রংপুর হাসপাতালের সামনে ক্ষুব্ধ জনতা ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে পাকসেনারা রংপুর সেনানিবাস সংলগ্ন এলাকায় নিরস্ত্র অধিবাসীদের ওপর বেপরোয়াভাবে গুলিবর্ষণ করে। এতে কমপক্ষে ৫০ জন নিহত এবং বহু আহত হয়। চট্টগ্রামে পাক সেনারা নৌবন্দরের ১৭নং জেটিতে নোঙর করা এমভি সোয়াত জাহাজ থেকে সমরাস্ত্র খালাস করতে গেলে প্রায় ৫০ হাজার বীর বাঙালী তাদের ঘিরে ফেলে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা জাহাজ থেকে কিছু অস্ত্র নিজেরাই খালাস করে ১২টি ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়ার সময় জনতা গতিরোধ করে। সেনাবাহিনী ব্যারিকেড রচনাকারী জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালালে ২০০ জন শ্রমিক শহীদ হন। জরুরী বৈঠকের কথা বলে লে. জে. টিক্কা খান দুপুরবেলা হেলিকপ্টারে চট্টগ্রাম থেকে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে ঢাকায় সরিয়ে নিয়ে আসেন। সঙ্গে ছিলেন ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরী। তাদের সেনানিবাসে বন্দী করে রাখা হয়। এটা ছিল মূলত অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনার সঙ্গেই সম্পৃক্ত। ইতোমধ্যে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর গণহত্যার নীলনক্সা সমাপ্তির পথে। শেষ আঁচড়ের কাজ চলছে ইস্টার্ন সদর দফতরে। ঢাকার বাইরে হত্যালীলা শুরু করে দেয় পাকবাহিনীর এরিয়া কমান্ডাররা। সৈয়দপুরে পাকসেনা ও অবাঙালী বিহারিরা যৌথভাবে গণহত্যা শুরু করে। দিনের প্রথমভাগের মধ্যেই রংপুরে পাকসেনাদের কয়েকটি হেলিকপ্টার অবতরণ করে। সেখানে ব্রিগেড কমান্ডারের বাসভবনে গোপন শলাপরামর্শ করে মেজর জেনারেল জানজুয়া, মেজর জেনারেল মিঠঠা খান প্রমুখ। মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা এবং রাও ফরমান আলী দুটি হেলিকপ্টারে চড়ে সবক’টি সেনানিবাসে গিয়ে ব্রিগেড কমান্ডারদের নীলনক্সা সম্পর্কে নির্দেশনা প্রদান করেন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিমানপথে আরও দুই ডিভিশন সেনা ও যুদ্ধরসদ আসছে। মিরপুরে অবাঙালীরা সাদা পোশাকধারী পাকসেনাবাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতায় বাঙালীদের বাড়িঘরের শীর্ষে ওড়ানো বাংলাদেশের পতাকা এবং কালো পতাকা নামিয়ে জোর করে তাতে আগুন দেয় এবং পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলন করে। রাতে বিহারিরা সেখানে ব্যাপক বোমাবাজি করে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। যশোরে পূর্ব-পাকিস্তান রাইফেলসের হেডকোয়ার্টার্সে জওয়ানরা জয় বাংলা বাংলার জয় গান গেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন এবং পতাকাকে অভিবাদন জানান। এদিন ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক বাতিল হয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট-ভবনে প্রস্তাবিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের নতুন নাম নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ড. কামাল হোসেন রাষ্ট্রের নাম কনফেডারেশন অব পাকিস্তান নামকরণের প্রস্তাব পেশ করেন। সরকারী দলের বিচারপতি কর্নেল গিয়াস কনফেডারেশনের স্থলে ইউনিয়ন শব্দটি ব্যবহারের প্রস্তাব দেন। বিভিন্ন প্রস্তাব উত্থাপন শেষে লে. জে. পীরজাদা টেলিফোনে পরবর্তী বৈঠকের সময় ধার্য এবং তখন নাম নিয়ে কথা বলা হবে বলে জানান। কিন্তু সে টেলিফোন আর আসেনি। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবকে বিদায় জানিয়ে করাচি ফিরে যান। সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আওয়ামী লীগ ও সরকারের মধ্যে উপদেষ্টা পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন উপস্থিত ছিলেন। দুঘণ্টা স্থায়ী বৈঠক শেষে তাজউদ্দীন আহমেদ উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বক্তব্য প্রদান শেষ হয়েছে। এখন প্রেসিডেন্টের উচিত তার ঘোষণা দেয়া। তিনি বলেন, আজ প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, আলোচনা অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে না। আওয়ামী লীগ আলোচনা আর দীর্ঘায়িত করতে প্রস্তুত নয়। পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো দুপুরে প্রেসিডেন্ট ভবনে জেনারেল ইয়াহিয়া ও তার উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। তিনি বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি অত্যন্ত করুণও দুর্ভাগ্যজনক। এ অঞ্চলের শোষিত জনগণের প্রতি আমার অনেক ভালবাসা রয়েছে। আমি তাদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করছি। কিন্তু আমার একটি জাতীয় দায়িত্ব রয়েছে। আমি পাকিস্তান অখ- রাখার জন্য জীবন দান করতে প্রস্তুত। টিভি কেন্দ্রে প্রহরারত সৈন্যরা টিভি কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে সন্ধ্যা থেকে ঢাকা টিভির কর্মীরা সব ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার থেকে বিরত থাকেন। স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশে সশস্ত্র গণবিপ্লবকে আরও জোরদার করার জন্য সংগ্রামী বাংলার জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। সাংবাদিকরা এক জরুরী সভায় মিলিত হয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সেনাবাহিনীর সদস্যদের হয়রানিমূলক আচরণের তীব্র নিন্দা জানান। চট্টগ্রাম জেলা সংগ্রাম কমিটি রাত দশটায় জনাব এম আর সিদ্দিকীর বাসায় বৈঠককালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের এক জরুরী বার্তা এসে পৌঁছে। বার্তার মূল বিষয়বস্তু ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন ও প্রতিরোধ গড়ে তোল।
×