ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দশ কীর্তিমান নারীকে অনন্যা শীর্ষদশ সম্মাননা প্রদান

প্রকাশিত: ১১:১১, ২৪ মার্চ ২০১৯

দশ কীর্তিমান নারীকে অনন্যা শীর্ষদশ সম্মাননা প্রদান

স্টাফ রিপোর্টার ॥ কুড়িগ্রামের অভাবী সংসারের মেয়ে ফাতেমা খাতুন। দারিদ্র্যের কশাঘাতে নয় বছর বয়সেই বন্ধ হয়ে লেখাপড়া। পরিবারের অভাব মেটাতে বাসাবাড়ি গৃহকর্মীর কাজ শুরু করে ফাতেমা। আর মাত্র ১১ বছর বয়সে তার বিয়ে ঠিক করে পরিবার। স্থানীয় আশার আলো পাঠশালা কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে প- করে দেয়া হয় সেই বাল্যবিয়ে। এদিকে ফাতেমার লেখাপড়ার দায়িত্ব নেয় পাঠশালা। সে স্কুলেই মাইক্রোসফটের বাংলাদেশ শাখার পরিচালক সোনিয়া কবিরের সঙ্গে পরিচয় হয় ফাতেমার। পাঠশালাটিতে কম্পিউটার ল্যাব করে দেয় মাইক্রোসফট। সেই ল্যাবেই তথ্যপ্রযুক্তির নানা বিষয়ে পারদর্শী হয়ে ওঠে ফাতেমা। বদলে যায় তার জীবন। একপর্যায়ে গৃহকর্মী থেকে মাইক্রোসফটের ব্র্যান্ড এ্যাম্বাসেডর হিসেবে মনোনীত হয় ফাতেমা। সংগ্রামী জীবনের এই কিশোরী পেলেন অনন্যা শীর্ষদশ সম্মাননা। পুরুষশাসিত সমাজের শত প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে ক্রমাগত এগিয়ে চলা এমন আরও নয় কীর্তিমান নারীকে প্রদান করা হলো পাক্ষিক অনন্যা প্রবর্তিত এই সম্মাননা। অজ¯্র বাধার কাছে অপ্রতিরোধ্য আলোচিত এই নারীরা প্রত্যেকেই সমাজের নানা ক্ষেত্রে ছড়াচ্ছেন উজ্জ্বলতা। ২০১৮ সালের সম্মাননাপ্রাপ্ত নারীরা হলেন ডাঃ সায়েবা আক্তার (চিকিৎসা), পারভীন মাহমুদ (ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন), এসপি শামসুন্নাহার (প্রশাসন), আফরোজা খান (উদ্যোক্তা), সোনা রানী রায় (কুটিরশিল্প), লাইলী বেগম (সাংবাদিকতা), নাজমুন নাহার (তারুণ্যের আইকন), সুইটি দাস চৌধুরী (নৃত্যশিল্পী), রুমানা আহমেদ (খেলা) ও ফাতেমা খাতুন (প্রযুক্তি)। শনিবার বিকেলে জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে এ সম্মাননা প্রদান করা হয়। নারী অধিকার আদায়ে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে অনুষ্ঠানে সম্মাননাপ্রাপ্ত কীর্তিমান নারীসহ অতিথিরা বলেন, সমাজের বাধা পেরিয়ে নারীর অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে। কিন্তু এখনও অনেক পথ বাকি। যারা ‘অনন্যা’ হয়েছেন তাদের অনুসরণ করে সমাজের প্রতিটি স্তরে নারীরা ‘অনন্যা’ হয়ে উঠবেন, সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের আলোর পথ দেখাবেন। সম্মাননাপ্রাপ্ত কীর্তি নারীদের উত্তরীয় পরিয়ে দেয়ার পাশাপাশি প্রদান করা স্মারক ও সনদপত্র। সম্মাননা তুলে দেন বরেণ্য অভিনয়শিল্পী ও সংসদ সদস্য সুবর্ণা মুস্তাফা এবং সাবেক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সাদেক এমপি। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা ও সভাপতিত্ব করেন অনন্যা সম্পাদক ও প্রকাশক তাসমিমা হোসেন। কথাশিল্পী ঝর্না রহমানের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানের শুরুতেই সাধনার নৃত্যশিল্পী সুইটি দাস ও তার দল মনিপুরী নৃত্য পরিবেশন করে। এরপর এবারের সম্মানিত দশজন নারীর ওপর নির্মিত তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়। তবে বিশেষ কারণে অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি ড. সায়েবা আক্তার ও শামসুন্নাহার। তাদের পক্ষে পরিবারের সদস্যরা এ সম্মাননা গ্রহণ করেন। অনুভূতি প্রকাশে ক্রিকেটার রুমানা আহমেদ বলেন, ক্রিকেটে আমরা নারী ও পুরুষ আমরা সমানভাবেই এগিয়ে যেতে চাই। আমরা হয়তো পুরুষ দলের মতো শক্তিশালী হইনি। কিন্তু এশিয়া কাপ জয় করে আমরাও দেখিয়ে দিয়েছি। আমরা সবাই দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছিÑ এটাই গৌরবের। পুরুষ ক্রিকেটারদের তুলনায় আমাদের সম্মানী অনেক কম দেয়া হলেও ভবিষ্যতে হয়তো সেটাও ভারসাম্যপূর্ণ হবে। পারভীন মাহমুদ বলেন, নারীর জন্য, দেশের যে কোন উন্নয়নমূলক কর্মকা-ে আমি কাজ করার চেষ্টা করেছি। পড়াশোনায় আমার ৭-৮ বছরের গ্যাপ ছিল। কিন্তু আমি আমি আমার লক্ষ্য থেকে সরে যাইনি। এ পথে আমার পরিবার আমার শাশুড়ি খুব সহযোগিতা করেছেন। আমি যেন আগামীতেও কাজ করতে চাই। একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ সৃষ্টিতে সবাই মিলে যেন এগিয়ে যেতে পারি। উদ্যোক্তা আফরোজা খান বলেন, আমি দুপরে অফিসে খাবার সাপ্লাই দিচ্ছি। এক দেড় বছরের মধ্যেই মানুষের বিপুল সাড়া পেেেয়ছি। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার দেয়ার ক্ষেত্রে বিশ^মান নিশ্চিত করা খুব কঠিন। কিন্তুও আমি সেই বিশ^মান নিশ্চিত করেছি। নাজমুন নাহার বলেন, আমি কৃতজ্ঞ সৃষ্টিকর্তার প্রতি যারা আমাকে এই সুন্দর পৃথিবী দেখা হতো না। নাজমুন নাহার ১২৫টি দেশ ঘুরেছি। স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যে বিশে^র দুইশটি দেশ ভ্রমণের প্রত্যাশা রয়েছে। আত্মপ্রত্যয় থাকলে পৃথিবী যেমন জয় করা সম্ভব তেমনি অনন্যা পুরস্কারও জয় করা সম্ভব। নৃত্যশিল্পী সুইটি দাস চৌধুরী বলেন, শিল্পীরা চর্চা করেন শিল্পকে ভালবেসে। কোন কিছু পাওয়ার আশায় নয়। সেই কাজের জন্য এ পুরস্কার পাওয়া আমার জন্য অনেক বড় সম্মান। সাংবাদিক লাইলী বেগম বলেন, নারী সাংবাদিক হওয়ার কথা ছিল না। প্রয়োজনের টানে আমি কাজ শুরু করি। কিন্তু নানা কাজ করে আমি সাংবাদিকতা শুরু করি। মফস্বলে মেয়েদের সাংবাদিকতা করা খুব কঠিন। কিন্তু আমি সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছি। তাসমিমা হোসেন বলেন, দেশে নারী ব্যক্তিত্ব যাদের এখন সমাজে নানা ভূমিকা রাখতে দেখা যায় তাদের প্রায় বেশিরভাগ নারীকেই প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছে অনন্যা। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, নারীদের প্রতি অনাচারের কথা নারীদেরই বলতে হবে। দাবি না তুললে, কথা না বললে সমাজ থেকে অন্ধকার দূর হবে না। এখনও সময়টা নারীদের জন্য খুব অনুকূল নয়। যৌন নিগ্রহ সমাজ থেকে এখনো দূর করা যায়নি। উগ্র মৌলবাদীরা নারীর অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। নিজেদের বঞ্চনার কথা বলতে এখনও মেয়েরা ভয় পায়। বর্তমান সরকার নারীবান্ধব সরকার। সরকারও নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান সুসংহত করতে নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে। সমাজের বাধা পেরিয়ে নারীর অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে। কিন্তু এখনও অনেক পথ বাকি।
×