ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তিযুদ্ধে রংপুর এবং আমার সহপাঠী শহীদ মুখতার ইলাহী

প্রকাশিত: ০৮:৫৩, ২৫ মার্চ ২০১৯

 মুক্তিযুদ্ধে রংপুর এবং আমার সহপাঠী শহীদ মুখতার ইলাহী

বাংলার মুক্তি সংগ্রামের উত্তাল দিনের পূর্বে বিগত শতাব্দীতেও রংপুরের ইতিহাস ছিল দ্রোহ ও বিপ্লবের। যার পাতা ওল্টালে দেখা যায়- অসম্প্রদায়ক ঔজ্জ্ব¡ল্যতা নিয়ে এই অঞ্চলে ঘটেছে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, প্রজা বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলনসহ সর্বোপরি স্বদেশী আন্দোলন। রংপুর কন্যা দেবী চৌধুরানীর দস্যুর বেশে বজরায় ভেসে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের কথা আছে বঙ্কিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরানী উপন্যাসে। রংপুরের পার্শ্ববর্তী নবদী গ্রামের নুরলদিনের ‘জাগো বাহে কোনঠে সবাই’- সংগ্রামের কথা লিখে গেছেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। সেই একই পথ ধরে বাংলার ঐতিহাসিক মুক্তি সংগ্রাম প্রকৃতপক্ষে শুরু হয়েছিল রংপুরের মাটি থেকেই একাত্তরের তিন মার্চ তারিখে শহরের প্রধান সড়কে বিশাল মহাতরঙ্গময় মিছিলে বাংলাদেশে প্রথম শহীদ হয়েছে শঙ্কু সমঝদার নামের এক কিশোর এবং আরও দু’জন। আমাদের শহরে এই দিনই জ্বলে ওঠে আগুন এবং প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা হয় সেদিনই। সেদিন থেকেই পাকিস্তানী সেনা দল পুড়িয়ে দিতে থাকে গ্রাম চালাতে থাকে গুলি। তারপরও বাড়িতে বাড়িতে ওঠানো হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা, ঘাঘট নদীর তীর জলছলছল তীরটিতে সূচনা করা হয় এক বধ্যভূমির। ১৯৭১ সালে শুরু থেকে শেষপর্যন্ত রংপুর ছিল এমন এক মুক্তির সোপান তল সেখানে কত যে প্রাণ শহীদ হয়েছে তার হিসাব কতটুকু আছে? বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চ ভাষণে তাই প্রথমেই উল্লেখ করেছিলেন রংপুরের কথা। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সাহেবগঞ্জ, মাহিগঞ্জ, নব্দিগঞ্জ ও সাতগড়াসহ প্রায় ১৫টির মতো বদ্ধভূমি পাওয়া গিয়েছিল। আর জেলার অগণিত শহীদের অন্যতম ছিলেন আমার সহপাঠী রংপুর কারমাইকেল কলেজের ভিপি খন্দকার মুখতার ইলাহী। ওর ডাক নাম ছিল চিনু। বাংলাদেশে ছোট করে চিনু নামে যাকে ডাকে সবাই তার নামটা সাধারণত হতো চিন্ময়- যার অর্থ সৌভাগ্যশালী। মনে পড়ে কারমাইকেল কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের প্রথম দিনের ক্লাস। আর্টস বিল্ডিংয়ের করিডরে দাঁড়িয়ে সদ্য হাই স্কুলের গন্ডি পেরোনো একদঙ্গল কৈশোর উত্তীর্ণ ছেলেমেয়েদের জটলা। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা একসঙ্গে দল বেঁধে নয়- একদিকে ছিল ওরা ছেলেরা অন্যদিকে আমরা মেয়েরা। নগণ্য সংখ্যক হলেও কিছু নবাগত ছাত্রদের বিষয়টা ছিল আলাদা। কলেজ জীবনের প্রথম দিন তাতে আবার কো-এডুকেশন বলে কথা! তাইতেই বুঝি কিছু কিছু ছেলেদের হাবভাবে প্রকাশ হচ্ছিল চিত্তচাঞ্চল্য। ওদের বড়সড় জমায়েত থেকে ভেসে আসছিল কিছু কিছু কমেন্ট। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ মাত্র না করে আমরা ছাত্রী দলটি প্রায় সকলেই অবিচল। ছোটখাটো হলরুমের মতো আর্টসের ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাসরুমের চেহারাটাও স্পষ্ট মনে আছে। চারটি বেঞ্চ নিয়ে পৃথক চারটি সারি ছিল মেয়েদের বসার জন্য। আর ছাত্রদের জন্য বেঞ্চের সংখ্যা ছিল ২০টির কম নয়। তারা ছিল জনা চল্লিশেক। মেয়েদের এবং ছেলেদের সারিগুলো পাশাপাশি ছিল না। ছাত্ররা বসেছিল উত্তর দিকে মুখ করে আর আমাদের মেয়েদের দলটা পুব মুখো হয়ে। তখন আমরা কেউ কেউ পনেরো বা ষোলো কেউ হয়ত আরও কিছু ওপরে। সেই প্রথম ক্লাসেই শিক্ষক তার নিজের পরিচয় দিয়ে রোল কল করা শুরু করলেন। নির্দেশ মতো সবাই এক এক করে দাঁড়িয়ে যে যার নাম জানাতে লাগল। শিক্ষক ছাড়াও সহপাঠীরা সবাই তখন রোলে ও নামে চিনে নিচ্ছিল একে অপরকে। যখন ডাকা হলো ‘থার্টিন’ তখন ক্লাসের সবচেয়ে বাচ্চা দেখতে ছেলেটা উঠে দাঁড়িয়ে নাম জানাল খন্দকার মুখতার ইলাহী। ক্লাসশুদ্ধ ছেলে এমনকি মেয়েরাও ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে কৌতুকের দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ওই বয়সে সবাই যে সংখ্যাকে এড়াতে চায় ও ভাল মানুষ বলেই হয়ত ফেঁসে গেছে সেই তেরো সংখ্যার পাল্লায়। আজ করিডরে দাঁড়িয়ে যে অকাল পক্ব ছেলেগুলো মেয়েদের উদ্দেশে প্রণয় বাণ নিক্ষেপ করছিল- তেরো নম্বর যে তাদের মধ্যে কেউ একজন ছিল না সেটা তখনও কৈশোরের ছাপ লেগে থাকা মুখ দেখে নিশ্চিতভাবে ধারণা করা গিয়েছিল। সেই শুরু থেকে ও যখন তখনকার সুবিখ্যাত কারমাইকেল কলেজের ভিপি সেই সঙ্গে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম ছাত্র নেতা তখন পর্যন্ত ওর ছিল একই আশ্চর্য নিষ্পাপ মুখশ্রী। মনে আছে এরপর ইন্টারমিডিয়েট পাস করে আমরা যখন ব্যাচেলর্স করতে নতুন করে ভর্তি হলাম- মেইন বিল্ডিংয়ে ক্লাস শুরু হলো। মুখতার ব্যাচেলর্স ক্লাসে ভর্তি হয়েছিল ইংরেজী সাহিত্য নিয়ে আমার অনার্স ছিল বাংলা ভাষা সাহিত্যে। ফিলোসোফি সাবসিডিয়ারি ক্লাসটা শুধু ওর সঙ্গে একমাত্র মিল। সেটা ছিল আমাদের প্রথম ফিলোসোফি ক্লাস। অধ্যাপক কলিমুদ্দিন যখন ডাকলেন রোল নম্বর তেরো উঠে দাঁড়ালো মোখতারই। স্যার ছিলেন খুব রসিক মানুষÑ ওকে নতুন করে ১৩ নম্বরে দেখে তিনি অনেক মজা করেছিলেন। আমরা হেসেছিলাম- হয়তও নিজেও। ফার্স্ট ইয়ার সেকেন্ড ইয়ারের জীবনে আমাদের সময় সহপাঠী ছেলেমেয়েদের মধ্যে বলতে গেলে কথা প্রায় হতোই না কখনও। প্রকৃতপক্ষে ক্লাস ছাড়া ওদের সঙ্গে দেখা হতো ক্যাম্পাসের ভেতর কেবল দূর থেকে। মুখতার ও অন্যদের দেখতাম ক্লাসে, কখনও লতাপাতা বৃক্ষ ঘেরা কলেজ প্রাঙ্গণে। তবে সবাই লক্ষ্য করেছি বাকি অধিকাংশ সহপাঠীর তুলনায় ওর ব্যতিক্রমী চলনটি যেন কিছু ভাবুক গোছের কিছু কবিত্বে মাখা। আমাদের মতো না হলেও ক্লাসের বেশিরভাগ সহপাঠী ছেলেরাও ক্যাম্পাসে আড্ডা জমিয়ে গুলজার করত পারিপার্শ্বিকতাকে। কিন্তু ওকে দেখা যেত নোট বই ছাড়া যার হাতে থাকত কোন না কোন বই। এখনও চোখের ওপর ভাসে ঠিক হাতে নয় হাতের বইগুলো বুকের ওপর রেখে স্বপ্নের ভঙ্গিমায় কথা বলতে বলতে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে হাঁটছে। কে জানে কি বই ছিল সেগুলো? তখনকার সিরিয়াস ছাত্রদের মতো ওকি পড়ত চেগুয়েভারা কিংবা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর বিপ্লবী বই? ওর বুকের স্বপ্নের খবর আমরা তখন পাইনি। সেকেন্ড ইয়ারে উঠবার কিছু দিনের মধ্যেই এসেছিল ছাত্র সংসদের নির্বাচন। সংসদে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন ছাত্র সংস্থা নামে একটি দল থেকে খন্দকার মুশতাক ইলাহী। এক্ষেত্রে বলা প্রয়োজন ষাটের দশকের মধ্যভাগ পেরিয়েও আমাদের কলেজে ছাত্র সংসদ জাতীয় রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল না। মুশতাক ইলাহী ছিলেন একদিকে যেমন তুখোড় ছাত্র অন্যদিকে তেমনি অসাধারণ বক্তা। আমাদের রোল নম্বর তেরো মুখতার যে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী স্বনামখ্যাত মুশতাক ইলাহীর ছোট ভাই সে কথা কাউকে বলে দিতে হতো না। নামে তো মিল ছিলই দুই ভাইয়ের চেহারাতেও ছিল আশ্চর্য সাযুজ্য। রংপুরের ধাপ এলাকার সর্বজন পরিচিত মেধাবী ইলাহী পরিবারের ভাইদের মধ্যে চিনু ছিল কনিষ্ঠতম। ওকে প্রথম বর্ষে ক্লাসমেট হিসেবে দেখতে দেখতে তৃতীয় বর্ষে সহপাঠীটি দেখলাম কলেজ ক্যাবিনেটের অন্যতম পদপ্রার্থী হিসেবে। তার প্রার্থিতা ছিল ম্যাগাজিন সেক্রেটারি পদে। ইলেকশনের পোস্টার সাঁটছে প্রাঙ্গণের শিরিষ, দেবদারু ইউক্যালিপটাস বৃক্ষে বৃক্ষে, ঘুরছে নির্বাচনী মিছিলের সঙ্গে। ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হলেন জনপ্রিয় মুশতাক ভাই। পরের বছর আর ম্যাগাজিন সম্পাদক হিসেবে তার অনুজ মুখতারকে নিয়ে সেবার ছাত্র সংস্থা জিতেছিল প্রায় পুরো প্যানেলেই। তার শিক্ষক পিতার পরিবারের সকল পুত্রই ছিলেন কীর্তিমান। কিন্তু চিনুর জীবনের পালস বুঝতে গেলে কারমাইকেল কলেজের তদানীন্তন খ্যাতিমান নেতা মুশতাক ইলাহী সম্পর্কে না জানলে চলবে না। এসএসসি পাস তার এই অগ্রজ প্রথমে ভর্তি হয়েছিলেন মেডিকেল কলেজে। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকদের রাজনৈতিক রোষানল তাকে বহিস্কৃত করেছিল সেখান থেকে। এরপর তিনি কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন বিএসসি ক্লাসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে জুয়োলজিতে মাস্টার্স শেষ করেন। এই ছাত্রত্ব কালে তিনি ছিলেন ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন এফএইচ হলের ভিপি। ‘অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় মাস্টার্স করার সময় থেকে যোগ দেন সাংবাদিকতা পেশায়। শিক্ষা জীবন শেষ করে তিনি কাজ শুরু করেন বাংলার বাণী পত্রিকায়। ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি শেষে সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে থাকেন। ম্যাগাজিন সম্পাদকের পদে বিজয়ী হওয়ার পর আমরা ওকে দেখতাম তখন ওর হাতে আর বই নেই। মুখতারের কাঁধে বই আর ম্যাগাজিনে বোঝাই পরিপূর্ণ এক ঝোলা। সব সময়ই মহাব্যস্ত হয়ে কখনও কখনও সাইকেল নিয়ে ছুটছে কলেজে কিংবা শহর অভিমুখে। আমাদের সময়ের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রিয় অধ্যাপক ছিলেন রেজাউল হক। স্বাধীনতা উত্তরকালে তিনি আপন যোগ্যতা বলে অধিকার করেছিলেন কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ পদ। আমার প্রকাশিত একটি লেখাকে কেন্দ্র করে বহু বছর পর তার সঙ্গে নতুন করে ক’বছর আগে যোগাযোগ হওয়ার পর সুযোগ পেলে টেলিফোনে কথা হয়। আমাদের দু’জনেরই তিনি শিক্ষক। এই মার্চের গত সপ্তাহে জানতে চাইলাম পঞ্চাশ বছরের আগেকার ছাত্র মুখতারকে নিয়ে। -আপনি তো শিক্ষক হিসেবে ওকে অনেক কাছে থেকে দেখেছেন যেটা সহপাঠী হয়েও আমার সুযোগ হয়নি। স্যার বললেন, -হ্যাঁ ও যদিও ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছিল। তবে ল্যাঙ্গুয়েজে হিসেবে বাংলা সাহিত্য নিয়েছিল বলে সে সরাসরি ছাত্র ছিল আমার। মুখতার একদিকে যেমন ছিল সাহিত্যপ্রেমী এবং মেধাবী সঙ্গে পরিশ্রমী। হাতের লেখা ছিল চমৎকার। রেজাউল হক স্যার আরও বললেন, ও যখন ম্যাগাজিন সেক্রেটারি হিসেবে নির্বাচিত হলো অধ্যাপক হিসেবে সেই বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান ছিলাম আমি। কারমাইকেল কলেজের বার্ষিকী প্রকাশে তখনও ছিল সেই পুরনো ঐতিহ্য। সেই উত্তরাধিকার বহন করে ও সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিল অত্যন্ত সচেতনতার সঙ্গে। পুরনো কালের বার্ষিকী থেকে ভাল ভাল লেখাগুলোও তুলে এনেছিল সে বছর। সেবারের কলেজ বার্ষিকীটি প্রশংসা কুড়িয়ে ছিল সর্বমহলে। কিন্তু কেবল একটি বার্ষিকী প্রকাশনা করে সন্তুষ্ট থাকার পাত্র ছিল না মুখতার। ওর মেয়াদকালে কলেজে থেকে সে প্রকাশ করেছিল আরও তিনটি অতিরিক্ত ম্যাগাজিন। সংশপ্তক, কালান্তর ও সুনিকেত মল্লার নামে। বই বোঝাই ঝোলাওয়ালা কলেজের ছেলেটাকে নিয়ে নিজ অভিজ্ঞতা ভাগ করল আমার কর্তা- সে সময়ের কারমাইকেল ছাত্র আব্দুল মালেক। ‘হঠাৎ এক দুপুরে বাড়ির দরজায় ঠুকঠুক শব্দ। খুলে বিস্ময়ে দেখি আমাদের ম্যাগাজিন সম্পাদক দাঁড়িয়ে। এরপর ঝোলা থেকে বের করে আনল কলেজ বার্ষিকীর একটি কপি। সেখানে আমার একটি গল্প ছাপা হয়েছিল। হাতে পত্রিকাটি তুলে দিতে দিতে তার মুখে উচ্চারিত হতে শুনলাম- লেখাটি খুব ভাল হয়েছে। বাড়ির ভেতর বসার অনুরোধ করলে বলল, না আমাকে অনেক জায়গায় যেতে হবে। একা একা লেখক-লেখিকার বাড়ি বাড়ি এমনি করে কলেজ ম্যাগাজিন পৌঁছে দিচ্ছে সম্পাদক স্বয়ং যেটা অভাবনীয়। আমি ওকে যে দু’দিন বেশ কিছুটা কাছে থেকে দেখেছি সেদিন ছিল রংপুর বেতার কেন্দ্র থেকে ছাত্রছাত্রীদের অনুষ্ঠানে ওডিশন দেয়ার এবং অনুষ্ঠান রেকর্ডিংয়ের দিন। একসঙ্গে অনুষ্ঠান রেকর্ড হলো-প্রচারিত হলো কিন্তু এর ভেতরেও ওর সঙ্গে কথা হয়নি। দেশ স্বাধীনের পূর্ব পর্যন্ত। সে সময় আমাদের ধরনটাই ছিল এমনি। অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর পর ’৬৯-এর গণআন্দলোনের উত্তাল দিন। এর মধ্যেই এসেছিল ছাত্র সংসদের নির্বাচন। কলেজজুড়ে তো বটেই ছাত্রছাত্রীদের বাড়ি বাড়িও চলছিল প্রচারণা। এমনি একদিনে আমরা ক্যারাম খেলছিলাম কমন রুমে- হঠাৎ জানালা পথে কানে এলো গগনবিদারী স্লোগান- জয় বাংলা। এক ছুটে বাইরে এসে দেখি কলেজ প্রাঙ্গণের শিরিষ শাখাকে কাঁপিয়ে, দিগন্ত ছাপিয়ে করে ধ্বনি তুলছে অনন্য এক ভাষায়- জয় বাংলা। শব্দটা আমার কানে যেন ভেসে এসেছিল দূরের কোন উত্তাল সমুদ্র থেকে। কলেজে সেদিন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম শাখা সংগঠন হিসেবে প্রথম জন্ম নিয়েছিল ছাত্রলীগ। সমাবেশের নেতৃত্বে দেখেছিলাম অলোক সরকার, আবুল মনসুর আহমেদ, রফিকুল ইসলাম গোলাপ, মুকুল মুস্তাফিজ, আব্দুল বারী, জায়দুল আলম, জিয়াউল হক সেবুসহ আরও ছিল আমাদের জুনিয়র সিনিয়র ও সহপাঠীদের মধ্যে যারা মেধাবী বলে পরিচিত সেই সব ছাত্রদের। তার মধ্যে মিছিলের প্রথম সারিতেই ছিল আমাদের মুখতার। এরপর মূল ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে দিতে লাগল আশ্চর্য সব স্লোগান ‘জাগো জাগো বাঙালী জাগো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, আমার নেতা তোমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব’। স্বাধীনতা আন্দোলনের পূর্ববর্তী ছাত্র সংসদের নির্বাচনে বিজয় ঘটল ছাত্রলীগের মুখতার এলাহী বিপুল ভোটে নির্বাচিত হলো ভিপি পদে। কিন্তু তারপরেও সে স্বভাবে ছিল ফার্স্ট ইয়ারের সেই নম্র কিশোরটি- তবে মুখে এসেছে একটা পাতলা গাম্ভীর্য। তারপরে এলো ’৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচন- বাঙালী বিপুল ভোটে নির্বাচিত করল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে? তারপর বহুল প্রত্যাশিত জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের ঘোষিত দিন. ইয়াহিয়া কর্তৃক স্থগিত ঘোষণার পর পরই সেই ফরমানের বিরুদ্ধে বিধ্বংসী প্রতিবাদের জ্বলল সারাদেশের মতো রংপুরের সর্বশ্রেণীর মানুষের কণ্ঠে। ইয়াহিয়ার ঘোষণা মানি না মানব না, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সঙ্গে কারমাইকেল কলেজের ছাত্ররা একাকার হয়ে রাস্তায় ফেটে পড়েছিল ক্ষোভের আগুনে- ইয়াহিয়ার ঘোষণা মানি না মানব না। এভাবে সেøাগান তুলে ক্লাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল দেশের সব বিদ্যানিকেতনের সঙ্গে আমাদের কারমাইকেলও। পরদিন সকালে ছাত্র অগুনতি মানুষ হাজির হলো পাবলিক লাইব্রেরী ময়দানে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছাত্র নেতৃবৃন্দের সঙ্গে অন্যতম নেতৃত্ব দিয়েছিল আমাদের কারমাইকেল ভিপি মুখতার ইলাহী। কুতোভয় হাজার হাজার বিদ্রোহী জনতা সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা সিদ্দিক হোসেনের নেতৃত্বে ট্যাঙ্ক ও কামানের মুখোমুখি হয়েও রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও ও আক্রমণ করে বাঁশের লাঠি হাতে। পঁচিশে মার্চ মধ্য রাতের পর পাকিস্তানী সামরিক জান্তা এবং তার সহযোগীরা সমগ্র বাংলায় যে বীভৎস হত্যা ও ধ্বংস যজ্ঞ শুরু করেছিল তার মধ্যে রংপুর ছিল অন্যতম। মুখতার ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বক্ষে ধারণ করে জ্বালিয়েছিল প্রতিরোধের আগুন। মুখতার ছিল আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে রংপুর অঞ্চলের মুজিব বাহিনীর প্রধান। সে যুদ্ধকালীন সময় তার সহযোগীদের নিয়ে প্রায়শই ঢুকে পড়ত দেশের অনেক অভ্যন্তরে। তাদের এই চলাচলের খবর স্থানীয় রাজাকাররা জানিয়ে দেয় হানাদার বাহিনীর কাছে। দেশ মুক্ত হওয়ার মাত্র এক মাস আগে ১১ নবেম্বর চিনুর রক্তে বিধৌত হয়েছিল বাংলার মাটি। তিস্তা নদীর নিকটস্থ মহেন্দ্রনগর এলাকার বড়বাড়ি গ্রামে ওর শহীদ মরদেহ শায়িত রয়েছে এখন। আমার সহপাঠী মুখতার বরাবর চ্যালেঞ্জ হিসেবে ১৩ নম্বর ক্রমিক সংখ্যাকে বেছে নিত। সে চ্যালেঞ্জ নিয়েই অস্ত্র ধরেছিল মুক্তিযুদ্ধে। মুখতার এবং ওর মতো যেসব তরুণ তাজা তাজা প্রাণগুলো তো বুকের রক্ত ঢেলে মুক্ত করেছিল দেশ মাতৃকাকে তার তো সৌভাগ্যের বরপুত্র- মত্যুঞ্জয়ী প্রাণ। যুগে যুগে যারা হবে স্মরণীয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য কারমাইকেল নামের বিদ্যাপীঠটির যার কালের কপোলতলে এমন এক মহান বীর শিক্ষার্থীর স্মৃতি রক্ষার্থে কোন স্থাপনা বা ভাস্কর্য নেই, এমনকি হোস্টেল বা ভবনেই নামকরণ পর্যন্ত নেই। আমরা যারা বেঁচে আছি তারাই প্রকৃত পক্ষে আনলাকি থার্টিন। লেখক : নিউইয়র্ক প্রবাসী লেখিকা
×