ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

গণহত্যা ১৯৭১ ॥ রাজশাহীর যোগীশো ও পালশা

প্রকাশিত: ১০:৩৫, ২৬ মার্চ ২০১৯

গণহত্যা ১৯৭১ ॥ রাজশাহীর যোগীশো ও পালশা

১৬ মে, ১৯৭১। ভোর বেলা। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ৬টি ভ্যান রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার যোগীশো গ্রামে পৌঁছায়। গ্রামে মিলিটারি প্রবেশ করেছে খবর পেয়ে পুরো জনপদ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বিশেষত হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সকলেই পরিবারসহ পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে আত্মগোপন করে। পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে আগত রাজাকার ও তাদের সহযোগীগণও ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ সরকার জড়িত ছিলেন মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে। তিনি এ অঞ্চলের পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের সহযোগী হিসেবে কাজ করলেও স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি তার অনুজ আব্দুল কাদেরের (পোস্টমাস্টার) মাধ্যমে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে আত্মগোপনে চলে যেতে খবর পাঠান। কিন্তু কাদের মাস্টার তার অগ্রজের বার্তা পৌঁছে না দিয়ে বরং হিন্দু-মুসলিমের সমন্বয়ে শান্তি কমিটি গঠিত হবে মর্মে বার্তা দেন। এ ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যাচারের মাধ্যমে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে আব্দুল কাদের মাস্টার, তার ঘনিষ্ঠ সঙ্গী মোজাফ্ফর মাস্টার (কেয়াতলার স্কুল শিক্ষক) ও তার সহযোগীদের মাধ্যমে বসতবাড়ি ও জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা হিন্দু ও মুসলমানদের ঘটনাস্থল স্কুলে সমবেত করা হয়। ১৯৬২ সালে রাজশাহী পবা থানার দারুসা গ্রামের হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। সে সময় কতিপয় বহিরাগত যুবক যোগীশো গ্রামে আক্রমণ করে ৫-৬টি হিন্দু পরিবারের বাড়ির ক্ষতি সাধন করলে তৎকালীন ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ সরকার দ্রুত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করেন। তিনি নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য স্থানীয়ভাবে উভয় সম্প্রদায়ের সমন্বয়ে শান্তি কমিটি গঠন করেন এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করেন। ’৬২ সালে যে শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছিল এর অনুরূপ ’৭২ সালে ১৬ মে অনুরূপ শান্তি কমিটি গঠনের মিথ্যা কথা বলে যোগীশো ও পালশা গ্রামের লোকদের যোগীশো প্রাইমারি স্কুলে জড়ো করা হয়। জনতা সমবেত হলে পাকিস্তানী বাহিনী হিন্দু-মুসলিমদের পৃথকভাবে সারিবদ্ধ করে এবং অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করে। এরপর স্কুল মাঠের উত্তর দিকে মাটির ঘরের পেছনে শুধুমাত্র হিন্দুদের নিয়ে গিয়ে বন্দুকের বাঁট দিয়ে পেটাতে থাকে। ফলে রক্তাক্ত হয়ে যায় সকলে। তাদের উপুড় করে বন্দুকের বাঁট দিয়ে নির্মমভাবে পেটানো হয়। নির্যাতনের এক পর্যায়ে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করা হয় তাদের। গণহত্যার বীভৎসতা এতই নির্মম ছিল যে, মানুষের রক্ত ও মগজ ঘটনাস্থলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। যাদের বুলেটের আঘাতে মৃত্যু হয়নি, রক্তাক্ত অবস্থায় নড়েচড়ে ওঠার চেষ্টা করলে পাকিস্তানী বাহিনী বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাদের হত্যা করে। গণহত্যা শেষ হলে নিকটবর্তী ডোবায় সামান্য মাটি খনন করে মৃতদেহগুলো মাটিচাপা দেয়া হয়। যারা এই বধ্যভূমি খনন এবং মাটিচাপার কাজে সম্পৃক্ত ছিল তারা হলেন যোগীশো স্কুল সংলগ্ন বাসিন্দা সওদাগর শাহ (৯৫), সোলাইমান আলী (৬৫), শুকুর আলী (৭০) প্রমুখ। গণহত্যার পর পাকিস্তানী বাহিনী ও দালালরা মিলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর লুটপাট করে। গণকবর দেয়ার পরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঘটনাস্থল ত্যাগ করে ফিরে যাওয়ার পথে হাটকানপাড়া সংলগ্ন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা অছির উদ্দীন ম-লের বড়বাড়ির ৮টি ঘর পুড়িয়ে দেয়। সে সময়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন শোভা ও শান্তি নামে দু’জন। তারা মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরে এ এলাকা ছেড়ে চলে যান। যোগীশো গ্রামে তাদের আর দেখা যায়নি। রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার যোগীশো ও পালশা গ্রামের গণহত্যা ছিল পূর্বপরিকল্পিত। সেখানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ৪২ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। ভৌগোলিক কারণে এই এলাকাকে নিরাপদ মনে করেছিল স্থানীয় লোকজন। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। কিন্তু স্থানীয় দালালরা মিথ্যা তথ্য ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের ঘটনাস্থলে হাজির করে। যোগীশো ও পালশা গ্রামের শহীদদের স্মরণে যোগীশো গ্রামে জেলা পরিষদের অর্থায়নে একটি স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে ৪২ জন শহীদের নাম রয়েছে। যোগীশো ও পালশা গণহত্যা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়–ন ‘১৯৭১ গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট’ থেকে প্রকাশিত গণহত্যা- নির্যাতন গ্রন্থমালা সিরিজের ‘যোগীশো ও পালশা গণহত্যা’ গ্রন্থটি। গ্রন্থটির লেখক এ কে এম কায়সারুজ্জামান এবং প্রকাশকাল, বৈশাখ ১৪২৫/ মে ২০১৮। লেখক : আর্কিভিস্ট, গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র, ২৬, সাউথ সেন্ট্রাল রোড, খুলনা
×