ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শিল্পের আলোয় কালরাতের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা

প্রকাশিত: ১১:১২, ২৬ মার্চ ২০১৯

শিল্পের আলোয় কালরাতের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বৃষ্টির মতো শূন্য থেকে ঝরছে রক্তের স্রোতধারা। রাতের আঁধারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মানুষরূপী ভয়ঙ্কর দানব। চোখেমুখে তার বীভৎসতা। ক্রমাগত হত্যা করে চলেছে নিরীহ নর-নারীদের। তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে তাদের আর্তনাদ। মেঝেতে লুটিয়ে থাকে লাশের সারি। সেসব শহীদের শরীরে ছড়িয়ে দেয়া হয় গুচ্ছ গুচ্ছ লাল গোলাপের পাপড়ি। এভাবেই লাল যাত্রা শীর্ষক ইম্প্রোভাইজেশনের মাধ্যমে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো হয় কালরাতের শহীদদের। সোমবার গণহত্যা দিবসের বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে পরিবেশনাটি উপস্থাপন করে নাট্যদল প্রাচ্যনাট। এদিন কালরাত্রি স্মরণে রাজধানীজুড়ে ছিল নানা আয়োজন। সেসব আয়োজনে শিল্পের আলোয় স্মরণ করা হয়েছে শহীদদের। নৃত্য-গীত, কবিতা আবৃত্তি, পথনাটকসহ অনুষ্ঠিত হয়েছে গণহত্যা দিবসকেন্দ্রিক আলোচনা সভা। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের স্বাধীনতা উৎসব ॥ ‘অশুভের সঙ্গে আপোসবিহীন দ্বন্দ্ব চাই প্রতিপাদ্যে’ প্রতিপাদ্যে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও ধানম-ি রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চে চলছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত তিন দিনব্যাপী স্বাধীনতা উৎসব। সোমবার দ্বিতীয় দিনের আয়োজনে নানা পরিবেশনায় স্মরণ করা হয় পঁচিশে মার্চের কালরাতের শহীদদের। শহীদ মিনারে দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে বহ্নিশিখা ও সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী। একক কণ্ঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাদায়ী স্বদেশের গান শোনান সমর বড়ুয়া, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস ও এস এম মেজবাহ। কবিতার শিল্পিত উচ্চারণে দলীয় আবৃত্তি পরিবেশন করে কথা আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্র ও মুক্তধারা আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্র। একক আবৃত্তি পরিবেশন করেন ইস্তেকবাল হোসেন, রেজীনা ওয়ালী লীনা ও আহ্কাম উল্লাহ। পথনাটক পরিবেশন করে মৈত্রী থিয়েটার। বৃন্দনৃত্য পরিবেশন করে ভোরের পাখি নৃত্যকলা কেন্দ্র। শিশু কিশোর পরিবেশনা উপস্থাপন করে শিল্পবৃত্ত ও ভিন্নধারা শিশু-কিশোর মেলার শিল্পীরা। রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চে দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে স্বভূমি, পদাতিক সঙ্গীত সংসদ ও পদ্মশ্রী। একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন মহাদেব ঘোষ, মাহবুব রিয়াজ, শিউলি আহমেদ, শান্তা সরকার, রাজিয়া মুন্নি ও আশিকুর রহমান। দলীয় আবৃত্তি পরিবেশন করে মুক্তধারা সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র ও মুক্তবাক। একক আবৃত্তি পরিবেশন করেন মাসুদুজ্জামান, ঝর্ণা সরকার ও শামসুজ্জোহা। পথনাটক পরিবেশন করে ভিশন থিয়েটার ও নাট্যদ্বীপ। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে সুর বিহার ও স্কেচ অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস। শিশু সংগঠন হিসেবে পরিবেশনায় অংশ নেয় রঙ্গপীঠ শিশু দল। কৃৎকলায় স্থাপনাশিল্প ‘কালরাত’ ॥ গণহত্যা দিবসে শৈল্পিক উপস্থাপনা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায় শিল্পকলা একাডেমি। বিকেল গড়ানো সন্ধ্যায় ২৫ মার্চের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞকে উপজীব্য করে কৃৎশিল্পীরা উপস্থাপন করে ‘কালরাত’ শীর্ষক কৃৎকলায় স্থাপনাশিল্প প্রদর্শনী। একাডেমির ভাস্কর্য উদ্যানে ছয়জন শিল্পীর অংশগ্রহণে উপস্থাপিত হয়ে এ পরিবেশনা। পাথরের স্তূপের ওপর স্থাপিত স্তম্ভ থেকে পতিত জলধারা পরিণত হয় লবণে। শিল্পীরা স্তম্ভের চারপাশ থেকে শোক প্রকাশক ধ্বনিসহ বেদনাবহ নানা রূপ কসরত প্রদর্শন করে তুলে ধরে কালরাতের বিষাদময় অধ্যায়কে। একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর ভাবনা ও পরিকল্পনায় পরিবেশনাটি উপস্থাপন করেন আবু নাসের রবি, জয়দেব রোয়াজা, অর্পিতা সিংহ লোপা, ফারাহ নাজমুন, জাহিদ হোসেন, সৈয়দ ও মোহাম্মদ জাকির। ‘গণহত্যা হাড়ের এ ঘরখানি’ ॥ গণহত্যা দিবস স্মরণে ‘গণহত্যা : হাড়ের এ ঘরখানি শীর্ষক’ আলোচনা সভার আয়োজন করে বাংলা একাডেমি। বিকেলে একাডেমির রবীন্দ্র চত্বরে অনুষ্ঠিত আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন লেখক ও সাংবাদিক জাহীদ রেজা নূর। স্বাগত ভাষণ দেন একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহফুজা খানম, সংসদ সদস্য আরমা দত্ত এবং প্রজন্ম ৭১-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মোঃ সাইদুর রহমান। সভাপতিত্ব করেন একাডেমির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। প্রবন্ধিক জাহীদ রেজা নূর বলেন, একাত্তরে যে শিশুটির বয়স ছিল পাঁচ বছর, সে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে বড় হয়, দেশকে অতীত বিস্মৃত হতে দেখে, পাকিস্তানি দালালদের আস্ফালন দেখে এ দেশে, যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী হতে দেখে, পাশাপাশি জাহানারা ইমামের গণআদালত দেখে, গণজাগরণ মঞ্চ দেখে, ঘাতকদের বিচার হতে দেখে। এবং এক সময় সে শিশুটি উপলব্ধি করে, নশ্বর জীবনে তার আয়ু একদিন শেষ হবে, যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, তাদের সবাই একদিন মারা যাবে, কিন্তু টিকে থাকবে এই দেশটা, যার নাম বাংলাদেশ। আর এই বাংলাদেশ টিকে থাকবে, যদি এ দেশের মানুষেরা যুগের পর যুগ ধরে তাদের গৌরবের মুক্তিযুদ্ধকে লালন করে। যদি এ দেশমাতৃকার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছে, তাঁদের সম্মান করে এবং আক্ষরিক অর্থেই বুঝে বলে, ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দানে পাওয়া নয়।’ আনিসুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর পরিচালিত নৃশংস গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এখনও অর্জন হয়নি। আমরা আশা করি সরকারের প্রয়াস এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শুভ বিবেকÑঅবশ্যই এই স্বীকৃতি আদায় করবে। আলোচকবৃন্দ বলেন, স্বাধীনতার ঊষালগ্নে নৃশংস ও নির্মম হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে পাক হানাদার বাহিনী বাংলার আত্মাকে বিধ্বস্ত ও বিনষ্ট করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এ অঞ্চলের উদার-অসাম্প্রদায়িক-মানবতাবাদী মানুষ তাদের স্বাধীনতার অদম্য আকাক্সক্ষাকে বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ নেতৃত্ব-নৈপুণ্যে বাস্তবে রূপ দিয়ে পাকবাহিনীর বর্বরতার জবাব দিয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে তারা বলেন, স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে জনদাবির বাস্তবায়নকল্পে ধারাবাহিকভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পাদন করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেছে। তবে কলঙ্কমুক্তির কাজ এখনও শেষ হয়নি। বহু যুদ্ধাপরাধী ব্যক্তি ও সংগঠন এখনও বিচারের আওতায় আসেনি। সমাজের সর্বস্তর থেকে যুদ্ধাপরাধী এবং গণহত্যার দোসররা এখনও নির্মূল হয়নি। তাই সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক জাগরণ ও প্রতিরোধের মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আয়োজন ॥ আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে চলমান স্বাধীনতা উৎসবে ‘জেনোসাইড এ্যান্ড জাস্টিস : আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক আলোচনায় বক্তব্য দেন যুগোশ্লাভিয়ার আইসিটিওয়াইয়ের প্রাক্তন প্রসিকিউটর নিকোল ইয়ানিসিভিৎস। আবৃত্তি পরিবেশন করে ¯্রােত আবৃত্তি সংসদ ও স্বরব্যাঞ্জন, একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন রোকাইয়া হাসিনা নিলি এবং দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন ছায়ানট ও আলফ্রেড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। সন্ধ্যায় জাদুঘরের শিখা চিরঅম্লান অঙ্গনে কালরাত্রি স্মরণে প্রদীপ প্রজ্বালন করা হয়। জাদুঘরে গণহত্যা দিবসের আলোচনা ॥ গণহত্যা দিবস উপলক্ষে জাতীয় জাদুঘর কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে আলোচনায় অংশ নেন ফোকলোরবিদ ও কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন এবং বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল (অব) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক। সভাপতিত্ব করেন জাদুঘর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি শিল্পী হাশেম খান। স্বাগত বক্তব্য দেন জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ রিয়াজ আহমেদ। আলোচনায় মুনতাসীর মামুন বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় যে হত্যাকা- হয় সেটা ২৫ মার্চের গণহত্যা। গণহত্যা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অপরাধ। সেদিন মধ্যরাতে পিলখানা, রাজারবাগ, নীলক্ষেত আক্রমণ করে পাকিস্তানী সেনারা। হানাদার বাহিনী ট্যাঙ্ক ও মর্টারের সাহায্যে নীলক্ষেতসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল নেয়। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯ জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি। সেই হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত। হাশেম খান বলেন, সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানম-ির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের আগে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং শেষ শত্রু বিদায় না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী লড়াই শেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। প্রাচ্যনাটের লাল যাত্রা : কালরাত স্মরণে প্রতিবছরের মতো এ বছরও নাট্য সংগঠন প্রাচ্যনাট আয়োজন করে ‘লাল যাত্রা’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বর (টিএসসি) থেকে ইম্প্রোভাইজেশনের মাধ্যমে দলের শিল্পীবৃন্দ সবান্ধব হেঁটে যায় স্মৃতি চিরন্তন চত্বর পর্যন্ত। এ সময় অংশগ্রহণকারীরা সম্মেলক কণ্ঠে গেয়ে শোনান ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা’সহ দেশের গান। স্মৃতি চিরন্তন চত্বরে সকল শহীদদের প্রতি সম্মানার্থে প্রদীপ প্রজ্বালনের মাধ্যমে শেষ হয় লাল যাত্রা। লাল যাত্রার মূল ভাবনায় ছিলেন রাহুল আনন্দ।
×