ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঠাকুরগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহীদ রিক্সা চালক আলী

প্রকাশিত: ০৯:০৮, ২৭ মার্চ ২০১৯

ঠাকুরগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহীদ রিক্সা চালক আলী

নিজস্ব সংবাদদাতা, ঠাকুরগাঁও, ২৬ মার্চ ॥ ২৭ মার্চ, ১৯৭১ সাল, মহান স্বাধীনতার ইতিহাসে ঠাকুরগাঁওয়ে সবার হৃদয়ে রক্তক্ষরণের একটি দিন। ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এই দিনটির কথা। ওইদিন পাকিস্তানী সেনাদের সামনে স্বাধীনতার পক্ষে জয়বাংলা বলে স্লোগান দেয়ার অপরাধে প্রকাশ্যে হানাদার বাহিনীর গুলিতে প্রাণ দিতে হয় শহরের রিক্সাচালক মোহাম্মদ আলীকে। সেদিন ঠাকুরগাঁও শহরে বলবত ছিল সান্ধ্য আইন। সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে বিচ্ছিন্নভাবে শহরে মিছিল চলে। অনেকেই ভিড় করে আওয়ামী লীগ নেতা তৎকালীন এমপিএ ফজলুল করিমের বাসার সামনে। সে সময় ফজলুল করিম ছিলেন জেলা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক। ২৫ মার্চ ৭১ গভীর রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঢাকায় বাঙালীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিল। পাক বাহিনী নির্বিচারে হত্যা করে বাঙালী পুলিশ, ইপিআর ও ছাত্রসহ সাধারণ মানুষ। কিন্তু ২৬ এবং ২৭ মার্চ ঠাকুরগাঁওয়ের জনসাধারণ এ বিষয়ে কোন সংবাদই পায়নি। সান্ধ্য আইন জারি থাকলেও ঠাকুরগাঁওবাসী অন্য দিনের মতো ২৭ মার্চেও খ- খ- মিছিলে শহরের বিভিন্ন স্থানে তারা ব্যারিকেড দেয়। ওইদিন দুপুরে একটি মিছিল জয়বাংলাসহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে যায় ইপিআর ক্যাম্পের দিকে। আর একটি ছোট মিছিল শহরের কালীবাড়ি মোড়ের সামনে পৌঁছলে দক্ষিণ দিক থেকে ইপিআর বোঝাই একটি লরি ও একটি জিপ এসে থামে। জিপ থেকে নামে ইপিআর উইং কমান্ডার মেজর মোহাম্মদ হোসেন ও ক্যাপ্টেন নাবিদ আলম। সামনে হানাদার বাহিনীকে দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়ে ছোট মিছিলটি। মিছিলের সামনেই বুক উচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মুখে চাপ দাড়ি মধ্য বয়সের রিক্সাচালক মোহাম্মদ আলী। হানাদার বাহিনীর সামনে মোহাম্মদ আলী বজ্রকণ্ঠে জয়বাংলা বলে স্লোগান দেয়। সঙ্গে সঙ্গে মেজর মোহাম্মদ হোসেনের ইশারায় হানাদারের রাইফেল গর্জে উঠে। মুহূর্তে চিৎকার দিয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে মোহাম্মদ আলী। মিছিলের বাকি লোক ছত্রভঙ্গ হয়ে বিভিন্ন দিকে ছুটে পালিয়ে যায়। পাকা রাস্তার ওপর রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে মোহাম্মদ আলীর লাশ। মোহাম্মদ আলী নিহত হওয়ার পর মেজর তার জিপ ও সৈন্যবাহিনী নিয়ে ফিরে যায় ইপিআর ক্যাম্পে। ধীরে ধীরে একজন দুইজন করে লোক ছুটে আসে ঘটনাস্থলে। শহরে ছড়িয়ে পড়ল মোহাম্মদ আলীর নিহত হওয়ার খবর। ঠাকুরগাঁওয়ের ইতিহাসে হানাদার বাহিনীর গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম। ঘর থেকে বের হয়ে আসে লোকজন। স্বাধীনতার প্রশ্নে তখন লোকজন সব ভয় ঝেরে ফেরে একত্রিত হন মোহাম্মদ আলীর নিহত হওয়ার স্থানে। তড়িঘড়ি করে রাস্তার পাশেই মোহাম্মদ আলীর লাশ দাফন করেন। তার নামানুসারে স্বাধীনতার পর এই রাস্তার নামকরণ করা হয় শহীদ মোহাম্মদ আলী সড়ক। পরদিন ২৮ মার্চ আবার কেঁপে উঠে ঠাকুরগাঁও শহর। হানাদারের বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় কিশোর নরেশ চৌহানের বুক। তার অপরাধ ছিল হানাদার বাহিনীকে দেখে বাঁশের বেড়ায় ঘরের ভেতর থেকে কিশোর নরেশ জয়বাংলা বলে চিৎকার করছিল। সঙ্গে সঙ্গে হানাদার বাহিনী সেই ঘর লক্ষ্য করে গুলি করে। নরেশ চৌহানের নামানুসারে তার বাড়ির সামনের রাস্তাটির নাম বর্তমানে শহীদ নরেশ চৌহান সড়ক। এই রাস্তার পাশেই নরেশ চৌহানকে কবর দেয়া হয়। ওই দিন ২৮ মার্চ রাতেই ইপিআর ক্যাম্পে বাঙালী সেনাদের অভ্যুত্থানের সময় আরও তিনজন নিহত বাঙালী ইপিআরকে সমাধিস্থ করা হয় মোহাম্মদ আলীর কবরের পাশে। শহীদ মোহাম্মদ আলীর কবরের নামফলকে তার মৃত্যুতে ২৮ মার্চ লেখায় তা সংশোধনের জন্য ১৯৭১ সালের ঠাকুরগাঁও জেলা সংগ্রাম কমিটির সদস্যবৃন্দ দাবি জানান। কিন্তু দীর্ঘদিন হলেও এখন পর্যন্ত সঠিক তারিখটি লেখা হয়নি।
×