ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দেলওয়ার হোসেন

সৈয়দপুরের প্রথম শহীদ ডাঃ এম এ আজিজ সরকার

প্রকাশিত: ০৯:৪৫, ২৭ মার্চ ২০১৯

সৈয়দপুরের প্রথম শহীদ ডাঃ এম এ আজিজ সরকার

আজ ২৭ মার্চ, আমার বাবা শহীদ ডাঃ এমএ আজিজ সরকারের ৪৮তম শাহাদাতবার্ষিকী। প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেয়ার সঙ্কল্পে অনড় ছিলেন তিনি। তাই স্থানীয় স্বাধীনতাকামী অকুতোভয় বাঙালীদের সংগঠিত করে স্বাধীনতার শত্রু বিহারি জনবহুল অধ্যুষিত রেলওয়ের সরকারী নিবাস এলাকায় থেকে যান জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরুর ঊষালগ্নের এই দিনেই তাকে প্রথম শিকার হিসেবে বর্বরোচিতভাবে হত্যা করা হয়। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও এই প্রতিরোধ যুদ্ধে জীবনবাজি রেখে লড়াইয়ের জন্য যারা আগেভাগেই এলাকা ত্যাগ না করে থেকে গিয়েছিলেন হিংস্র শত্রু পরিবেষ্টিত এলাকায়, পরে তাদের কেউ আর প্রাণে রক্ষা পায়নি। তাদেরও হতে হয় নৃশংস হত্যাযজ্ঞের শিকার। ’৭১ সালে মার্চের শুরু থেকেই দেশে যে রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থার সূচনা হয়, তখনই বাঙালী জনগোষ্ঠীর কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়, দেশে একটি ভয়াবহ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। তখন সাধারণ লোকমুখে ‘গ-গোল’ শব্দটিই বেশি উচ্চারিত হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রচারিত হওয়ার আগেই এই গ-গোল শব্দটি প্রত্যেকের মুখে মুখে অত্যন্ত আশঙ্কার সঙ্গে উচ্চারিত হতে থাকে। সেই ভয়ে এই বিহারি অধ্যুষিত বিপজ্জনক এলাকা থেকে সন্ত্রস্ত মানুষ নিজ নিজ এলাকা ত্যাগ করে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে থাকেন। অতঃপর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা এবং অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়ার পর পরিস্থিতি ভয়াবহ দিকে দ্রুত মোড় নিতে থাকে। এক সময় সৈয়দপুর শহরটি প্রায় বাঙালীশূন্য হয়ে পড়ে। এই শহরটি মূলত গড়ে ওঠে বাংলাদেশের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানা এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানা অফিস, স্থাপনা ও কর্মকাণ্ডকে ঘিরেই। স্বাধীনতা পূর্বকালে সৈয়দপুর রেল কারখানায় কাজ হতো দিবা এবং নৈশ– এই দুই শিফটে। এখানে কর্মচারীর সংখ্যা ছিল সাত হাজার। তার মধ্যে এই কারখানায় এবং এই ক্ষুদ্র শহরের জনপদে উর্দু ভাষী বিহারির জনসংখ্যা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। ৮ মার্চ রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি শোনার পর রাতারাতি পাল্টে গেল শংকাপ্রবণ আপাত স্থির অবস্থা প্রচ- উদ্বেগ ও বিভীষিকার দিকে। এই অবস্থায় তৎকালীন স্থানীয় আওয়ামীলীগের নির্বাচিত এমপি শহীদ ডা. জিকরুল হকসহ আব্বা এবং তার অন্যান্য অকুতোভয় বাঙালী সহযোদ্ধারা শপথ করেন যেÑ তারা এলাকা ছেড়ে কোথাও যাবেন না। প্রত্যেককে দায়িত্ব দেয়া হলো নিজ নিজ এলাকায় অনড় অবস্থানে থেকে প্রতিরোধ সংগঠিত করার। এ জন্য এই যোদ্ধারা আগে থেকেই অনড় ছিলেন, নিজের জন্মস্থান ছেড়ে রিফিউজি বিহারিদের ভয়ে কেউ পালাবেন না বলে। এই লজ্জার চেয়ে আত্মহনন অধিক শ্রেয় মনে করেছিলেন তারা। সে কথা আমরা আব্বার মুখে বার বার শুনেছি। আমরা কার ভয়ে পালাব? আমরা কী কাপুরুষ? তিনি বলতেন, আমরা কেন পালাব ওই বিহারিদের ভয়ে? এটা আমাদের দেশ। আমাদের জন্মভূমি। এ দেশের স্বাধীনতার জন্য আমরা লড়াই করে মরব। দেশের স্বাধীনতার জন্য শহীদ হয়ে যাব। ইতিহাসের পাতায় আমাদের নাম লেখা থাকবে। পালিয়ে যাওয়া কোন কাপুরুষের নাম লেখা থাকবে না ইতিহাসে। আমরাই ইতিহাস হয়ে থাকব। এমন সৌভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে ক’জন জন্মে? একটি দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ কালের দুর্লভ সন্ধিক্ষণে কেবল ক্ষণজন্মাদের ভাগ্যেই জোটে। এ কথা তার মুখ দিয়ে আমাদের বার বার শুনতে হয়েছে উন্মত্তের মতো প্রচ- ক্ষুব্ধ স্বরে, যখনই মা কিংবা ভয়ে তটস্থ আমরা আব্বাকে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাবার কথা বলেছি। এ নিয়ে মায়ের সঙ্গে আব্বার হয়েছে প্রচ- বাগ্বিত-া ও ঝগড়াঝাঁটি। মা ডুকরে ডুকরে কেঁদে চিৎকার করে বলেছেন, তুমি মানুষটা হলে একটা সীমার। স্ত্রী-সন্তান ও প্রিয়জনদের জন্য তোমার বুকে কোন মায়া দয়া নেই। তাহলে এত পঙ্গপাল জন্ম দিয়েছ কেন? এদের জেনে-বুঝে জাহান্নামের পথে ঠেলে দেয়ার জন্য? নিজে তো মরবেই এবং সব ক’টাকে সঙ্গে নিয়েই মরবে। কেউ বাঁচতে পারবে না এই জল্লাদদের হাত থেকে। মা বললেন, দেশে একটা রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে, সে কথা কী বুঝতে পারছ না জাহানারার বাবা? কিসের জন্য তুমি এতটা মরিয়া ও উন্মাদ হয়েছ? সবাই তো পালিয়েছে এবং পালিয়ে যাচ্ছে। তোমার এত কিসের দায় দেশের জন্য, এই দেশপ্রেম দেখাতে গিয়ে তো কত না নিগ্রহ ও সর্বনাশের শিকার হয়েছ। সরকার ও বিহারিদের শত্রু ও টার্গেটে পরিণত হয়েছ, এরপরেও তোমার শিক্ষা হলো না? মা কোরান শপথ করে বলছিলেন, ঠিক আছে। আমি কথা দিচ্ছি, আমি তোমার সঙ্গেই এখানে থেকে যাব। শহীদ হব দু’জনেই স্বাধীনতার জন্য। কিন্তু ছেলেমেয়েদের সবাইকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দাও। আব্বা মায়ের কোন কথায় কর্ণপাত করেননি। তার মুখে এক রা– মরলে সবাই এক সঙ্গেই মরব। কাপুরুষের মতো পালাব কেন? আমরা মরে গেলে ওরা পালিয়ে বেঁচে থেকে কী করবে? আব্বা ছিলেন এমনই দুর্দমনীয় চিন্তা ও সাহসের মানুষ। আমরা মৃত্যু নিশ্চিত জেনে সেই মৃত্যুপুরীতে থেকে গেলাম ভয়কে তুচ্ছ করে। আব্বার নেতৃত্বে কোঁদাল, বেলচা, শাবল, খুন্তি নিয়ে আমরা সব ভাই-বোন মিলে সরকারী বাসার সামনে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক রাতারাতি খুঁড়ে ফেললাম ইংরেজী অক্ষর ভি আকৃতির একটি দুর্গ। সাত পাঁচ চিন্তা না করে মহাবীরের মতো বাড়ির ছাদের ওপর উড়িয়ে দেয়া হলো স্বাধীনতার পতাকা! মা বার বার আব্বাকে উদ্দেশ্য চীৎকার করে বলতে থাকলেন, তোমার কানে কী কিছুই যাচ্ছে না? শুনছো না, দেখছো না- ওই জল্লাদেরা বাসায় এসে কী হুমকি দিয়ে যাচ্ছে? তোমাদের কাউকেই ওরা আস্ত রাখবে না, মনে রেখ কিন্তু! বাড়ির সামনে যে দুর্গ খুঁড়েছ এবং যে ঢাল তলোয়ার যোগাড় করেছ, এগুলো দিয়েই ওরা আমাদের কচু কাটা কাটবে। তখন দেখব তোমার বীরত্ব! আব্বা তবুও অনড়। পালাবেন না। মরতে হলে সবাইকে নিয়েই মরব। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকে সময় যত দ্রুত এগুতে থাকল অবনতিশীল ও সংঘর্ষময় পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিত মৃত্যু জেনে আমরা যেন সবাই ভাবলেশ শূন্য হয়ে পড়লাম। বিপদ থেকে মুক্তির জন্য মা আমাদের সঙ্গে নিয়ে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে নানা কলেমা ও সূরা মুখস্থ করার কাজে মগ্ন হয়ে পড়লেন আর মিথ্যা সান্ত¡না দিতে শুরু করলেন। বললেন যার সহায় কেউ নেই, তার আল্লাহ আছেন। তিনিই মানুষকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। আর তাই সারাক্ষণ আল্লাহ রাসূলের নাম নিয়ে এই সূরাগুলো অবিরাম জপতে থাক। আব্বার অগোচরে তখন আমরা শিশু-কিশোর বয়সী ভাই বোনেরা মাকেই অনুসরণ করতে থাকলাম। এই দুরবস্থায় মা-ই আমাদের একমাত্র সহায়। আব্বার সামনে তো যাওয়াই যায় না। সামনে গেলেই ক্রোধে ফেটে পড়ে বলতে থাকেন, ওই বিহারি ব্যাটারা সামনে এসে দাঁড়ায় যেন, কেউ আস্ত জীবন নিয়ে ফিরে যেতে পারবে না। কচু কাটার মতোই কেটে দেশের স্বাধীনতার জন্য শহীদ হয়ে যাব। একদিন ইতিহাস লিখবে আমাদের প্রতিরোধের কথা। এভাবে তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী সাহস দিতে থাকলেন আমাদের। রংপুর ও সৈয়দপুরে ২৬ মার্চ পর্যন্ত বহু রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের নারকীয় দিন গড়ানোর পর শেষমেশ এলো সেই বিভীষিকাময় যমদূতের সন্ধিক্ষণ ২৭ মার্চ। ঢাকায় রক্তক্ষয়ী গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে পদস্থ পাকি সামরিক কর্মকর্তা, স্থানীয় জামায়াত, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম সংশ্লিষ্ট বিহারি ও আওয়ামী লীগ, ন্যাপসহ বাঙালী নেতাদের নিয়ে একটি শান্তি বৈঠক করা হয়, সংঘর্ষ পরিহার করে পরস্পর শান্তিতে বসবাসের জন্য। এটি ছিল একটি ট্র্যাপ বা পূর্ব পরিকল্পিত গণহত্যার ছক। এই ছক অনুযায়ী ২৭ মার্চ পাক সেনাদের গাড়ির বহর প্রতিটি পাড়ায়-মহল্লায় প্রবেশ করে বিহারিদের সহযোগিতায় চাকরিজীবী প্রত্যেক বাঙালীকে অফিসে বাধ্যতামূলকভাবে যোগ দেয়ার জন্য জোরপূর্বক গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে গেল সকাল আটটার আগেই। আব্বা ও চাচাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর এলাকার শত সহস্র বিহারি জোটবদ্ধভাবে এসে আমাদের সরকারী বাসভবন চতুর্দিক থেকে ঘেরাও করে ফেলল। ঘটনার আকস্মিকতায় স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সবার অবস্থা মূর্ছা যাবার মতো। বিহারিদের রণহুঙ্কার, অশালীন কথাবার্তা-গালিগালাজ এবং পরিবারের মেয়েদের ব্যাপারে কুচিন্তার কথা শুনতে পেরে আমরা নিজেদের নিশ্চিত মৃত্যু জেনে ছোট-বড় প্রত্যেকেই যেন প্রতিরোধের আগুনে জ্বলে উঠলাম। খানিকক্ষণ পরেই দেখা গেল এলাকায় থেকে যাওয়া সব বাঙালী পরিবারকে আমাদের বাড়ির উঠোনে এনে জড়ো করে স্থানীয় কুখ্যাত বিহারি গু-াদের নির্দেশে সবার হাত-পা বাঁধার কাজ শুরু হলো। এই অবস্থার মধ্যেই মাইকে গুজব প্রচার করা হলো, সৈয়দপুর শহর চতুর্দিক দিয়ে মারণাস্ত্রে সজ্জিত বাঙালীদের দ্বারা অবরুদ্ধ এবং তারা বিহারিদের কচু কাটা করছে। এই অজুহাতে গোটা শহরে কার্ফ্যু জারির কথা ঘোষণা করা হলো। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে গোটা শহরে বাঙালীদের ওপর অস্ত্রসজ্জিত বিহারিরা ঝাঁপিয়ে পড়ল। শোনা গেছে, আব্বাকে জোরপূর্বক অফিসে নেয়ার পরেই ঘাতকরা নির্ধারণ করেছিল প্রথম আঘাতটিই তারা হানবে আমার বাবা ডাঃ এমএ আজিজ সরকারের ওপর। সরকারী চাকরি করেও দেশদ্রোহী কাজে লিপ্ত হওয়ার জন্য তাকে প্রথম সবকটি দেয়ার টার্গেট তারা আগেই করেছিল। সেই মোতাবেক অফিসে পৌঁছার পর পরই আব্বা রাগে ক্ষোভে অপমানে সঙ্গে সঙ্গেই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ার পর কিছুদূর যেতেই তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে স্পটেই জবাই করে লাশ টুকরো টুকরো করে গাড়িসহ লাশ পেট্রোলের আগুনে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করা হয়। খবর মতে, এদিন সংঘটিত ঘটনায় তিনিই সৈয়দপুরের প্রথম শহীদ। অন্যদিকে হিংস্র হায়েনা বিহারিদের দ্বারা অবরুদ্ধ আমাদের চোখের সামনে কয়েকজনকে জবাই করা হলো। তাদের রক্ত ফিনকি দিয়ে আমাদের শরীর স্পর্শ করল। তখন আমরা আর কেউ মৃত্যু ভয়ে ভীত নই। মা বললেন, তোরা কেউ আর ভয় পাস না। আগে মনে মনে কলেমা পড়ে নিয়ে সবাই জোরে জোরে জয়বাংলা বলে চিৎকার কর। তখনও মার হাত-পা বাঁধা হয়নি। নাম ডেকে ডেকে খতম লিস্টের কাজ চলছে। মা বাইরে নেতৃত্বদানকারী বিহারি গু-া নেতাদের কাছে গিয়ে বললেন, আমাদের যা আছে সব নিয়ে যা, তবুও এই শিশু বাচ্চাদের তোরা ছেড়ে দে। ডাক্তার সাহেব তোদের এমন কী ক্ষতি করেছে। সে তোদের বিনা পয়সায় ওষুধ ও চিকিৎসা দিয়ে জীবন বাঁচিয়েছে। সে কথা তোরা ভুলে গেছিস? তোরা মারলে আগে আমাকেই মার। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই মার উপর শুরু হলো বেদম প্রহার। মার প্রাণনাশী চিৎকারে যেন বিধাতাও ওদিন বধির হয়ে গিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ পর মায়ের চিৎকার আর শোনা গেল না। আমাদের হাত-পা বাঁধা। কিছুই করার ছিল না তখন। চোখের সামনে জবাইয়ের দৃশ্য দেখছি আর ভাবলেশহীনভাবে নিজের মৃত্যু প্রহর গুনছি। এর মধ্যেই খুনের পাশাপাশি বানের জল ঘরে ঢোকার মতোই শত সহস্র বিহারি হায়েনারা একযোগে প্রবেশ করে লুটতরাজের উৎসবেও মত্ত হয়ে পড়ল। সেইসঙ্গে ঘরের নারী সদস্যদের নিয়ে টানাটানি। এর মধ্যেই যেন হঠাৎ একদল ফেরেশতা মর্ত্যে নেমে এলো। সৈয়দপুর কায়েদে আযম কলেজের তরুণ বিহারি ছাত্র গোলাম হোসেনের নেতৃত্বে একদল বিহারি বীরযোদ্ধা খবর পেয়ে আমাদের উদ্ধারে ছুটে এলো। দুর্দান্ত সাহসিকতার সঙ্গে এই উন্মত্ত পরিস্থিতিতে বাঘের মুখ থেকে গ্রাস কেড়ে নেয়ার মতো বীরত্ব দেখিয়ে আমাদের সবাইকে উদ্ধার করে শহরের বাইরে একটি নিরাপদ স্থানে রেখে আসল ওরা। মায়ের চিৎকার অনেক আগেই থেমে গেছে। কোন সাড়া শব্দ নেই তার। আমরা তো ঘরের আঙ্গিনায় বন্দী। মার কথা বলতেই গোলাম বাহিনী সমস্বরে বলে উঠল, চাচচিকা কুছ নাহি হোগা। হাম হ্যায় না। আগে আপলোগ চালিয়ে। ফির চাচচিকো ভি সাথ লেকে আতে। মাকে ফেলে যাব? নাহ্ কিছুতেই কারও পা এগুচ্ছিল না। বললাম, আমরা সবাই একসঙ্গে মরব। তবুও মাকে ফেলে রেখে আমরা এক কদমও যাব না। বীর তরুণেরা তখন বলে উঠল, আরে– চাচচি কেয়া হামারা মা নাহি হ্যায়? ডাকডোর সাহাব কা ফ্যামিলিকা লিয়ে হামারা জান ভি কুরবান হ্যায়। এ কথার পর খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে আমরা হাঁটা শুরু করলাম ওদের হাত ধরে। আব্বা ঠিক এমনিভাবেই সমাজের বাঙালী-অবাঙালী ধর্ম-বর্ণ, জাত-পাত নির্বিশেষে দরিদ্র অসহায় মানুষের প্রতি বিনা পয়সায় চিকিৎসাসহ নানা রকম সার্বক্ষণিক সহায়তা দেয়ার পেছনেই যেন নিজের জীবনটাকে উৎসর্গ করেছিলেন। আর তাই এমন অসংখ্য গোলাম হোসেন ও তাদের পরিবারের কাছে আব্বা হয়ে উঠেছিলেন ধর্ম পিতা। জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে সন্তানের দায়িত্ব পালন করতে পিতার পরিবারের জীবন বাঁচানোর জন্য এগিয়ে এসেছিলেন আমার এই বিহারি ভাই গোলাম হোসেন ও তার সঙ্গীরা। আব্বা বলতেন, মানুষের সেবার চেয়ে আর বড় কোন ধর্ম নেই। যে ব্যক্তি অপরে অকুণ্ঠচিত্তে বিলায়, বিধাতা তাকেই সব কিছু মিলায়। মার আধমরা লাশ দুদিন বাঁচিয়ে রেখে গোলাম হোসেন ফিরে এসে বলল, মেরে মাকো হাম বাঁচা নাহি পায়া। গোলাম হোসেনের ডুকরে ওঠা কান্না যেন মার মৃত আত্মাকে স্পর্শ করছিল তখন। স্বাধীনতার পর গোলাম হোসেন বেঁচে ছিল কিছুদিন ভীষণ দুর্দশায়। আয়- রোজগারহীন অসুস্থ রিক্সাচালক গোলাম হোসেন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যায় ধুঁকে ধুঁকে। এতবড় অকৃতজ্ঞ আমরা খোঁজ নিতে পারিনি গোলাম হোসেনের জীবদ্দশায়। এখন বৃথাই ফেলি চোখের জল। পরজন্মে গোলাম হোসেন তুমি আমার ভাই হয়ে এসো তোমার প্রাণপ্রিয় চাচীর গর্ভ হতে। তখন রান্নাঘরে ঢুকে আর তোমাকে অনুমতি নিয়ে বলতে হবে না, চাচচি খুব ভুক লাগসে, ঘরে বুড়িয়াটা কিছুই পাকায়নি। একটু খাইতে দেন। কলিজে যাব এখন। স্টকহোল্ম, ২৪ মার্চ, ২০১৯ লেখক : সুইডেন প্রবাসী সাংবাদিক [email protected]
×