ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনতা দিবসে লাল সবুজের গণজাগরণ;###;স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির বিষদাঁত ভেঙ্গে দেয়ার প্রত্যয়

এগিয়ে যাওয়ার শপথ

প্রকাশিত: ১১:০২, ২৭ মার্চ ২০১৯

এগিয়ে যাওয়ার শপথ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ দেশের পথে প্রান্তরে পত পত করে উড়েছে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত লাল-সবুজের রক্তস্রোত জাতীয় পতাকা। আর এ পতাকা জানান দিয়েছে দেশের স্বাধীনতার কথা। যে দেশটি অর্জনে ত্রিশ লাখ মানুষকে আত্মবলিদান দিতে হয়েছে। তাই দেশের স্বাধীনতার দিনে এক অন্যরকম স্বস্তি, আনন্দ ও শপথে জেগে উঠেছিল বাঙালী। সারাদেশেই নতুন প্রজন্মের অভূতপূর্ব গণজাগরণ এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে এবারের স্বাধীনতা দিবসে। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তস্নাত লাল-সবুজের পতাকা হাতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলের কণ্ঠেই ধ্বনিত হয়েছে সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ-সাম্প্রদায়িকতামুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের প্রত্যাশার কথা। কালরাতের আঁধার পেরিয়ে আত্মপরিচয় অর্জন ও পরাধীনতার শিকল ভাঙ্গার দিনটি বাঙালী জাতি হৃদয়ের গভীরতা থেকে শ্রদ্ধার সঙ্গেই পালন করেছে নানা অনুষ্ঠানমালায়। মঙ্গলবার দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয়ে স্বাধীনতা দিবসে জাতি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ৪৮ বছর পূর্ণ করা বাংলাদেশে এবার স্বাধীনতা দিবস এসেছে নতুন অনুষঙ্গ নিয়ে। জাতির সামনে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে আরও এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরণে প্রতিটি অনুষ্ঠানেই ছিল স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির বিষদাঁত ভেঙ্গে দিয়ে অসাম্প্রদায়িক উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের দৃঢ় শপথ। মুক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে শ্রদ্ধা জানাতে আসা সবারই অভিন্ন শঙ্কা, একাত্তরের সঠিক ইতিহাস তরুণ প্রজন্ম না জানলে মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জনই বৃথা যাবে। পাকিস্তানের সেই পরাজিত সাম্প্রদায়িক শক্তি তরুণ সমাজের মধ্যে বিস্তার লাভ করলে বাংলাদেশকে আর সঠিক পথে রাখা যাবে না। তবে দেশমাতৃকার জন্য আত্মোৎসর্গকারী শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবারও মানুষের স্রোত ছিল চোখে পড়ার মতো। স্বাধীনতাবিরোধীদের মুলোৎ-পাটনের দৃপ্ত শপথে লাখো মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে বীর শহীদদের। রাস্তায় বের হওয়া শিশু-কিশোর ও তরুণদের হাতে, কারও গালে কিংবা কপালে আঁকা ছিল রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা, প্রিয় মাতৃভূমির মানচিত্র। তরুণ প্রজন্মের ছেলেদের গায়ে জাতীয় পতাকা সদৃশ্য শর্ট পাঞ্জাবি বা গেঞ্জি এবং মেয়েদের পরনে লাল-সবুজের মিশ্রণে জাতীয় পতাকার মতো শাড়ি। সবাই অংশ নিয়েছিলেন এবারের স্বাধীনতার আনন্দ-উৎসবে। রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা কণ্ঠে তরুণ প্রজন্মরা শুনেছে তাদের বীরত্বগাথা ইতিহাস, জেনেছে একাত্তরে রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের গণহত্যা, মা-বোনদের সম্ভ্রমহরণ ও বুদ্ধিবীজীদের হত্যার কালো ইতিহাস। তাই শুধু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাধারণ মানুষই নয়, তরুণ প্রজন্মের চোখে-মুখে স্বাধীনতাবিরোধী ও জঙ্গীদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা-ধিক্কারের বহির্প্রকাশ ঘটেছে সর্বত্র। রাজধানী থেকে শুরু করে শহর-বন্দর-গ্রামে দেশের স্বাধীনতার দিনের প্রতিটি অনুষ্ঠানে নতুন প্রজন্মের ঢল, তাদের চোখে-মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরে রাখার দৃপ্ত শপথ আর স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার প্রচ-তা প্রত্যক্ষ করেছে দেশের মানুষ। নতুন প্রজন্মের এমন গণজাগরণ আশাবাদী ও সাহসী করে তুলেছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষকে। রাজনীতিক থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবাই দৃঢ় আশাবাদী- ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নতুন প্রজন্মের এমন জাগরণ জানান দিচ্ছে, যতই ফনা তোলার চেষ্টা করুক, জঙ্গীবাদ-সাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রবিরোধী অন্ধকারের শক্তির দিন শেষ। যুদ্ধাপরাধী রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের নির্মূল করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন এক জন্মভূমির যাত্রা শুরু হবেই।’ আনন্দ, বেদনা ও বিনম্র শ্রদ্ধায় মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণ এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদমুক্ত অসাম্প্রদায়িক স্বনির্ভর সুখী সমৃদ্ধি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দৃঢ় অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে মঙ্গলবার বাঙালী জাতি অন্যরকম স্বস্তি ও উৎসবের আমেজে পালন করলো মহান স্বাধীনতার ৪৮ বছর পূর্তি ও জাতীয় দিবস। শ্রদ্ধাবনত জাতি ফুলে ফুলে ভরে দেয় সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ, ধানম-ির ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি এবং টুঙ্গিপাড়ার বঙ্গবন্ধুর মাজারের বেদিমূল। লাল-সবুজ পতাকা হাতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলের কণ্ঠেই ধ্বনিত হয়েছে একই সেøাগান- ‘মুজিবের বাংলায়, স্বাধীনতাবিরোধী ও জঙ্গীদের ঠাঁই নাই, জামায়াত-শিবির-রাজাকার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়।’ তবে স্বাধীনতা দিবসে আনন্দমুখর এ উৎসবে বরাবরের মতো এবারও অন্তঃস্রোতে বয়ে গেছে স্বজন হারানোর বেদনা। আর বাঙালীর জাতীয় জীবনে আনন্দ-বেদনার এমন দ্বৈরথের ঘটনা খুব বেশি নেই। বাঙালী জাতি আনন্দ আর বেদনার মহাকাব্য স্বাধীনতার সংগ্রামে একদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অসম সাহসিকতা আর হাজারো নারীর আত্মত্যাগের বীরত্বগাথা। অন্যদিকে বর্বর পাকসেনা আর রাজাকার-আলবদরদের নীচুতা, শঠতা ও হিংস্রতার কলঙ্কময় ইতিহাস। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণায় ৪৮ বছর আগের এ দিনে পাকিস্তানী বাহিনীর দমন অভিযানের বিরুদ্ধে রূখে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এ ভূখ-ের মানুষ। তার পরের ৯ মাস পাকিস্তানী বাহিনী আর তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর চক্র চালিয়েছে ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ। তাই স্বাধীনতা দিবসের এই দিনে দেশবাসী শ্রদ্ধা আর বেদনায় স্মরণ করে যুদ্ধে নিহত স্বজনদের আর অসম লড়াইয়ে বিজয়ী রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। মঙ্গলবার পুরো রাজধানী থেকে শুরু করে সাভার স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত পরিণত হয়েছিল উৎসবের সেøাগানে বজ্রভূমিতে। যেখানে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা লাল-সবুজে সজ্জিত হয়ে পথে নেমেছিলেন জাতির প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের দাবিতে। পথে পথে ব্যান্ড বাজিয়ে, গলা ছেড়ে দেশের গান গেয়ে, সেøাগানে সেøাগানে আশপাশ সচকিত করে তরুণরা প্রাণস্পন্দিত করে রেখেছিল স্বাধীনতার এ দিনটিকে। প্রত্যুষে তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দর এলাকায় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে সূচনা হয় স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানমালার। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে বীর শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সশস্ত্র বাহিনীর একটি সুসজ্জিত চৌকস দল এ সময় গার্ড অব অনার প্রদান করে। বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর। শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের পর মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের অংশ হিসেবে তাঁরা সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, তিন বাহিনীর প্রধান, মুক্তিযোদ্ধা, বিদেশী কূটনীতিক এবং উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। পরে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে নিয়ে তাঁর দলের পক্ষ থেকে আরেকটি শ্রদ্ধাঞ্জলি জাতীয় স্মৃতিসৌধের বেদিতে অর্পণ করেন। এছাড়াও ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া এবং প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সংসদে বিরোধী দলের উপনেতা বেগম রওশন এরশাদ, জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গাও শহীদদের বেদিতে শ্রদ্ধা জানান। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন এবং উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম পৃথক পৃথকভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সকাল ৭টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধানম-ি ৩২ নম্বর সড়কে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে শিশু-কিশোরদের সমাবেশে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন এবং বক্তব্য রাখেন। হাতিরঝিলে অনুষ্ঠিত দৃষ্টিনন্দন নৌকা বাইচ সবার মন কেড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে উদযাপন করা হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ঢাকার পুরাতন বিমাবনন্দরে সশস্ত্র বাহিনীর উদ্যোগে আট দিনব্যাপী সমরাস্ত্র প্রদর্শনীতে মঙ্গলবার ছিল দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। এছাড়া ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিভিন্ন বাহিনীর বাদক দল বাদ্য পরিবেশন করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গণযোগাযোগ অধিদফতরের উদ্যোগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত নাট্যমঞ্চ (এ্যাম্পিথিয়েটার) থেকে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এবং সদরঘাট থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত নৌপথে বিশিষ্ট শিল্পীদের অংশগ্রহণে দেশাত্মবোধক সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার ছিল সরকারী ছুটি। স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বেতার, টেলিভিশনে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হয়। সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন ভবনে, বাড়িঘর, যানবাহন ও দোকানে উড়েছে জাতীয় পতাকা। সরকারী গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলোতে আলোকসজ্জা করা হয়। সারাদেশে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মসজিদে বিশেষ মোনাজাতে শহীদদের আত্মার মাগফিরাত, দেশের শান্তি ও অগ্রগতি কামনা করা হয়। মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাতেও অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ প্রার্থনা সভা। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন-প্রতিষ্ঠান আনন্দ শোভাযাত্রা, আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক আলোকচিত্র প্রদর্শনী, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতাসহ নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মহান স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করে। টুঙ্গিপাড়াতেও নেমেছিল স্বাধীনতার পক্ষের মানুষের ঢল। অজস্র মানুষের শ্রদ্ধাঞ্জলির ফুলে ফুলে ভরে উঠে স্বাধীনতার মহান স্থপতির মাজারের বেদিমূল। সশস্ত্র বাহিনীও যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি উদযাপন করে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্র, হাসপাতাল, জেলাখানা, সরকারী শিশুসনদসহ অনুরূপ প্রতিষ্ঠানসমূহে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসেও দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা হয়। সাভারে লাখো মানুষের ঢল ॥ মহান স্বাধীনতা দিবসে লাখো মানুষের ধ্বনিতে দিনভর মুখরিত ছিল জাতীয় স্মৃতিসৌধ। সকাল থেকে ফুলে ফুলে ভরে উঠেছিল স্মৃতিসৌধের বেদি। একই সঙ্গে দেশাত্মবোধক গান ও মুহুর্মুহু স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠছিল জাতীয় স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ। শ্রদ্ধায় অবনত জাতি এদিন আবারও স্মরণ করলো মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ অমর বীরসন্তানদের। স্মৃতিসৌধে এদিন সকাল থেকেই ছিল সর্বস্তরের মানুষের ভিড়। ভোরে সাভার স্মৃতিসৌধে প্রথমে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একটু পরেই সেখানে পৌঁছান রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে অভ্যর্থনা জানান। ভোর ৫টা ৫৭ মিনিটে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রথমে শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতির পর প্রধানমন্ত্রী শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করেন। এসময় তিন বাহিনীর সুসজ্জিত একটি চৌকস দল বীর শহীদদের প্রতি গার্ড অব অনার প্রদান করেন। এ সময় বিউগলে ধ্বনিত হয় করুণ সুর। পরে রাষ্ট্রপতি স্মৃতিসৌধের পরিদর্শন বইতে স্বাক্ষর করেন। এরপর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও প্রধানমন্ত্রী শহীদ বেদিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। প্রায় ২৫ মিনিট রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে অবস্থান করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবর্গ, প্রধান বিচারপতি, কূটনীতিক, তিন বাহিনীর প্রধান, মুক্তিযোদ্ধা এবং পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা। সংসদের ডেপুটি স্পীকার ফজলে রাব্বী মিয়া, নয়জন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং সাত বীরশ্রেষ্ঠ পরিবারের সদস্যরা শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা এবং কূটনীতিকরা স্মৃতিসৌধ এলাকা ত্যাগ করার পর স্মৃতিসৌধ সর্বসাধারণের শ্রদ্ধাঞ্জলি দেয়ার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হলে মানুষের ঢল নামে। বিএনপির পক্ষ থেকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছে। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও দলের অন্যান্য নেতা সকাল ৮টায় শহীদদের স্মরণে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন বিএনপি নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ড. মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, নিতাই রায় চৌধুরী, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, শ্যামা ওবায়েদ ও ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি দেওয়ান মোঃ সালাউদ্দিন বাবুসহ বিএনপির নেতাকর্মীরা। এছাড়া বিএনপি ও এর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীও এ সময় উপস্থিত ছিলেন। এরপর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণফোরাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি সাভার উপজেলা শাখা, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, সেক্টরস কমান্ডার্স ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ ৭১, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) ওয়ার্কার্স পার্টি, বাসদ, সাম্যবাদী দল, গণতন্ত্রী পার্টি, যুবলীগ, যুবদল, যুব ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, কৃষক লীগ, কৃষক দল, কৃষক সমিতি, ক্ষেত মজুর সমিতি, ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, বঙ্গবন্ধু সংসদ, জাসাস, মহিলা পরিষদ, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রসহ বিভিন্ন সংগঠন পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানায় শহীদদের প্রতি। একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামসহ মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সংগঠন ছাড়াও স্মৃতিসৌধের বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র কমান্ড, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাব এডিটরস কাউন্সিল, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম, জাকের পার্টির ঢাকা মহানগর, বাংলাদেশ লোক-প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি), বিনিয়োগ বোর্ড-প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গণবিশ্ববিদ্যালয়, পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি), জাতীয় শ্রমিক লীগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন দুগ্ধ খামার, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন (পিডিবিএফ), জনতা ব্যাংক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সাভার, এনজিও সমন্বয় পরিষদ সাভার, প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র, নজরুল ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষনা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় পার্টি (জেপি), জাতীয় পার্টি (বিজেপি), বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন, অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশন, প্রশিকা, বাংলাদেশ গণআজাদী লীগ, এডাব, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ন্যাপ, জাতীয় গামের্ন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, পরমানু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, জাতীয় পেশাজীবী পরিষদ, বাংলাদেশ খ্রীস্টান এ্যাসোসিয়েশন, মাওলানা ভাসানী মেডিক্যাল কলেজ, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, গামের্ন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরাম, সাভার প্রেসক্লাবসহ অজস্র রাজনৈতিক সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্রের কারণে ৭১’র গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সম্ভব হয়নি। বিএনপি-জামায়াত পরিকল্পিতভাবেই বিভিন্ন সময়ে ২৫ মার্চ কালরাতের গণহত্যা নিয়ে মিথ্যাচার করেছে। সবমিলিয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্রের কারণে এবং ’৭৫ পরবর্তী সময়ে যারা বাংলাদেশের ক্ষমতায় এসেছে তাদের ষড়যন্ত্রের কারণে আমরা এখন পর্যন্ত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করতে পারিনি। তিনি বলেন, বর্তমানে আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জোরালো দাবি করেছি। আশা করছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতিসংঘ এ গণহত্যার স্বীকৃতি দেবে এবং এর সঙ্গে জড়িতদের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা হবে বলেও জানান তিনি। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, লাখো বীর শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। আমাদের চরম দুর্ভাগ্য যে আদর্শ, চেতনা নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, আজকে সেই চেতনা এবং আদর্শ সম্পূর্ণভাবে ভূলণ্ঠিত হয়েছে। গণতন্ত্রকে হত্যা করে দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার একটি চক্রান্ত প্রতিষ্ঠা লাভ করতে যাচ্ছে। জনগণের অধিকার হরণ করা হয়েছে। তাদের ভোটাধিকার হরন করা হয়েছে, দেশের মানুষের জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই। আজকে সাধারণ মানুষের চলাফেরার কোন নিরাপত্তা নেই, সড়কে কোন নিরাপত্তা নেই। তিনি মহান স্বাধীনতার দিনে দেশের জনগণকে আন্দোলনের মাধ্যমে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া এবং গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে শপথ গ্রহণের আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণ জনারণ্য ॥ দেশের স্বাধীনতা দিবসে ধানম-ির ৩২ নম্বর ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণ মঙ্গলবার ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিল জনারণ্য। অজস্র কৃতজ্ঞ বাঙালী বিনম্র শ্রদ্ধা জানান স্বাধীন রাষ্ট্রের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি জাগরণী দেশাত্মবোধক গান, স্লোগান আর মিছিলে মিছিলে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন প্রাঙ্গণ দিনভর ছিল মুখরিত। হাজার হাজার মানুষ বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ঘুরে ঘুরে দেখেন। সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধানম-িতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে রক্ষিত বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রতিকৃতির সামনে কিছুক্ষণ নিরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার ৪৯তম স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। অন্যবারের মতো এবারও তিনি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদের ফুল, মিষ্টান্ন এবং নানা উপহার সামগ্রী পাঠিয়ে এই শুভেচ্ছা জানান।
×