ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে শিশু-কিশোর সমাবেশ

শিশুরাই আগামী দিনের বাংলাদেশ গড়ে তুলবে ॥ প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ১১:০৩, ২৭ মার্চ ২০১৯

শিশুরাই আগামী দিনের বাংলাদেশ গড়ে তুলবে ॥ প্রধানমন্ত্রী

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে শিশু-কিশোরদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আজকের শিশু আগামী দিনে এদেশের কর্ণধার। আজকের শিশুরাই আগামী দিনের বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। আজকের শিশুদের মধ্যেই কেউ প্রধানমন্ত্রী হবে, মন্ত্রী হবে, বড় বড় চাকরি করবে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সোনার বাংলা গড়ে তুলবে। আমরা আমাদের শিশুদের সেভাবে গড়ে তুলতে চাই। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে, দেশকে ভালবেসে তারা মুক্তিযুুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ে তুলবে। মহান স্বাধীনতা এবং জাতীয় দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে শিশু-কিশোর সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার্থীদের বাবা-মা ও শিক্ষকদের কথা শুনতে, নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলতে এবং সুন্দরভাবে জীবন যাপন করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে তোমাদেরই। তোমরাই গড়ে তুলবে আগামী দিনের উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। ইনশা আল্লাহ এই বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার শান্তিপূর্ণ উন্নত সমৃদ্ধ দেশ। আমরাই জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণ করব। শিশু-কিশোরদের মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের কুফল সম্পর্কে জানাতে শিক্ষক ও অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এর হাত থেকে শিশুদের রক্ষা করতে হবে। অভিভাবক, বাবা-মা তাদের অবশ্যই সব সময় লক্ষ্য রাখতে হবে সন্তান কোথায় যায়, কার সঙ্গে মেশে, কীভাবে মেশে। সকলে যাতে লেখাপড়ার দিকে মনোযোগ দেয়, খেলাধুলা, শরীরচর্চা, নানা ধরনের প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে শিশুদের মনন ও মেধা যেন বিকশিত হয়। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের সন্তানরা যেন এগিয়ে যেতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। কেননা আজকের শিশু আগামী দিনে এদেশের কর্ণধার হবে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং ঢাকা জেলা প্রশাসন এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এবং ঢাকা জেলা প্রশাসক মোঃ আবু সালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী এ অনুষ্ঠানে জাতীয় পর্যায়ে শুদ্ধ সুরে জাতীয় সঙ্গীত প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করেন। প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক এই তিন ক্যাটাগরিতে বিজয়ী ৯০ জনকে পুরস্কৃত করা হয়। পরে কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করেন এবং শিক্ষার্থীদের ডিসপ্লে দেখেন প্রধানমন্ত্রী। সমাবেশ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের গ্যালারিকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযুদ্ধের সাত বীরশ্রেষ্ঠ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি এবং বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়। এর আগে সকাল ৮টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছলে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। প্রধানমন্ত্রী কোমলমতি শিশু-কিশোরদের কুচকাওয়াজ পরিদর্শন এবং সালাম গ্রহণ করেন। কুচকাওয়াজের পর শিশু-কিশোর সমাবেশে এবারের থিম সং ‘নোঙর তোল তোল সময় যে হল হল’ গানটি পরিবেশিত হয়। এ সময় একটি দৃষ্টিনন্দন নৌকা স্টেডিয়ামে প্রবেশ করে চারপাশে ঘুরে বেড়ায় এবং এরসঙ্গে গাড়ি বহরের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকা- তুলে ধরা হয়। প্রধানমন্ত্রী সারাদেশের বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিশু-কিশোরদের পরিবেশনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং ডিসপ্লে উপভোগ করেন। এ সময় মন্ত্রিসভার সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, পদস্থ সামরিক এবং বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্য কোমলমতি শিশু কিশোরদের উদ্দেশে তুলে ধরে বলেন, সোনামণিরা আজকে আমাদের স্বাধীনতা দিবস। দীর্ঘ ২৪ বছরের সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্যদিয়ে আমরা অর্জন করেছি আমাদের স্বাধীনতা। স্বাধীন দেশে প্রতিটি মানুষ সুন্দরভাবে বাঁচবে এবং একটি উন্নত জীবন পাবে এটাই ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন। আজকে আমরা একটি লাল-সবুজ পতাকা পেয়েছি। একটা দেশ পেয়েছি, একটা জাতি হিসেবে আত্মমর্যাদা পেয়েছি। এই মর্যাদাকে আরও উন্নত করা- সেটাই ছিল জাতির পিতার লক্ষ্য। শিশুতোষ বয়স থেকে জনগণের কল্যাণে জাতির পিতা ছিলেন নিবেদিত প্রাণ উল্লেখ করে মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতার সংগ্রামী ভূমিকা এ সময় তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলার অধিকার আদায়ে সেই ১৯৪৮ সাল থেকে জাতির পিতা যে যাত্রা শুরু করেছিলেন সেটাই একাত্তর সালে তাঁর নেতৃত্বে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করার মধ্যদিয়ে একটি সফল পরিণতি লাভ করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার পাশাপাশি মানুষকে অর্থনৈতিক মুক্তি দেয়ার লক্ষ্যে সেই সময় থেকেই জাতির পিতার বিভিন্ন কর্মকা-ের উল্লেখযোগ্য অংশ শিশু-কিশোরদের উদ্দেশে তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার দেশ স্বাধীনের লক্ষ্য ছিল এদেশের প্রতিটি শিশু শিক্ষা গ্রহণ করবে, প্রতিটি নাগরিক সুশিক্ষিত হবে। দেশ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত-সমৃদ্ধিশালী হিসেবে গড়ে উঠবে এবং সেই লক্ষ্য নিয়েই তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। শেখ হাসিনা আরও বলেন, যখনই জাতির পিতা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলে দেশকে উন্নয়নের পথে নিতে শুরু করেন দুর্ভাগ্যক্রমে তখনই ’৭৫’র ১৫ আগস্টের কালরাতে তাঁকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকা-ের মধ্যদিয়ে বাংলদেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। এই হত্যাকা-ের মধ্যদিয়েই বাংলাদেশে হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্র এবং অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের পালা শুরু হয়। মানুষের বেঁচে থাকার এবং প্রতিরাতে কারফিউ দিয়ে কথা বলার অধিকার পর্যন্ত কেড়ে নেয়া হয়। এরপর দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ আবার যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে ঠিক তখন থেকেই পুনরায় উন্নয়নের অভিযাত্রা শুরু হয়। ’৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের পাঁচ বছরের সময়কে দেশের জন্য এক স্বর্ণযুগ আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছিলাম, বিদ্যুত উৎপাদন এবং সাক্ষরতার হার বাড়িয়েছিলাম। পুনরায় ২০০৮ সালে নির্বাচিত হয়ে এ পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনায় দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশকে আজকে আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত করেছি। দারিদ্র্যের হার, শিশু মৃত্যু, মাতৃমৃত্যুহার আমরা কমাতে পেরেছি। প্রধানমন্ত্রী এ সময় বছরের শুরুতে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে বিনা পয়সায় পাঠ্যপুস্তক বিতরণসহ শিক্ষা সম্প্রসারণে তার সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে বলেন, প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত সরকার বৃত্তি প্রদান করছে, যেন দরিদ্র ছেলে-মেয়েরা শিক্ষার সুযোগ লাভ করতে পারে। শিশু-কিশোরদের মেধা ও মনন গঠনে শিক্ষার পাশাপাশি খেলাধুলা, শরীর চর্চা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণকে অপরিহার্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, জাতির পিতা ১৯৭৪ সালে আমাদের জন্য শিশু অধিকার আইন করে দিয়ে যান। এরই আলোকে আমরা নীতিমালা গ্রহণ করেছি এবং শিশুদের জন্য শিক্ষার পাশাপাশি খেলাধুলা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা আয়োজনের মাধ্যমে তাদের মেধা বিকাশের সুযোগ করে দিচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের আমলে দুস্থ মহিলা ও শিশু কল্যাণ তহবিল নামে একটি তহবিল গড়ে তুলে দুস্থ ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সহযোগিতা করে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন। একইসঙ্গে তিনি মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণসহ সারাদেশের তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেয়া, কম্পিউটার শিক্ষা এবং মাল্টিমিডিয়া ক্লাশরুমসহ দেশকে ডিজিটালাইজড করে গড়ে তোলায় তার সরকারের পদক্ষেপসমূহ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের সন্তানরা যাতে আধুনিক প্রযুক্তি শিক্ষায় দক্ষ হয়ে গড়ে উঠতে পারে তার পদক্ষেপ আমরা নিচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করব, ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। আমরা ২০২০ থেকে ২০২১ পর্যন্ত সময়কে ‘মুজিব বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছি। আমরা এই সময়টাকে এমনভাবে কাজে লাগাতে চাই যেন বাংলাদেশ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে ওঠে। বক্তব্যের শেষে এসে কবি সুকান্তের কবিতার পঙ্ক্তির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে শেখ হাসিনা বলেন- ‘যতক্ষণ এ দেহে আছে প্রাণ/প্রাণপণে এ পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল/বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি/ নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
×