ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জামায়াতের বিচারে শীঘ্রই আইন সংশোধন

প্রকাশিত: ১১:০৪, ২৭ মার্চ ২০১৯

জামায়াতের বিচারে শীঘ্রই আইন সংশোধন

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ক্রিমিনাল সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামী যুদ্ধাপরাধের বিচারে জন্য শীঘ্রই মন্ত্রিপরিষদে আইনের সংশোধনী খসড়াটি উপস্থাপন করা হবে। মন্ত্রিপরিষদের খসড়া আইনটি অনুমোদন হলে তা ড্রাফটিং বিভাগ হয়ে সংসদে যাবে। সংসদে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনটি পাস হলে জামায়াতে ইসলামীর বিচারে আর কোন বাধা থাকবে না। দেশের বিশিষ্ট আইনজীবীসহ তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তাদের অভিমত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংগঠন হিসেবে দলের বিচার হয়েছে। এখানেও জামায়াতে ইসলামীর ক্রিমিনাল সংগঠন হিসেবে বিচার হওয়া উচিত। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, শীঘ্রই খসড়াটি মন্ত্রিপরিষদে চলে যাবে। মন্ত্রিপরিষদে উপস্থাপনের পর তা অনুমোদন হয়ে সংসদে যাবে। আইনটি পাস হওয়ার পর জামায়াতে ইসলামীর বিচারে আর কোন অসুবিধা হবে না। এর আগে দ্বিতীয় দফায় আইনমন্ত্রী হিসেবে দািয়ত্ব গ্রহণের পর তিনি বলেছিলেন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন আবারও সংশোধন করা হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যারা মানবতাবিরোধী ব্যক্তি তাদের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালের আইনটি করা হয়েছিল। তখন সেই আইনটাতে দল হিসেবে জামায়াতের বিচার করার জন্য করা হয়নি। তবে ১৯৭২ সালে যখন সংবিধান প্রণয়ন করা হয় তখন জামায়াতকে ‘ব্যান্ড’ (বাতিল) করা হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের বিচার ও তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের খসড়া চূড়ান্ত। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলে তা মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হবে। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা দীর্ঘদিন তদন্ত শেষে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে প্রসিকিউশন শাখায়। সেখানে দল হিসেবে নিষিদ্ধের পাশাপাশি জামায়াতের আদর্শ নিয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধের সুপারিশ করা হয়। একই সঙ্গে জামায়াত তাদের সহয়োগী সংগঠক ইসলামী ছাত্র সংঘ, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সহাযোগিতা দিতে গঠিত শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস, মুখপাত্র দৈনিক সংগ্রাম নিষিদ্ধের আবেদন করা হয়। সম্পদ বিলুপ্তির আবেদন করা হয়। সে সময়ই প্রসিকিউশন পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ‘তদন্ত শেষ হয়েছে। এ সংগঠনের বিরুদ্ধে যেসব অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাতে বিভিন্ন ধরনের সাজা হতে পারে। সংগঠনটি নিষিদ্ধ হতে পারে, তাদের সব সম্পত্তি বাজেয়াফত করা হতে পারে। এরপর প্রায় ৫ বছর কেটে গেলেও বিচার শুরু করা সম্ভব হয়নি। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেন, খসড়া আইনটি পাস হলে ক্রিমিনাল সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার করতে বাধা থাকবে না। ক্যাবিনেটে খসড়া আইনটি অনুমোদন করলে পার্লামেন্টে যাবে। পার্লামেন্ট পাস করলেই আইনটি হয়ে যাবে। এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল জনকণ্ঠকে বলেন, ‘সবার মতো আমরাও চাই আইনটি খুব দ্রুত সংশোধন করা হোক। তিনি আরও বলেন, অনেক দেশেই দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল, রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনাল, সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার ট্রাইব্যুনাল, সেখানেও সংগঠনের বিচার করা হয়েছে। বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের রায়ে নাৎসী বািহনীকে এবং তাদের মতাদর্শকে এবং তাদের সহয়োগী গ্যাসটোপো বাহিনীসহ তাদের অন্যান্য সহযোগী বাহিনী ও তাদের কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ করা হয়। এখনো জার্মানীসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশে এই নাৎসী বাহিনীর মতাদর্শকে নিয়ে কাজ করে বা তাদের প্রতীক চিহ্ন ব্যবহার করে তা হলে তাদের শাস্তি দেয়া হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এতদিন পার হয়ে গেলেও নাৎসী বাহিনীর কোন সমর্থককে যদি খুঁজে পাওয়া যায় তাদের ধরে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। স্বাধীনতার এত বছর পার হলেও এখনও জামায়াতে ইসলামী সংগঠন হিসেবে জাতির কাছে একাত্তরের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াতে ইসলামীকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। প্রসিকিউশন সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের ধারা ২০ এ শুধুমাত্র ব্যক্তির শাস্তির বিধান আছে, কিন্তু সংগঠনের কথা উল্লেখ নেই। আইনের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, পার্সন (ব্যক্তি) শব্দটি আছে। সাধারণভাবে জেনারেল ক্লজেজ এ্যাক্ট এবং কোম্পানি আইনের অধীনে পার্সন বা ব্যক্তি বলতে ২ ধরনের ব্যক্তিকে বোঝায়। একটি ব্যক্তি আরেকটি কোম্পানি বা রেজিস্টার সংগঠনকে বোঝাবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে সে ক্ষেত্রে এই ব্যাখ্যা প্রযোজ্য হবে কি তা পরিষ্কার করা নাই। সুতরাং সংগঠনের বিচারের জন্য এই প্রস্তাবনাতেও সংশোধন এনে পার্সনের সঙ্গে এ্যান্ড আর্গানাইজেশন শব্দটি যোগ করা দরকার। একইভাবে আইনটির সূচনাতেও প্রারম্ভিক বক্তব্যের সংশোধন আনা প্রয়োজন। এখানেও এ্যান্ড আর্গানাইজেশন শব্দ দুটি যোগ করা দরকার। আইনের ধারা ২-এ এখানেও অর্গানাইজেশন সংজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। ধারা-৩-এ ১ উপধারায় আইনের আদালতে এখতিয়ার অর্গানাইজেশন শব্দটি আছে, এখানে সংশোধনের প্রয়োজন নেই। ধারা -৪ এ ২ এতে কোন সংগঠন বা বাহিনীর কমান্ডার বা উর্ধতন কর্মকর্তার শাস্তির আওতায় আনা হলেও এখানে সংগঠন শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। এখানে সংগঠন শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক সানাউল হক বলেছেন, আমরা দীর্ঘ ৫ বছর আগে রিপোর্ট দিয়ে রেখেছি। আমি মনে করি আইনটির সংশোধন হওয়া উচিত। আর ক্রিমিনাল সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার হওয়া উচিত। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও হয়েছে। জামায়াতের বিচারের মধ্য দিয়ে একাত্তরের তাদের অপকর্মের পরিসমাপ্তি ঘটবে। এর আগেও আইনটি সংশোধনের করা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনটির প্রথম সংশোধনী আনা হয়েছিল ২০০৯ সালে। দ্বিতীয় সংশোধনী আনা হয় ২০১২ সালে। আসামির অনুপস্থিতিতে তাকে পলাতক ঘোষণা করে বিচার করা এবং এক ট্রাইব্যুনাল থেকে অন্য ট্রাইব্যুনালে মামলা স্থানান্তর নিয়ে এই সংশোধনী আনা হয়। ২০১৪ সালের ২৫ মার্চ তদন্ত সংস্থা ক্রিমিনাল সংগঠন হিসেবে জামায়াতের ইসলামীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রদান করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের মূলত চারটি বিষয় নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে জামায়াতের রাজনৈতকি কৌশল, ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, শন্তির বিরুদ্ধে কৃত অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং গণহত্যা। এ ছাড়া প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি সংগঠনকে সামনে রেখে জামায়াতের অপরাধ তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জামায়াতের হাইকমান্ড (গোলাম আযম, মজলিসে শূরা), ছাত্র শাখা (ইসলামী ছাত্র সংঘ), জামায়াতের লিয়াজোঁ কমিটি (শন্তি কমিটি) অপরেশন কমিটি (রাজাকার, আলবদর, আলশামস), প্রোপাগান্ডা (দৈনিক সংগ্রাম)। এর আগে ট্রাইব্যুনালের বিভিন্ন রায়ে যুদ্ধাপরাধে দল হিসেবে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি উঠে আসে। সর্বশেষ গোলাম আযমের রায়ে জামায়াতকে একটি ‘ক্রিমিনাল সংগঠন’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। হান্নান খান জানান, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী ও তাদের তখনকার সহযোগী সংগঠনগুলো যে সারা বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটিয়েছিল, তার প্রমাণ তারা তদন্তে পেয়েছেন। তদন্তের ভিত্তিতে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, জেনেভা কনভেনশন ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন, মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা ও ষড়যন্ত্র এবং এসব অপরাধ ঠেকাতে ব্যর্থতাসহ নয় ধরনের অভিযোগ আনা হয় ওই প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জামায়াতে ইসলামী, তাদের সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ; পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা দিতে গঠিত শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদার ও আল শামস বাহিনী এবং জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ৪ এর ১ ও ৪ এর ২ ধারা অনুযায়ী অপরাধ করেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র বাংলাদেশে ২৫ মার্চ ১৯৭১ হতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত অভিযুক্ত সংগঠন “ জামায়াতে ইসলামী” তার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ, শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, ও আলশামস বাহিনী এবং জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩ আইনে ৩(২) ধারায় অপরাধ করেছে। এমন নয় ধরনের অপরাধ করেছে তা প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত। এ) মানবতাবিরোধী অপরাধ। সি) গণহত্যা, (ডি) যুদ্ধাপরাধ (ই) জেনেভা কনভেনশন ১৯৪৯ অনুযায়ী সশস্ত্র সংগ্রামের সময় মানবতা বিষয়ক আইনের লঙ্ঘন। (এফ) আন্তর্জাতিক আইনের অন্যকোন অপরাধ (জি) এমন অন্যকোন অপরাধের পদক্ষেপ গ্রহণ সেগুলোর সমর্থন আনা এবং ষড়যন্ত্র করা (এইচ) এ রকম অপরাধের সহায়তা করা অথবা বোধ করতে ব্যর্থ হওয়া। এ ছাড়া ৪(১) ও ৪(২) উর্ধতন দায় এবং এ সকল অপরাধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে। শুধুমাত্র সেকশন ৩ এর (বি) অংশ বাদ দেয়া হয়েছে। তা ছাড়া সব ধরনের অপরাধের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে।
×