ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অগ্নিঝরা মার্চ

প্রকাশিত: ১১:০৫, ২৭ মার্চ ২০১৯

অগ্নিঝরা মার্চ

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ উত্তাল একাত্তর। অপারেশন সার্চলাইট নামে বাঙালীর কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য বাঙালী নিধনে নামে পাকিস্তানী বাহিনী। শুরু হলো বাঙালীর প্রতিরোধের ইতিহাস। ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে দুর্বার মুক্তিযুদ্ধ; স্বাধীনতার জন্য অসম এক লড়াই। সুসংগঠিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নৃশংসভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে অপ্রস্তুত নিরীহ বাঙালীর ওপর। যেখানেই যাচ্ছে তারা জ্বালিয়ে ছারখার করে দিচ্ছে সব। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা হয়। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা যোগ দেন মহান মুক্তি সংগ্রামে। উত্তাল দিনগুলোর নীরব সাক্ষী হয়ে আছে ওই সময়ে প্রকাশিত পত্রপত্রিকাসমূহ। পাকিস্তানী বাহিনীর সেনা অভিযানের ফলে ঢাকায় পত্রিকা অফিসগুলো বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে ঢাকা থেকে যে পত্রিকাগুলো বের হতো তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল দৈনিক পাকিস্তান, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক সংগ্রাম, পাকিস্তান অবজারভার, মর্নিং নিউজ, দ্য পিপল ইত্যাদি। অভিযানকালে পাকিস্তানী বাহিনীর রুদ্ররোষের শিকার হয় দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ ও দ্য পিপল। পাকিস্তানী বাহিনী এ তিনটি পত্রিকা অফিস পুড়িয়ে দেয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবের সঙ্গে ৬ বার বৈঠকে মিলিত হন। শাসনতান্ত্রিক আলোচনার মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন এবং বৈঠকের নামে সময়ক্ষেপণ করে বাংলাদেশে সামরিক অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। সকালে সাময়িকভাবে কারফিউ তুলে নিয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থানরত সব বিদেশী সাংবাদিককে কড়া সেনাপ্রহরায় সরাসরি বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। বিশেষ বিমানে তাদের ঢাকা ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। সেনাবাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে দুজন সাংবাদিক অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় থেকে গিয়েছিলেন। তারা হলেন ডেইলি টেলিগ্রাফের সাইমন ড্রিং এবং এএফপির ফটোগ্রাফার মিশেল। গোটা ঢাকা শহর জুড়ে পাকহানাদার বাহিনীর নির্মমতার শিকার হাজার হাজার নিরীহ বাঙালীর প্রাণহীন দেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায়। বুড়িগঙ্গার ওপারে জিঞ্জিরায় মুক্তিযোদ্ধারা সমবেত হতে থাকেন। কারফিউ প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা শহর ছেড়ে দলে দলে নাগরিকরা অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে থাকে। চট্টগ্রাম শহরের চারপাশসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রচ- লড়াই শুরু করেন। দেওয়ানহাট থেকে পাকসেনাদের চারটি গাড়ি হালি শহরের দিকে এগোতে থাকলে ল্যান্স নায়েক আবদুর রাজ্জাক অতর্কিতে পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ করে কয়েকজনকে হত্যা করেন এবং গাড়িটি ধ্বংস করে দেন। ইপিআর সৈনিকরা এখান থেকে বেশ কিছু অস্ত্র এবং গোলাবারুদ উদ্ধার করেন। সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র হতে মেজর জিয়াউর রহমান ইংরেজীতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। মেজর জিয়াউর রহমান বলেন, ‘আমাদের মহান জাতীয় নেতা এবং বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। আমি আরও ঘোষণা করছি যে, শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের বাংলাদেশের সাত কোটি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একমাত্র নেতা। আমি তাই আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশ বিশেষভাবে পরাশক্তিসমূহ এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছে উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী পরিচালিত গণহত্যা বন্ধ করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী দ্বারা আইনসম্মত নির্ধারিত প্রতিনিধিদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দেয়া একটি নির্মম কৌতুক এবং এমন এক স্ববিরোধিতা যা কারো দৃষ্টি এড়াতে পারে না। আমাদের নতুন রাষ্ট্রের অনুসৃত নীতিমালা হচ্ছে প্রথমত নিরপেক্ষতা। দ্বিতীয়ত শান্তি এবং তৃতীয়ত সবার প্রতি বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। জয় বাংলা। এদিন ময়মনসিংহের বাঙালী ইপিআর ও মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণায় ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ২৭ মার্চ রাতে ময়মনসিংহের শহরতলির ইপিআর ক্যাম্পে পাকিস্তানী ইপিআর কর্মকর্তাদের পরিকল্পিত বাঙালী হত্যার ছক পাল্টে দেয়। রাতে টহলরত দুই পাকিস্তানী ইপিআর কর্মকর্তা বাঙালী ইপিআর সদস্যদের দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। শেখ হারুনসহ তার সহযোগীরা ওই নির্দেশ উপেক্ষা করে সজাগ ছিলেন। বাঙালী ইপিআর সদস্যরা ক্যাম্পের মাঠে রাখা ১২টি জিপে এলএমজি দিয়ে আক্রমণ চালায়। এরপর থেকেই পাকিস্তানী ইপিআর ও বাঙালী ইপিআর সদস্যদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। রাতভর যুদ্ধে বেশিরভাগ পাকিস্তানী ইপিআর সদস্য মারা যায়। এটাই ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রথম পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং বিজয়ের ইতিহাস। এইদিনে নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, টাইম পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ভারতীয় লোকসভায় ভাষণদানকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ প্রতিরোধ যুদ্ধ সম্পর্কে বলেন, পূর্ববঙ্গের সমগ্র জনগণ এক বাক্যে গণতান্ত্রিক কর্মপন্থা গ্রহণ করেছে। একে আমরা অভিনন্দন জানাই। ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ভারত সরকার পূর্ববঙ্গের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে সজাগ রয়েছে এবং যথাসময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
×