ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

যদিদং হৃদয়ং তব/তদিদং হৃদয়ং মম

প্রকাশিত: ১১:১৩, ২৭ মার্চ ২০১৯

যদিদং হৃদয়ং তব/তদিদং হৃদয়ং মম

সমুদ্র হক ॥ ‘যদিদং হৃদয়ং তব/তদিদং হৃদয়ং মম’...তোমার হৃদয় আমার হোক/আমার হৃদয় তোমার। বগুড়ায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিয়ের এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রের কথার মতো সম্প্রীতির বন্ধন যেন হৃদয়ের বন্ধনে এক হয়ে গেল। সামনে ঘোড়ায় চড়ে বর। এরপরই পালকিতে নববধূ। কামদেবের আশীর্বাদ এ দম্পতির স্বপ্নপূরণের দিকে নিয়ে যাবে এটাই প্রত্যাশা। ঘোড়া ও পালকির একেবারে সামনে বর আর কনের বাবা পথ দেখিয়ে দিচ্ছেন। জীবনের মধুছন্দ ভরিয়ে রাখতে বাজছে ব্যান্ডের সুর। বগুড়ায় এমন এক বিয়ের আয়োজনে এসেছিলেন সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ। বিয়ের অনুষ্ঠান যেন হয়ে উঠেছিল সম্প্রীতির এক মেলবন্ধন। অনেকের মুখে মুখে ফিরছিল বাংলাদেশই সম্প্রীতির এক উর্বর ভূমি। এখানে সব ধর্মের মানুষ তাদের সুখ দুঃখের আনন্দ-বেদনা ভাগাভাগি করে নেয়। সম্প্রতি বগুড়ার মালতীনগর বৌ বাজারের বর অমিত ভট্টাচার্য ও রহমাননগরের কনে ঋজিশ^া চক্রবর্তীকে নিয়ে যখন বাসি বিয়ে (হিন্দু রীতিতে মূল বিয়ের পরদিনের আনুষ্ঠানিকতাকে বলা হয় বাসি বিয়ে। অনুষ্ঠানে যখন যাচ্ছিল তখন সড়কের দুধারের লোকজন হাত নেড়ে নবদম্পতিকে পুষ্পবর্ষণে আশীর্বাদের অদৃশ্য মালা পরিয়ে দিচ্ছিল। অনেকে বলছিল, সম্প্রীতির এমন বন্ধনেই তারা যেন জীবন গড়ে তোলে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এই বিয়ের কনের মা নেপালী। বগুড়ার ছেলে সজল দত্ত প্রায় ২২ বছর আগে নেপালের কাঠমান্ডুতে গিয়ে বিয়ে করেন সরোজা চক্রবর্তীকে। সেই থেকে তারা নিজেদের ঘরে বাংলাদেশ নেপাল অদৃশ্য বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছেন। বৌ বাজারের প্রদীপ ভট্টাচার্যের ছেলে অমিতের সঙ্গে যখন বিয়ের কথা পাকা হয় তখন দুই পরিবার একমত হয়েছিল সন্তানদের বিয়ে দেবেন বাঙালী ঐতিহ্যের আবহে। সজল বাবু বললেন তিনি বরযাত্রীদের উড়োজাহাজে চার্টার করে নেপালে নিয়ে গিয়েছিলেন। এরপর শুরু হয়ে গেল ঐতিহ্যের বিষয়গুলো খুঁজে বের করার পালা। এখন তো আর ঘোড়া বেশি দেখা যায় না। পালকি খুঁজে পাওয়াও চাট্টিখানি কথা নয়। কোন দূর গ্রামে কার ঘরে পালকি আছে, তার অবস্থাই বা মহলে কেমন। জরাজীর্ণ হয়ে থাকলে তো বউ বসার সঙ্গেই বেহারাকে আর টানতে হবে না। কনে ছাতনা তলার বদলে অন্য কোন তলায় গিয়ে পড়বে। যা হোক অনেক খুঁজে শেষ পর্যন্ত একটা পালকি পাওয়া গেল। ঘোড়াও মিলল। বর ঘোড়ায় বসলে যদি ঘোড়া ছুটতে শুরু করে তাহলে তো বরের অবস্থাও একই হবে। অতএব সহিস জোগাড় হলো। প্রাচীন আমলে রাজা-বাদশারা যেমন ঘোড়ায় বা হাতিতে চড়ে বিশাল ছাতার নিচে বসতেন তেমনি লম্বা হাতলের ছাতাও জোগাড় হলো। এবার বরকে ঘোড়ায় চড়িয়ে আর কনেকে পালকিতে বসিয়ে বের হলো শোভাযাত্রা। প্রথমে ওদের নেয়া হলো মালতীনগরের মন্দিরে। এরপর নগরীর সড়ক ধরে বর-কনেকে নিয়ে গেল নিজ বাড়িতে। বাসি বিয়ের আগের দিন কনের পান পাতায় ঢাকা চোখ খুলে বরের সঙ্গে শুভদৃষ্টি ও মালাবদলের পর পুরোহিত মশাই ছাদনা তলায় মন্ত্র পড়ে জুটি বেঁধে দেন। এরপর কলসির মতো দেখতে মঙ্গলঘটের আনুষ্ঠানিকতার পর মূল বিয়ে হয়ে যায়। বাসি বিয়ের মূল অনুষ্ঠান হোমযজ্ঞ। মাটি খুঁড়ে পাটখড়িতে আগুন জ্বালানোর পর বর-কনে সাত পাঁকে ঘুরে কনের সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দেবে বর। এই আনুষ্ঠানিকতার পর অবশ্য বাসর রাত হবে না, কালরাত। এই রাতে বর বউকে দেখবে না। কেন বাসর হয় না আর কেনই কালরাত সে সম্পর্কে সাংস্কৃতিক কর্মী ও নাট্যশিল্পী নিভা রানী সরকার বললেন, বেহুলা-লখিন্দরের পৌরাণিক কিংবদন্তির ঘটনা মনে করে মনসা দেবীর সন্তুষ্টি লাভের জন্য বহুকাল ধরে এ রীতি পালন করা হচ্ছে। তবে প্রতীকী বিষয়টি হলো- নবদম্পতির কল্যাণ কামনা। যেন কোন অশুভ শক্তি ক্ষতি করতে না পারে, কোন মনসা যন ছোবল না দেয়। বগুড়া নগরীতে রাতের বিয়ের এই অনুষ্ঠানে যারা অতিথি ছিলেন তাদের অনেককেই বলতে শোনা যায়- সম্প্রীতির বন্ধন সব অনুষ্ঠান যদি এমন হতো আমরা একে অপরের আনন্দ-বেদনা ভাগাভাগি করে নিতে পারতাম কতই না ভাল হতো। বর-কনের অভিভাবকরা বললেন, বিয়ের লগ্ন ছিল অনেক রাতে। বলাবলি হচ্ছিল এত রাতে এই বিয়েতে কি কারও কোন অসুবিধা হবে! না, কোন অনুবিধাই হয়নি। উল্টো পাড়াপড়শী সবাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। অতিথিরা তো ছিলেনই বর যখন কনেকে নিয়ে যায় তখন বাদ্যের তালে হাততালি দিয়ে তাকে স্বাগত জানানো হলো। পালকির বেহারারা ‘হুম্্ না হুম্্ না’ সুর তুলল। কনে পালকির পর্দা সরিয়ে লাজুক চাহনী দেয়। বর তো বলেই ফেলল দিই না ঘোড়াকে নিয়ে এক দৌড়। বরের বাবা শুধায়- জীবনের দৌড়ে প্রথম হওয়ার প্রস্তুতি নাও। সম্প্রীতির বন্ধন যেন চির অম্লান থাকে।
×