ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উৎপাদন ব্যয় বেশি পড়ার নেপথ্যে

গ্যাস উন্নয়ন তহবিল থেকে ঋণ নিয়ে দেনায় বাপেক্স

প্রকাশিত: ১১:১৩, ২৭ মার্চ ২০১৯

গ্যাস উন্নয়ন তহবিল থেকে ঋণ নিয়ে দেনায় বাপেক্স

রশিদ মামুন ॥ দেশে কাজ করা আন্তর্জাতিক তেল গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন এ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স) গ্যাস উত্তোলনে বেশি খরচ করছে। দেশীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাপেক্স কম দামে গ্যাস দেবে এমন আশা করা হলেও বাস্তবতা হঠাৎই উল্টে গেছে। জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক হোসেন মনসুর বলেন, কোনভাবেই এজন্য বাপেক্স দায়ী নয়। গ্যাস খাতের স্বনির্ভরতার বদলে বাপেক্স এর রিগ এবং জনবল বসিয়ে রাখা হয়েছে। বাপেক্স যে কিছু করতে পারে না, বাপেক্সকে দিয়ে কিছু হবে না এটি প্রমাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যাতে বিদেশী কোম্পানি এই সুযোগে স্থলভাগে কাজ করতে পারে সেই পরিস্থিতি একটু একটু করে সৃষ্টি করা হচ্ছে। যা কোনভাবেই মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। পেট্রোবাংলা আপস্ট্রিম গ্যাসের ঘনমিটার প্রতি যে উৎপাদন ব্যয় দেখিয়েছে তাতে দেশে সব থেকে বেশি দামে বাপেক্সই গ্যাস উত্তোলন করছে বলে উল্লেখ রয়েছে। দেশের অন্য বিতরণ কোম্পানি যেখানে প্রতি ঘনমিটার এক টাকার অনেক নিচে গ্যাস উত্তোলন করছে সেখানে বাপেক্স এর ঘনমিটার প্রতি উৎপাদন ব্যয় তিন টাকার উপরে। যা দেশে কাজ করা আইওসি’র চেয়ে বেশি। পেট্রোবাংলা জানিয়েছে, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড ঘনমিটার প্রতি দশমিক ৭০৯৭ টাকা, সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি দশমিক ২০২৮ টাকায় এবং আন্তর্জাতিক তেল গ্যাস কোম্পানি (আইওসি) দুই দশমিক ৫৫ টাকায় গ্যাস উত্তোলন করছে। সেখানে বাপেক্স ঘনমিটার প্রতি খরচ করছে তিন দশমিক ০৪১৪ টাকা। দেশের কোন কোম্পানির উৎপাদন ব্যয় আইওসির চেয়ে বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাপেক্স এর ক্ষেত্রে তা হচ্ছে। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান রুহুল আমিন বলেন, তিনি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবেন না। বাপেক্স পৃথক কোম্পানি তার হিসেব আলাদা। বাপেক্স-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মীর মোহাম্মদ আবদুল হান্নান অসুস্থ থাকায় এ বিষয়ে তার মতামত জানা সম্ভব হয়নি। প্রসঙ্গত পেট্রোবাংলা একটি কর্পোরেশন। বাপেক্স পেট্রোবাংলারই একটি কোম্পানি। নিয়ম অনুযায়ী বাপেক্স এর নিয়ন্ত্রক সংস্থা হচ্ছে পেট্রোবাংলা। জ¦ালানি বিভাগ এবং পেট্রোবাংলার নির্দেশনার বাইরে গিয়ে বাপেক্স এর কাজ করার কোন সুযোগ নেই। কেন বাপেক্স এর উৎপাদন ব্যয় বেশি সে সম্পর্কে অনুসন্ধানে নেমে দেখা গেছে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল থেকে ঋণ নিয়ে বাপেক্স দেনার দায়ে জড়িয়ে পড়েছে। বাপেক্স সূত্রগুলো বলছে, বাপেক্সকে বসিয়ে রেখে প্রায় আড়াইগুণ বেশি দামে বাপেক্স এর গ্যাস কূপ খননের কাজ দেয়া হয়েছে বিদেশী কোম্পানিকে। যেসব বিদেশী কোম্পানিকে কাজ দেয়া হয়েছে তারা নিজেরা কাজ না করে সস্তায় অন্য দেশের ঠিকাদার দিয়ে কাজ করিয়ে পয়সা তুলে নিয়ে গেছে। অন্যদিকে দেনার দায়ে ডুবেছে বাপেক্স। বাপেক্স সূত্র বলছে, যেখানে বাপেক্স মাত্র ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকায় কূপ খনন করে সেখানে বিদেশী কোম্পানিকে দিয়ে কূপ খনন করতে ব্যয় হয়েছে ১৮০ কোটি টাকা পর্যন্ত। গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের টাকা থেকে ঋণ নিয়ে কূপ খনন করা হয়। এই ঋণের দায় যখনই বাপেক্স-এর ওপর এসে পড়ছে তখনই উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া অনুসন্ধান ব্যয় এসে বাপেক্স-এর ঘাড়ে পড়াতে সামগ্রিক ব্যয় বেশি হচ্ছে। উৎপাদন খরচের সঙ্গে যা যোগ হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাপেক্সের এক কর্মকর্তা জানান, গত বছর থেকে বাপেক্স কিছু কাজ করেছে। এর আগে চার বছর ধরেই বাপেক্স বসেই ছিল। কিন্তু এ সময়ও বাপেক্স-এর গ্যাস ক্ষেত্রে কূপ খনন করা হয়েছে। বাপেক্সকে বসিয়ে রেখে কূপ খনন করা হয়েছে। আর যেসব কূপ খনন করা হয়েছে সেগুলোতেও খুব একটা উৎপাদন বাড়েনি। যাতে করে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। বাপেক্স এর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোর্তজা আহমেদ ফারুক বলেন, বাপেক্স বিস্তৃত পরিসরে অনুসন্ধান করে। যেগুলো কোম্পানির ব্যয়ে যোগ হয়। এছাড়া এই ব্যয় বৃদ্ধির জন্য বিদেশীদের দিয়ে নিজেদের কূপ খনন করার বিষয়টি উল্লেখ করেন তিনি। গ্যাস কোম্পানির মধ্যে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি (বিজিএফসিএল) দৈনিক ৭৭২ মিলিয়ন ঘনফুট, বাপেক্স ১০৮ মিলিয়ন ঘনফুট, সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি (এসজিএফসিএল) ১২৪ মিলিয়ন ঘনফুট এবং আইওসি এক হাজার ৭১২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, এখানে বাপেক্স সরকার নির্ধারিত দর প্রতি ঘনমিটারে ৮৮ পয়সা পাওয়ার কথা না। কিন্তু সে ব্যয় করছে তিন টাকার ওপরে। কিভাবে এটি সমন্বয় হবে তার কোন ঠিক নাই। তিনি বলেন, এভাবে সক্ষমতা বৃদ্ধির বদলে বাপেক্সকে দেনার দিকে ঠেলে দিচ্ছে সরকার। এতে গ্যাস খাতের মারাত্মক ক্ষতি হবে। যা এক সময় ভোক্তাদের ওপর বর্তাবে।
×