ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

এস এম মুকুল

অর্গানিক চাষাবাদ ॥ উৎপাদন বাড়বে ও খরচ কমবে

প্রকাশিত: ১২:০৫, ৩১ মার্চ ২০১৯

অর্গানিক চাষাবাদ ॥ উৎপাদন বাড়বে ও খরচ কমবে

জৈব কৃষিপদ্ধতি কৃষকদের জন্য লাভজনক। কারণ, এই পদ্ধতি কৃষিকাজে অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে, পরিবেশগত ক্ষতি পোষাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দক্ষিণ কোরিয়ার পালডাংয়ের জানজিতে অনুষ্ঠিত ১৭তম বিশ্ব অর্গানিক সম্মেলনে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড অপরচুনিটিস অন অর্গানিক ফার্মসের (ডব্লিউডব্লিউওওএফ-বাংলাদেশ) পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জমির এ সম্ভাবনাময় দিক উপস্থাপনার মাধ্যমে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও অর্গানিক পণ্য উৎপাদনকারী সংস্থাগুলো বলছে, জৈব চাষের জন্য বাংলাদেশের জমি সবচেয়ে উপযুক্ত। তাদের মতে, বাংলাদেশের মাটির ভলিউম এবং সূর্যালোকের প্রাচুর্যের কারণেই খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি সমানুপাতিক হারে বায়োমাস তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে। ডব্লিউডব্লিউওওএফের উপস্থাপনায় বলা হয়, বাংলাদেশের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ হওয়ায় এখানে প্রাকৃতিক কৃষি চাষাবাদের সম্ভাবনা অনেক বেশি। এখানে তাপমাত্রা কখনও মাইনাসের নিচে নামে না। ফলে সারা বছর প্রকৃতিতে জৈব উপাদানের প্রাচুর্য বজায় থাকে। এর ফলে গাছপালাও পুষ্ট হয়, প্রকৃতিও সতেজ ও সবুজ থাকে। এ আবহাওয়া কাজে লাগিয়ে ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে প্রাকৃতিক চাষাবাদে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে বাংলাদেশ, যা সারা বিশ্বের জন্য মডেল হতে পারে। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে জৈবভাবে উৎপাদিত শস্য প্রচলিত পদ্ধতিতে উৎপাদিত শস্যের চেয়ে ১৮০ গুণ কম রাসায়নিক পদার্থ পরিবহন করে যা মূলত আসে অজৈব সার এবং কীটনাশক থেকে। জৈব কৃষিক্ষেত্র মাটিতে অধিক কার্বন সংরক্ষণে সহায়তা করে এবং মাটির ক্ষয় রোধ করে মাটির পুষ্টি উপাদান বৃদ্ধি করে। এটি মাটি এবং পানি দূষণ কমানোর পাশাপাশি গ্রীনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে ভূমিকা পালন করে। জৈব চাষাবাদে কৃষকের আগ্রহ বাড়াতে হবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা পত্রে দেখা গেছে, দেশের মোট জমির অন্তত ১০ শতাংশ অর্গানিক পণ্য উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত। বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্গানিক পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অর্গানিক সুগন্ধি চাল, শাক-সবজি, ফল, মাশরুম, চা, অর্গানিক পাট, অর্গানিক মাছ ও অর্গানিক মাংস উৎপাদনের ক্ষেত্রেই বেশি নজর দিতে হবে। এ জন্য প্রথমেই প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও আইনকানুন তৈরির জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। গবেষণায় দেখানো হয়েছে, অর্গানিক পণ্য উৎপাদনের উপযুক্ত জমি হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী অঞ্চল, নদী ও উপকূলীয় চরাঞ্চল এবং বসতভিটার আঙিনা ও চারপাশ, এবং নগর এলাকার বাড়িঘরের ছাদগুলোকে নির্বাচন করা যেতে পারে। ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অব অর্গানিক এ্যাগ্রিকালচার স্ট্যাটিসটিকস এ্যান্ড এমার্জিং ট্রেন্ড ২০১৮’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান অর্গানিক এ্যাগ্রিকালচার এফআইবিএল। এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান হতাশার। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে আরও বলা হয়েছে, ২০১৩ সালের পর থেকে বাংলাদেশে অর্গানিক চাষাবাদের জমি বাড়ছে না। ২০১৬ সালে ১০১টি অর্গানিক চাষাবাদের প্রকল্প চালু ছিল বাংলাদেশে; যাতে ৯ হাজার ৩০৩ জন উদ্যোক্তা সম্পৃক্ত রয়েছেন। তবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার অর্গানিক চাষাবাদ বাড়াতে ‘ন্যাশনাল অর্গানিক এ্যাগ্রিকালচার পলিসি-২০১৬’ বাস্তবায়ন ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘ন্যাশনাল অর্গানিক স্ট্যান্ডার্ড বোর্ড’ গঠনের পরিকল্পনা নিয়েছে। যদিও সেটি এখনও পরিকল্পনা পর্যায়েই রয়ে গেছে। বাংলাদেশে মাত্র ছয় হাজার ৮৬০ হেক্টর জমিতে অর্গানিক পণ্যের চাষাবাদ হচ্ছে, যা মোট আবাদি জমির মাত্র দশমিক ১ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে বর্তমানে ৫৭ দশমিক ৮ মিলিয়ন জমিতে অর্গানিক চাষাবাদ হচ্ছে, যা মোট জমির ১.২ শতাংশ। অপরদিকে এশিয়া মহাদেশে অর্গানিক চাষাবাদের হার দশমিক ৩ শতাংশ। অর্গানিক চাষাবাদে সবচেয়ে ভাল অবস্থানে রয়েছে চীন ও ভারত। আর সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভাল অবস্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা। অর্গানিক কৃষি প্রযুক্তিতে বাংলাদেশের অগ্রগতি একবারে কম নয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রত্যাশা ভবিষ্যতে বিজ্ঞানভিত্তিক অর্গানিক পণ্যই বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করবে এবং বিদেশে রফতানি করে কোটি কোটি ডলার আয় করবে। এতে কৃষক পণ্যের অধিক মূল্য পাবেন এবং পরিবেশ ও প্রতিবেশও থাকবে দূষণমুক্ত। বাংলাদেশ অর্গানিক প্রডাক্ট ম্যানুফ্যাকচারি এ্যাসোসিয়েশন (বিওপিএমএ) এর মাধ্যমে ইতোমধ্যে দেশের এক লাখ একর জমিকে অর্গানিক কৃষির আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। আগামী ২০২০ সালের মধ্যে পুরো দেশকে অর্গানিক কৃষির আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্য নিয়ে সংস্থাটি কাজ করছে। আমরা উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, আফ্রিকার দেশ উগান্ডার কথা। দেশটির কৃষকরা সমসাময়িক আবহাওয়া ও মাটির গঠন নিয়ে অর্গানিক কৃষি আবাদে বিপ্লবের ডাক দেন। বর্তমানে দেশটির কৃষকরা ৭০-৮০ কোটি ডলারের অর্গানিক কৃষিপণ্য রফতানি করছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার পালডাংয়ের জানজি এলাকা জৈব কৃষি চাষের জন্য বিখ্যাত। জানজির কৃষকদের সফলতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সামগ্রিক কৃষির টেকসই উন্নয়নে অর্গানিককে গুরুত্ব দিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সিউল। একটি ছোট্ট এলাকায় অর্গানিক পদ্ধতিতে আবাদ-সাফল্য গোটা দক্ষিণ কোরিয়ার সামগ্রিক কৃষি পরিকল্পনায় বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশে বিপ্লব ঘটাতে পারে ‘আইপিএম কার্যক্রম’ বাংলাদেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ‘আইপিএম কার্যক্রম’ জৈব কৃষির বিস্তারে বিপ্লব ঘটিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের কৃষি বিভাগ ‘আইপিএম’ পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এ পদ্ধতিতে বিশেষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফসলের খেতের পোকা দমন করা হয়, যাতে করে রাসায়নিক কীটনাশকের ওপর কৃষকের নির্ভরতা কমে আসে। ‘আইপিএম পদ্ধতির’ বা ‘সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার’ মাধ্যমে বালাই দমন ব্যবস্থাপনায় যেসব উপাদান- পণ্য রয়েছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো উপকারী বন্ধু পোকার লালন ও পোকার সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করা। জৈব কৃষিতে উৎপন্ন শাক-সবজি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশের বাজারে রফতানির কার্যক্রম আমাদের কৃষিকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে, বয়ে আনতে পারে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। অর্গানিকের বৈশ্বিক বাজার বিশ্বের ১৭৯টি দেশে অর্গানিক কৃষিপণ্যের আবাদ করা হচ্ছে। বিশ্বের ২৪ লাখ কৃষক এখন প্রায় ৫ কোটি ১০ লাখ হেক্টর জমিতে অর্গানিক কৃষিপণ্যের আবাদ করছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কৃষক রয়েছে ভারতে ৫ লাখ ৮৫ হাজার। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ইথিওপিয়ায় অর্গানিক কৃষিপণ্য উৎপাদনকারীর সংখ্যা ২ লাখ ৩ হাজার ৬০২। ২ লাখ কৃষক নিয়ে পরবর্তী অবস্থানে রয়েছে মেক্সিকো। অন্যদিকে জমি আবাদের দিক থেকে শীর্ষ তিনে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, আর্জেন্টিনা ও যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় ২ কোটি ২৭ লাখ হেক্টর, আর্জেন্টিনায় ৩১ লাখ ও যুক্তরাষ্ট্রে ১০ লাখ হেক্টর জমিতে অর্গানিক কৃষিপণ্য আবাদ হচ্ছে। ইউরোপীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান এফআইবিএলের এক গবেষণায় দেখা যায়, গত এক দশকে অর্গানিক কৃষি পণ্যের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩০০ শতাংশ। অর্গানিক পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ফ্রান্স। আগামী কয়েক বছরে এটি ১৩৮ বিলিয়র ডলারে দাঁড়াবে। ১৬৪ দেশে বর্তমানে সার্টিফাইড অর্গানিক পণ্য সারা পৃথিবীতে রফতানি করছে। এর বেশির ভাগ দেশই বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত। তাই একটি কৃষিভিত্তিক দেশ হিসাবে বাংলাদেশে অর্গানিক পণ্য উৎপাদন ও রফতানির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ হবে কৃষিপণ্য রাসায়নিক সারের পরিবর্তে উচ্চ পুষ্টিমানসম্পন্ন প্রযুক্তিতে উৎপাদিত জৈব সার সবজি ও ধান গাছে প্রয়োজনীয় ইউরিয়া, পটাশ ও ফসফেট সারের জোগান দেয়। আধা-কম্পোস্ট গোবর, মুরগির বিষ্ঠা, ধানের কুঁড়া, মাছ-মুরগির পাখনা ও পরিপাকতন্ত্র তথা পরিত্যক্ত অংশ একসঙ্গে করে জৈব কম্পোস্ট সার তৈরি করা হয়। জৈবসার প্রয়োগ করলে আর অতিরিক্ত ইউরিয়া, পটাশ ও টিএসপি সার প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। এছাড়া মাটির উর্বরতা ও স্বাস্থ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়। উৎপাদিত ফসল হয় স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ। অর্গানিক ফার্মিং জমির জীব ও উদ্ভিদবৈচিত্র্য বাড়ায়, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। পাশাপাশি জমির প্রবল বৃষ্টিপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবেলা করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে, যে জমিতে সর্বশেষ রাসায়নিক সার ব্যবহার করে চাষাবাদ করা হয়েছে সেই জমি ন্যূনতম তিন বছর পতিত অবস্থায় ফেলে রাখলে বা পুনরায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ ছাড়া চাষ করলেই অর্গানিক খাদ্য উৎপাদন করা সম্ভব। কারণ চাষাবাদে ব্যবহৃত বহুল প্রচলিত রাসায়নিক সারের অবশিষ্টাংশ তিন বছরে ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। অর্গানিক ফার্মিংয়ে বা জৈব কৃষিতে কৃত্রিম কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না বটে, কিন্তু সমালোচকরা বলেন, বহু প্রকৃতিদত্ত কীটনাশক পরিবেশের জন্য কম ক্ষতিকর নয়। জৈব সার দিয়ে চাষ করলে প্রথম এক থেকে দুবছর ফলন কিছুটা কম হবে। তবে চার থেকে পাঁচ বছর পর রাসায়নিক সার দিয়ে চাষ করা জমির তুলনায় ফলন বেশি হবে। জৈবসার প্রয়োগ ও জৈব কীটনাশক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধানসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল এবং সবজির উৎপাদন খরচ শতকরা ২৫-৩০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। জৈবসার ব্যবহার করলে ফসলের উৎপাদন খরচ রাসায়নিক সারের চেয়ে শতকরা ৫০-৬০ শতাংশ কম হয়। জৈব পদ্ধতিতে জমিতে দীর্ঘ ও স্বল্প দৈর্ঘ্যরে মূল বিশিষ্ট সবজির সমন্বয় ঘটিয়ে মাটির উর্বরতা সংরক্ষণ করা সম্ভব। কম খরচে শস্যে এ ধরনের জৈব কীটনাশক ব্যবহার করে কৃষকদের অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যও রক্ষা করা সম্ভব।
×