ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ আখতারুজ্জামান

ঐতিহ্য ও অর্জনে বিসিআইসি

প্রকাশিত: ১২:০৭, ৩১ মার্চ ২০১৯

ঐতিহ্য ও অর্জনে বিসিআইসি

বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) উৎপাদন, আমদানি ও মাঠপর্যায়ে ইউরিয়া সার সরবরাহের মাধ্যমে দেশ খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে বাংলাদেশে পরিবর্তনের যে যুগান্তকারী সূচনা ঘটছে, সেই পথ নির্দেশিকায়, সার শিল্পের সম্প্রসারণ একটি অনিবার্য বিষয়। দেশে সারের ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে সামনে রেখে অন্যান্য খাতের মতো সার শিল্পকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে। সেক্ষেত্রে দেশের শিল্প সেক্টরে বিসিআইসির নাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশকে কাক্সিক্ষত মধ্যম আয়ের দেশ বিনির্মাণের পূর্ব শর্ত হচ্ছে কৃষিজাত পণ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জন। এ ধারায় দেশের সার শিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের কোন বিকল্প নেই। ১৯৭৬ সালের ১ জুলাই বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার কেমিক্যাল এ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল কর্পোরেশন, বাংলাদেশ পেপার এ্যান্ড বোর্ড কর্পোরেশন এবং বাংলাদেশ ট্যানারিজ কর্পোরেশন এর সমন্বয়ে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির ২৭নং অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) যাত্রা শুরু করে। বিসিআইসির নিয়ন্ত্রণাধীন মোট ৮টি সার কারখানা রয়েছে। দেশের কৃষিতে বছরে প্রায় ২৫ লাখ টন ইউরিয়া সারের চাহিদা রয়েছে। বিসিআইসি নিয়ন্ত্রণাধীন ইউরিয়া সার কারখানাগুলো পুরনো হয়ে যাওয়ায় কারখানাগুলো পরিপূর্ণভাবে উৎপাদনশীলতা বজায় রাখতে পারছে না। এমনি একটা বাস্তব পরিস্থিতির মুখে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে অবস্থিত ষাটের দশকে স্থাপিত বার্ষিক ১ লাখ ৬ হাজার টন ক্ষমতাসম্পন্ন ন্যাচারাল গ্যাস ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেডকে বন্ধ করে ২০১৬ সালে একই জায়গার উপরে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর, শক্তি সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব দৈনিক ১,৭৬০ টন এবং বার্ষিক ৫ লাখ ৮০ হাজার ৮০০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন শাহজালাল সার কারখানা স্থাপন করা হয়। কারখানাটি স্থাপনের ফলে একদিকে দেশে আমদানি নির্ভরতা কমেছে অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে। শাহজালাল সার কারখানা ১৬৫ একর জমির উপর চীনের কমপ্লান্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের মাধ্যমে নির্মাণ কাজ শুরু হলে ২০১৬ সালে কারখানাটি বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে। দেশের চাহিদার বিপরীতে নিজস্ব উৎপাদন ছাড়াও প্রতিবছর প্রায় ১৭ লাখ টন ইউরিয়া সার ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা টন মূল্যে আমদানি করে সরকার নির্ধারিত মূল্য ১৪ হাজার টাকা টন করে সরবরাহ করতে হয়। সেক্ষেত্রে দেশে নতুন সার কারখানা স্থাপন করা হলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানির মাধ্যেেম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে। সে লক্ষ্যে গত ১৪ অক্টোবর বিসিআইসি ও জাপানের ঐতিহ্যবাহী মিৎসুবিশি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ লি. (এমএইচআই) ও চায়না ন্যাশনাল কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কনসোর্টিয়াম কোং লি.-এর সঙ্গে ৯ লাখ ২৪ হাজার টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন গ্যাস সাশ্রয়ী অত্যন্ত আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ঘোড়াশাল পলাশ সার কারখানা নির্মাণের জন্য এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ঘোড়াশাল পলাশ সার কারখানা বাস্তবায়নের মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৪৬০ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এদিকে পুরনো সার কারখানাগুলোর যন্ত্রপাতি আধুনিকায়নের মাধ্যমে আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে কয়েকটি কারখানা পুনর্বাসন কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। ইউরিয়া সার উৎপাদন কাঁচামাল হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার হয়ে থাকে। কিন্তু দেশে আবাসিক, বিদ্যুত এবং শিল্প সেক্টরে গ্যাসের চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে সার কারখানাগুলো বন্ধ রেখে অন্য সেক্টরগুলোতে গ্যাস নিশ্চিত করতে হয়। ফলে উচ্চ মূল্যে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে আমদানির মাধ্যমে দেশে ইউরিয়া সারের চাহিদা নিশ্চিত করা হয়। এমতাবস্থায়, বর্তমান সরকার বিভিন্ন সেক্টরে গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে খঘএ আমদানি করছে। এই খঘএ জাতীয় গ্রীডে প্রেরণের ফলে দেশে একদিকে যেমন গ্যাসের চাহিদা মিটবে অন্যদিেেক দেশের শিল্প সেক্টরসহ বিসিআইসির ইউরিয়া সার কারখানাগুলোর উৎপাদনশীলতা বজায় থাকবে। সেক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে ইউরিয়া সার আমদানি অনেকাংশে হ্রাস পাবে। সারকারখানা ছাড়াও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় রয়েছে এশিয়ার বৃহত্তম কাগজ কল কর্ণফুলী পেপার মিলস লি., সুনামগঞ্জের ছাতক সিমেন্ট কারখানা লি., চট্টগ্রামের কালুরহাটে উসমানিয়া গ্লাসশিট ফ্যাক্টরি লি., চট্টগ্রামের বাড়বকুন্ডে চিটাগাং কেমিক্যাল কমপ্লেক্স, ঢাকার মিরপুরে বিআইএসএফ লি. এবং পলাশে অবস্থিত দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন কারিগরি বিষয়ে নিয়োজিত ব্যক্তিদের ক্রমবর্ধমান প্রশিক্ষণের প্রয়োজন মেটাতে রসায়ন শিল্পের জন্য বিসিআইসি নেদারল্যান্ড সরকারের সহযোগিতায় কারিগরিসহ বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের জন্য ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ (টিআইসিআই) স্থাপন করেছে। যেখানে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ের বিভিন্ন শিক্ষার্থীগণ হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও দেশের রাসায়নিক শিল্প কারখানাসমূহের জনবলের কারিগরি দক্ষতা ও কারিগরি সেবা প্রদান সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় ‘মডার্নাইজেশন এ্যান্ড স্ট্রেংদেনিং অব ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। উৎপাদন এবং অব্যাহত উৎপাদনশীলতাই একমাত্র এ গতিকে বেগবান করতে পারে। পাবলিক সেক্টরÑপ্রাইভেট সেক্টরসহ সর্বক্ষেত্রে সমন্বিত প্রচেষ্টার ফলে কাক্সিক্ষত অর্জন ধরে রেখে আমাদের আগামীতে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া কোন অবাস্তব স্বপ্ন নয়। স্বপ্ন তখন বাস্তবে কথা বলবে এবং জাতিরজনকের সোনার বাংলার সোনালি আভা চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে।
×