ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা সেলিম

তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্বসভায় নেতৃত্বে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৯:২৪, ১৪ এপ্রিল ২০১৯

তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্বসভায় নেতৃত্বে বাংলাদেশ

জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের উদ্যোগে জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের ব্যবস্থাপনায় ২০০৩ সালে জেনেভায় ও ২০০৫ সালে তিউনিসে মোট দুই দফায় তথ্যপ্রযুক্তি খাতে রাষ্ট্রগুলোর করণীয় নির্ধারণে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যা ডব্লিউএসআইএস বা ‘ওয়ার্ল্ড সামিট অন দি ইনফরমেশন সোসাইটি’ নামে পরিচিত। উভয় সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের প্রায় শতাধিক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান অংশ নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিরাজমান ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ বা প্রযুক্তি বৈষম্য মোচনে নিজেদের দেশের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। ২০০৩ সালে জেনেভা সম্মেলনে গৃহীত ঘোষণাপত্র অনুযায়ী দেশে দেশে তথ্যপ্রযুক্তি উন্নয়নে কর্মকৌশল ও বাস্তবায়ন পরিকল্পনা নেয়া হয়, যার ফলোআপ হিসেবে প্রতিবছর জেনেভা ফোরামে অগ্রগতিগুলো পর্যালোচনা করা হয়ে থাকে। ২০১৯ সালে এই ফোরামের দশমতম বার্ষিক অধিবেশনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। সারা পৃথিবীর নানা প্রান্তের তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, সংশ্লিষ্ট সরকারী মন্ত্রণালয় ও বিভাগ, রাষ্ট্রদূত এবং নীতিনির্ধারণী মহলের প্রতিনিধিত্বসহ প্রায় দুই হাজার মানুষ সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় সমবেত হয়েছেন এপ্রিলের ৮ থেকে ১২ তারিখে। বাংলাদেশের মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এ বছরের বিশ্বসভার এই ফোরামে নেতৃত্ব দিয়েছেন, বাংলাদেশের জন্য এটা খুবই ভাল খবর, বিশেষ করে যারা তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সঙ্গে যুক্ত তারা জানেন ডিজিটাল বাংলাদেশের এই আসন প্রায় নির্ধারিত হয়েই ছিল। কারণ বাংলাদেশ কতদূর এগিয়েছে বিশ্ববাসী তা খুব ভালভাবেই এখন জানে। এ বছরের ফোরামে সরকারী প্রতিনিধিদলে বেসরকারী সংস্থার সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে আমি নিজেও অংশ নিয়েছি। প্রতিনিধিদলে সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের সচিবসহ বাংলাদেশ টেলিকম রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাগণ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এছাড়া বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী, সরকারের নানা মহলের কর্মকর্তা, বেসরকারী নানা উদ্যোগের প্রতিনিধিগণ এই ফোরামে অংশ নিয়ে বিশ্বসভায় বাংলাদেশের অঙ্গীকার ও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতিই মূলত ব্যক্ত করেছেন। ফোরামের ফরমেটে প্রথমেই ছিল দুইদিনব্যাপী উচ্চপর্যায়ের মোট ১৪টি বিষয়ভিত্তিক সভা, যেগুলোতে বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী থেকে শুরু“করে বিশেষজ্ঞ, একাডেমিক ও বেসরকারী খাতের সফল উদ্যোক্তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করেন। এই সভাগুলো যারা পরিচালনা করেছেন তারা সকলেই জেনেভা ঘোষণাপত্র ও কর্মকৌশল বাস্তবায়নের কুশলী এবং অভিজ্ঞ। এদের সকলেই চেয়ারম্যান মোস্তাফা জব্বার ও আইটিইউ মহাসচিব হাউলেন ঝাউ-এর উপস্থিতিতে তাদের সভাগুলোর প্রতিবেদন আলোচনার জন্য পেশ করেন, যার সারমর্ম চেয়ারম্যান হিসেবে বাংলাদেশের মন্ত্রী উপস্থাপন করেন। এ ছাড়া মন্ত্রী পর্যায়ের প্রতিনিধিবর্গের একটি গোল-টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যা চেয়ারম্যান হিসেবে মোস্তাফা জব্বার পরিচালনা করেন। উচ্চপর্যায়ের এই দুটি পর্বের আনুষ্ঠানিকতা ও পরিচালনায় বাংলাদেশের মন্ত্রীর সাবলীল ভূমিকা ফোরামে অংশগ্রহণকারী ও আয়োজক জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থাগুলোর ব্যাপক প্রশংসা পায়। এবারের ফোরামে অন্যতম আরও একটি বিষয় ছিল তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দুনিয়ার নানা দেশের ও প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবনী কাজ নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রদর্শনীর আয়োজন, যা ফিতা কেটে যুগ্মভাবে উদ্বোধন করেন আইটিইউর মহাসচিব ও বাংলাদেশের মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। এক্ষেত্রেও এই সম্মান ছিল উৎসাহজনক। এই অনুষ্ঠানে মোস্তাফা জব্বারের সঙ্গে ফিতা কাটার সময় যুক্ত হন জেনেভার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একদল শিশু শিক্ষার্থী, যা ছিল আগামী প্রজন্মের কাছে তথ্যপ্রযুক্তির সেবা প্রতিশ্রুতি তুলে দেয়ার একটি প্রতীকী আয়োজন। বাংলাদেশের মন্ত্রীর সঙ্গে শিশুদের এই মিলনমেলা অনুষ্ঠানের মাত্রাকে একটি অনবদ্য আনন্দঘন পর্যায়ে নিয়ে যায়। ডব্লিউএসআইএস ফোরামের শুরু থেকেই প্রতিবছর তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিভিন্ন দেশের উদ্ভাবনী কাজ নিয়ে বেশকিছু প্রতিযোগিতামূলক পুরস্কার দেয়া হয়। এই বছর বাংলাদেশ পেয়েছে মোট পাঁচটি পুরস্কার। সেও ছিল এই আয়োজনে বাংলাদেশে সাফল্যের একটি অন্যতম সংযোজন। বাংলাদেশের সরকারী ও বেসরকারী প্রতিনিধিদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, প্রায় সব ক’টি সেশনে ভাগ হয়ে যোগ দেয়া ও অন্যদের কাছ থেকে জেনে নিজেদের অগ্রগতির তুলনা-বিচার করে নেয়াও একটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। ফোরামের চেয়ারম্যান হিসেবে প্রচুর ব্যস্ততার মধ্যেও সময় পেলেই নিজ দেশের প্রতিনিধিগণের সঙ্গে বাংলাদেশের মন্ত্রী দিনের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়গুলো ভাগ করে নিয়েছেন, যা আমার বহুদিনের এ জাতীয় অভিজ্ঞতায় বিরল। এই বিষয়ে কোনই সন্দেহ দুনিয়ার কোথাও নেই যে, ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন একটি ভিন্ন রকম মাত্রায় পৌঁছেছে, যা আইটিইউ মহাসচিব থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি সেশনে আলোচিত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন একটি উদাহরণের নাম। মন্ত্রী পর্যায়ের গোল-টেবিল সংলাপের সমাপনী আয়োজনে মোস্তাফা জব্বারের ভূমিকার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে মহাসচিব হাউলেন ঝাউ কোন রাখঢাক ছাড়াই উল্লেখ করেন, এত প্রাণবন্ত ও প্রফেশনাল চেয়ারম্যান গত ফোরামগুলোতে আইটিইউ পায়নি। বিশ্বসভায় বাংলাদেশের এই সরব উপস্থিতি দেশের ভবিষ্যতের জন্য একটি নতুন ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করে। এখন বিবেচনার বিষয় হলো আমরা যতদূর এগিয়েছি তা ধরে রাখা ও অব্যাহত প্রচেষ্টায় আরও উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যেতে নিজেদের সক্রিয় রাখা। ডব্লিউএসআইএস প্রক্রিয়া যখন শুরু হয় আমরা যারা এর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলাম তখন আমাদের এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল যে, সরকারী উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা ছাড়া বিশ্বসভায় আমরা কখনও নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে পারব না। দুর্ভাগ্যবশত শীর্ষ সম্মেলনের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকার অংশ নিয়েছিল বটে; কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কোন উৎসাহ বা প্রেরণা দিতে তখনকার সরকারের উচ্চপর্যায়ে কোন রাজনৈতিক ভিশন বা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল না। তাছাড়া সে সময়ের একশ্রেণীর কূটনীতিক শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের বিষয়কে খুব দুর্বলভাবে উপস্থাপন করায় আমরা যারা চেয়েছিলাম দেশের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তির বৈশ্বিক প্রণোদনায় ব্যাপক আলোচনা ও উৎসাহ তৈরি করতে তা খুব একটা আমল পায়নি। সে সময়ের সংসদের প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করলে তিনি আমাদের ব্যাপক উৎসাহিত করেন ও কফি আনানের আমন্ত্রণে তিউনিস পর্বে নিজে উপস্থিত থাকার সম্মতি দেন। শেষ মুহূর্তে ঝালকাঠির দুই বিচারক হত্যার উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তিনি যেতে না পারলেও তার পক্ষ থেকে তৎকালীন বিশেষ সহকারী (বর্তমান তথ্যমন্ত্রী) ড. হাছান মাহমুদকে পাঠিয়েছিলেন। এই বিষয়ে ড. হাছান মাহমুদ গোড়া থেকেই আমার সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন ও আমাদের কাজে প্রচুর সময় দিয়েছেন। তিনি তিউনিস পর্বে বেশ কয়েকটি সেশনে বক্তব্য দেন, যেগুলোতে বাংলাদেশের ভবিষ্যত সরকারের তথ্য সমাজ সৃষ্টির ইঙ্গিত ছিল। ‘আইসিটি ফর পিস’ বা ‘শান্তির জন্য তথ্যপ্রযুক্তি’ সেশনে ড. হাছান মাহমুদের জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য তিউনিস পর্বে বিশেষ সমাদৃত হয়েছিল। মূলত ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার রাজনৈতিক ইশতেহার ঘোষণার মাধ্যমেই তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় হয়। গত এগারো বছরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো নানা উদ্ভাবনী উদ্যোগের স্বীকৃতি হিসেবে টেলিকমিউনিকেশন ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিভিন্ন শাখায় জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রায় সব ক’টি নামী-দামী পুরস্কার দেশে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশের মোবাইল ফোনের চাহিদার ও সেবার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে, ইউনিয়ন পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা ছড়িয়েছে, ঘরে ঘরে কম্পিউটার ব্যবহার বেড়েছে, তরুণ সমাজ নানারকম উদ্ভাবনী কাজে সরকারী-বেসরকারী প্রণোদনা পাচ্ছে, স্বাস্থ্য-শিক্ষা, সরকারী সেবা ও সামাজিক উন্নয়নের অপরাপর খাতে তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ দেশে একটি ডিজিটাল আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে। দেশের সফটওয়্যার রফতানি লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ছুঁই-ছুঁই করছে ও মোবাইল অর্থনীতিসহ ডিজিটাল বাণিজ্যে নানারকম স্থানীয় উদ্ভাবনী উদ্যোগ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করেছে। এরকম একটি বাস্তবতা সৃষ্টি করতে সমর্থ দেশের কাছে এখন ধীরে ধীরে তথ্যপ্রযুক্তির বৈশ্বিক নেতৃত্ব এসে পড়বে এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কিন্তু আমাদের তা ধরে রাখতে হবে। বর্তমানে সবচেয়ে জরুরী হলো এসডিজি-এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমাদের সবগুলো অর্জন সমবেত করে বিশ্বসভায় জোর গলায় উপস্থাপন করা। ২০১৭ সাল থেকে প্রতিবছর জুলাই মাসে মোট তিন পর্বে জাতিসংঘ তার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার যে উচ্চপর্যায়ের পর্যালোচনা সভা করে সেখানে এ বছর (শেষ পর্বে) বাংলাদেশের উপস্থিতি জোরদার হওয়া দরকার। বিশেষ করে জুলাই পর্যালোচনায় এ বছরের জন্য নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ৪, ৮ ও ১০-এর আলোচনায় তথ্যপ্রযুক্তি সংশ্লেষে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অর্জন তুলে ধরার সুযোগ আছে। এ বছর সেপ্টেম্বরে সাধারণ সভার মাঝামাঝি সময়ে (২৪ ও ২৫ সেপ্টেম্বর) রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের নিয়ে নিউইয়র্ক সদর দফতরে অনুষ্ঠিত হবে ‘এসডিজি সামিট’ বা শীর্ষ পর্যায়ের সম্মেলন। জুলাই থেকে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় এই সম্মেলনে ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি রক্ষার আন্দোলনের সাফল্য তুলে ধরে বাংলাদেশ বিশ্বসভায় তার আসন মজবুত করে রাখতে পারবে। আমাদের সেরকম উদ্যম ও সাহসী ভূমিকা দরকার। তাহলে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা ২০২১ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশ ও ২০৪১ সালে বাংলাদেশের উন্নত বিশ্বে নাম লিখাতে খুব একটা কঠিন হবে না। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×