ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কেন সারা পৃথিবী আমাদের সহায়তা করছে না?

প্রকাশিত: ০৯:৩১, ১৪ এপ্রিল ২০১৯

 কেন সারা পৃথিবী আমাদের সহায়তা করছে না?

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল দিনটি ছিল বুধবার। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রদত্ত এক ভাষণে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল সফরের জন্য বিশ্বের সকল বার্তাজীবী এবং রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের প্রতি আমন্ত্রণ জানান। তিনি সকল বন্ধুরাষ্ট্রের সরকার ও জনগণের এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা, যথা রেডক্রস ইত্যাদির প্রতি সরাসরি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানান। ঢাকার মৌলভী ফরিদ আহমদের সভাপতিত্বে শান্তি কমিটির স্টিয়ারিং কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামকে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের চক্রান্ত আখ্যা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ধ্বংস করার শপথ ঘোষণা করে হানাদার ও সহযোগীরা। ভোর থেকেই মেঘনা নদীর পশ্চিম তীর ভৈরব থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাকিস্তানী এফ-৮৬ বোমারু বিমান থেকে আশুগঞ্জ সাইলো, পাওয়ার স্টেশন, রেলস্টেশন, লালপুর ও আশুগঞ্জ বন্দর এলাকায় বোমা হামলা চালাতে থাকে। এর কিছুক্ষণ পরই ৬-৭টি পাকিস্তানী হেলিকপ্টার থেকে সোহাগপুর, সোনারামপুর গ্রামে ছত্রীসেনা নেমে গণহত্যায় মেতে ওঠে। সোহাগপুর থেকে পাকিস্তানী কমান্ডোরা মেঘনা নদীর তীর হয়ে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন সংলগ্ন এলাকাগুলোতে ৪৬ জনসহ অনেক নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে। পাকিস্তানী বাহিনী আশুগঞ্জ রেলস্টেশন এলাকায় পৌঁছলে সেখানে অবস্থানরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। বিকালে লালপুরে পাকিস্তানী সৈন্যরা গানবোট নিয়ে হামলা চালায়। রাতে ভৈরবে অবস্থানরত সব অবাঙালীকে ৩টি লঞ্চে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়। ভয়াবহ যুদ্ধের পর ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা আশুগঞ্জ ছেড়ে পশ্চাদপসারণ করে। ভৌগোলিক কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আশুগঞ্জ বন্দরটি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় পাকিস্তানী সৈন্যরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বৃহত্তর কুমিল্লা ও সিলেটসহ এতদঞ্চলে ঢুকতে পারছিল না। তাই তারা যে কোন মূল্যে আশুগঞ্জের দখল নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। আর এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য পাকিস্তানী হানাদারবাহিনী আধুনিক সমরাস্ত্রসহ তাদের সর্বশক্তি নিয়ে আশুগঞ্জ দখলের মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই আক্রমণে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে বহু নিরীহ মানুষ ও মুক্তিকামী বাঙালী সৈন্য মৃত্যুবরণ করেন। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একটি ব্রিগেড কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হয়। পাকবাহিনী উজানিসার ব্রিজের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের কাছাকাছি এলে মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধে পাকবাহিনীর একজন অফিসারসহ ১৭৩ জন সৈন্য নিহত হয়। সারাদিন মধুপুর গড়ে মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে প্রচ- যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত পাকসৈন্যরা প্রাণ বাঁচাতে পিছু হটে কালিহাতী ও ঘাটাইল অঞ্চলে অবস্থান নেয়। প্রথম রেজিমেন্ট চৌগাছা থেকে হেড কোয়ার্টার তুলে নিয়ে বেনাপোলের ৩ মাইলপূর্বে কাগজপুকুর গ্রামে স্থাপন করে এবং যশোর বেনাপোল রাস্তার দু’ধারে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। দিনাজপুরের খানসামা এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নীলফামারী থেকে আগত পাকবাহিনী আক্রমণ চালায়। ঠাকুরগাঁও পঞ্চগড় এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ পাকসেনারা আক্রমণ করে এবং আগুনে বোমার সাহায্যে পঞ্চগড় শহরকে সম্পূর্ণরুপে জ্বালিয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা শহর ছেড়ে অমরখানায় ডিফেন্স নেয়। সকাল ৯টায় পাকবাহিনী কুড়িগ্রামের খলিলগঞ্জ এসে জেলখানার উত্তরে অবস্থান গ্রহণ করে। পাকসেনারা জেল অফিসে কর্মরত হেড ক্লার্ক ও সিপাইসহ পাঁচজনকে গুলি করে হত্যা করে। রাজশাহী শহরের লক্ষ্মীপুর গার্লস স্কুলের সামনে পাকসেনারা মোশাররফ হোসেন সন্টুসহ ৩০ জনকে সমবেত করে। এদের মধ্য থেকে মঈনউদ্দিন আহমদ মানিক, আশরাফ হোসেন রতন ও মাসুদ রানা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দৌড়ে পালায়। বাকি সবাইকে পাকহানাদাররা গুলি করে হত্যা করে। পাকবাহিনী সান্তাহার পৌঁছালে বিহারীরা হানাদারদের সঙ্গে মিলিত হয়ে আশপাশের গ্রামগুলো ঘেরাও করে এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অগণিত মানুষকে হত্যা করে। এ হত্যাযজ্ঞ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ‘সান্তাহার গণহত্যা’ নামে পরিচিত। পাকবাহিনীর দুটি কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধাদের রাজারহাট ও কুলারহাট অবস্থানের ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এ সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধারা স্থান দুটি ছেড়ে দিয়ে পিছু হটে। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এলাকাতে ক্যাপ্টেন আফতাব কাদেরের নেতৃত্বে একটি কোম্পানি, বুড়িঘাট ও রাঙ্গামাটির মধ্যস্থলে একটি কোম্পানি নিয়ে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান, রাঙ্গামাটি ও বরফকলের মধ্যস্থলে লে. মাহফুজ একটি কোম্পানি নিয়ে এবং কুতুবছড়ি এলাকাতে সুবেদার মুতালেব একটি কোম্পানি নিয়ে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নেয়। প্রচ- যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনী কুমিল্লার কসবা পাকিস্তানী সেনাদের কাছ থেকে পুনর্দখল করে নেয়। এদিন মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে পাকশী সেতুর কাছে তীব্র সংঘর্ষ হয়। নিউইয়র্ক টাইমসের ভাষ্য: ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লার মতো শহরে এখন সম্ভবত ২০ থেকে ২৫ শতাংশ লোক রয়েছে। সম্পূর্ণভাবে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদলের সামরিক আক্রমণে যারা বেঁচে গেছেন তারা প্রায় সবাই প্রতিরোধকারীদের দলে যোগ দিয়েছেন। দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা ’চীনা প্রতিক্রিয়া ভারতের জন্য হুমকি’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে লিখেন, চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ইয়াহিয়া খানকে এক বার্তায় বলেছেন পূর্ববাংলায় পাকিস্তানের সামরিক কর্মকে তিনি সমর্থন করেন এবং চীনের সর্বাত্মক সাহায্য বজায় থাকবে। এটি ভারতের জন্য হুমকি বলে এখানকার পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। সরকারী সূত্র অবশ্য জানিয়েছে ইন্দো-চীন সীমান্ত বরাবর কোন সেনা সমাবেশ দেখা যায়নি। সরকারী সূত্র গতকাল বার্তা সম্পর্কে মন্তব্য করতে রাজি হননি কিন্তু চীন সম্পর্কিত পর্যবেক্ষকরা মনে করেন এতে করে ভারতবিরোধী ইস্যুতে ইসলামাবাদের মনোবল বাড়বে। চীনা মনোভাব একটু উগ্র হলেও পূর্ববাংলার ইস্যুতে ইন্দো-পাকিস্তান অবস্থানে চীন সরাসরি জড়িত নয়। পর্যবেক্ষকরা বলেন, ‘জনগণের’ সরকার চীন পূর্ববাংলায় একটি সংখ্যালঘু সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে সেখানকার ‘জনগণের’ আন্দোলনের প্রতি সামান্যতম সহানুভূতি দেখাচ্ছে না। চীনা বিষয়ক ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বিশ্বাস করেন যে চীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থান নিয়েছে। খবর এএফপি প্যারিস থেকে। এইদিন দ্য অস্ট্রেলিয়ানে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাদেশ বিদ্রোহের পরিস্থিতি দিনকে দিন হৃদয়বিদারক ও দুঃখজনক হয়ে উঠছে। সকল শ্রেণীর মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থনে, নিজেদের স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে এই বিংশ শতাব্দীতে প্রায় অপ্রস্তুত ও ন্যূনতম অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া এমন ব্যাপক আন্দোলন আর কোনটি হয়নি। পূর্ব বাংলায় প্রায় ২০০ মাইল যাত্রা শেষে ভারতীয় সীমানা থেকে ৯০ মাইল দূরে, এখানকার মানুষের এখন মূল চাহিদা হচ্ছে আরও বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই আন্তর্জাতিক সহায়তা। স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বল্পস্থায়ী প্রভাব বলা যায় এটাকে। পাঁচ ডিভিশনেরও বেশি পাকিস্তানী সেনা এখন তিন দিনের সফরে দ্রুত গতিতে বাংলাদেশের দখলে থাকা শহরগুলো কব্জা করতে এগিয়ে যাচ্ছে। এই তিন দিনের সফরে আমি শহরের ব্যস্ততম এলাকাগুলোতে, প্রশাসনিক কার্যালয়গুলোতে, রাস্তার পাশের ওষুধের দোকানগুলোতে, সেনানিবাসগুলোতে শুধু একটি আকুতিই শুনেছি, ‘কেন সারা পৃথিবী আমাদের সহায়তা করছে না?’ লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×