ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘ঢাকা এখন মৃত্যুপূরী’ সংবাদ সংস্থা এএফপি

প্রকাশিত: ০২:৩০, ১৫ এপ্রিল ২০১৯

‘ঢাকা এখন মৃত্যুপূরী’ সংবাদ সংস্থা এএফপি

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ ১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার । এইদিন মুক্তিবাহিনীর ‘এ’ কোম্পানি কাকিনা নামক স্থানে, ‘বি’ কোম্পানি পাটেশ্বরী ঘাটে, ‘সি’ কোম্পানি পাটের ঘাটের বাম দিকে রৌমারী সড়কে এবং ‘ডি’ কোম্পানি ফুলবাড়ি থানায় ডিফেন্স নেয়। হানাদার পাকবাহিনীর আক্রমণে ভৈরবের পতন হয়। ভৈরব এলাকায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও অমানুষিক নির্যাতন চালায় এবং লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ধ্বংসযজ্ঞের এক মর্মস্পশী দৃশ্য রচনা করে। সকালে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পাকবাহিনী তিস্তার দিকে পিছু হটার সময় রেল লাইনের দুধারের বাড়িঘরে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ করে। নগরবাড়ি ঘাটে পাকবাহিনী ফেরি থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর মর্টার ছুঁড়ে। পাকবাহিনীর এ আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের অবস্থান থেকে ১০ কিলোমিটার পিছিয়ে বগুড়া মহাসড়কের ডাববাগান এলাকায় এসে অবস্থান নেয় এবং শত্রুবাহিনীর জন্য ত্রিমুখী ফাঁদ তৈরী করে। পাকবাহিনী চুয়াডাঁঙ্গায় প্রচন্ড বিমান হামলা চালায়। এ হামলায় অসংখ্য নিরস্ত্র নিরীহ মানুষ নিহত হয়। পাকবাহিনী হাজীগঞ্জ বাজারে প্রবেশ করে। অপরদিকে কলিমুল্লাহর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল চাঁদপুর ও ফরিদগঞ্জ থেকে ডাকাতিয়া নদীর পারে সমবেত হয়ে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১০টি ট্রাক ও ৮টি জিপে করে গুলি করতে করতে ঠাকুরগাঁও শহরে প্রবেশ করে। আতঙ্কে ঠাকুরগাঁও বাসী শহর ছাড়তে শুরু করে। অল্পক্ষণের মধ্যে শহর হয়ে যায় ধু-ধু জনশূন্য। তিতাস নদীর পূর্ব পাড়ে শাহবাজপুরের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা একটি প্রতিরক্ষা ব্যুহ্য রচনা করে। বিকালে পাকবাহিনীর হাতে ঝিনাইদহের পতন ঘটে। মধুপুরের প্রতিরোধ ব্যুহ্য ভেঙ্গে পড়ে। তাই এটিকে সরিয়ে এনে প্রথমে জামালপুরের দিগপাইতে ও পরে শেরপুরের চরাঞ্চলে স্থাপন করা হয়। বেলা ১১ টায় ঠাকুরগাঁও শহরে রাত যাপনকারী কয়েকজন লোক, কয়েকজন ছাত্র নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন আদালত প্রাঙ্গণে। গ্রাম থেকে লোকজন তখনো পুরোপুরি আসেনি। মাইকে ঘোষনা করা হচ্ছিলো- পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে, আমাদের অগ্রগামী বাহিনী সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টের কাছে পৌছে গেছে ইত্যাদি-ইত্যাদি। হঠাৎ শহরের দক্ষিণ প্রান্তে বিকট শব্দে একটা শেলের বিস্ফোরণ হলো। মানুষ তখন দিগবিদিক জ্ঞান হারা হয়ে ছুটতে শুরু করলো উত্তর দিকে। সবারই এক উদ্দেশ্য-টাউন ছাড়তে হবে, টাঙ্গন নদীর ওপারে যেতে হবে। গ্রাম থেকে আরো প্রত্যন্ত এলাকা হয়ে সীমান্তে পাড়ি জমানোর উদ্দেশ্যেমূলক নিরুদ্দেশ যাত্রার যাত্রী হয়ে পালাতে লাগলো সবাই। পিছনে তাকিয়ে অনেকেই দেখলো দাউ দাউ করে জ্বলছে এসডিও সাহবের বাংলো। গোটা শহরের আকাশে কেবল আগুনের কুন্ডুলী। নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে বালিয়াডাঙ্গী, আটোয়ারী, পঞ্চগড় ও হরিপুরের সীমান্ত এলাকা দিয়ে কয়েক হাজার মানুষ আশ্রয় নিলো ভারতীয় শরনার্থী শিবিরে । এদিকে সৈয়দপুর সেনানিবাসের সাজোয়া ইউনিট ও ট্যাংকের সামনে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা একে একে পিছু হটে আসছিলো যা কেউই সাধারণ মানুষকে জানায়নি। সাধারণ মানুষ ছিল বেশ অসহায়। মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে হটতে পঞ্চগড়ে গিয়ে ডিফেন্স নেন। লে. মাহফুজ খাগড়াছড়িতে মেজর জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করে সুবেদার খায়রুজ্জামান, করিম, ইঞ্জিয়ার ইসহাক, ফারুক আহম্মদ, শওকত আলী প্রমুখকে নিয়ে রাঙামাটি বুগিঘাট বাজারে আসেন ও অবস্থান নেন। এখান থেকে তারা পাকবাহিনীকে অতর্কিতে আক্রমণ করে ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন। চট্টগ্রামের রাজাঘাট এলাকা পাকবাহিনীর দখলে চলে যায়। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছ থেকে কুমিল্লার গঙ্গাসাগর পুনরুদ্ধার করে। মুক্তিবাহিনী কয়েকদিন ধরে প্রতিরোধ যুদ্ধের পর রাজশাহী শহরের অবস্থান ছেড়ে দেয়। ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ জনসাধারণকে কর ও খাজনা পরিশোধের জন্য নির্দেশ দেয়। নিউজিল্যান্ডের ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী মার্শাল এক বার্তায় বলেন, ‘আমরা আশা করি, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান গৃহযুদ্ধের অবসানের ব্যবস্থা করবেন। করাচীতে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, সরকার ন্যায়সঙ্গত কারণেই আওয়ামী লীগকে বেআইনী ঘোষণা করেছেন। ঢাকায় ‘নাগরিক শান্তি কমিটি’-র নাম পরিবর্তন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি’ রাখা হয়। রাজা ত্রিদিব রায়- এর আহ্বানে পাকবাহিনী রাঙ্গামাটি শহরে এসে পৌঁছায়। ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র পরিষদ’-এর সভাপতি রশিদুল কবির ও সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক সহযোগী ছাত্রদের সেনাবাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে শত্রু (মুক্তিযোদ্ধা) খতমের নির্দেশ দেয়। সংবাদ সংস্থা এএফপির খবর বলা হয়, ঢাকা এখন মৃত্যুপূরী। রাস্তায় খুবই কম লোক দেখা যায়। অনেক লোক শহর ছেড়ে চলে গেছেন। যারা ঢাকা থেকে পালাতে চাচ্ছেন তাদের বাধা দেয়া হচ্ছে। সৈন্যরা ঘরে ঘরে তল্লাশি চালাচ্ছে, তরুনদের আটক করে নিয়ে যাচ্ছে। অন্যান্যদের সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করছে। শান্তি ও কল্যাণ স্টিয়ারিং কমিটি, জেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের সংগঠকদের ১৫ দিনের মধ্যে পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে ১২ ধানমন্ডি, রোড নং-৫ এ যোগাযোগের নির্দেশ দেয়। পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনী চূয়াঁডাঙ্গায় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের তথ্য পেয়ে ১২ এপ্রিল থেকে ব্যাপক বোমা বর্ষণ করে। ভারত সরকার গোপনীয়তা বজায় রেখে ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণের কার্যক্রম গ্রহণ করে। প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ গভীর রাতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে শপথ গ্রহণের বিষয়টি অবহিত করেন। কলকাতা থেকে এ.পির বরাতদিয়ে দৈনিক কালান্তর সংবাদ প্রকাশ করে, সাম্প্রতিক রক্তপাতের পরিপ্রেক্ষিত ঢাকা এখন আতঙ্কের নগরী। পশ্চিম পাকিস্তানের একশ্রেণীর নাগরিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নির্বিবাদে লুটতরাজ, হত্যাকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, সৈন্যরা নীরব দর্শকের মত দাড়িয়ে সন্ত্রাস মূলক কার্যকলাপ দেখে যাচ্ছে। প্রধানত: একটি অবাঙ্গালি প্রধান এলাকায় মৃত্যুভয়কে প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী করে সেখানাকার মানুষ কাল কাটাচ্ছেন। শহরের একটি সমৃদ্ধ অঞ্চল ধানমন্ডির একটি বড় আবাসিক স্কুলে কয়েক হাজার মানুষ আশ্রয় লাভ করেছেন। অনেককেই ক্রমে ক্রমে মেরে ফেলা হচ্ছে। কাউকে কাউকে জীবন্ত কবর দেওয়া হচ্ছে। হিন্দুদের জবাই করার জন্য বেছে রাখা হয়েছে। শত শত হিন্দুকে মেরে ফেলা হয়েছে। হত্যালীলা চলছে। সরকারী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের তিন অফিস কর্মচারীর মৃতদেহ গত শুক্রবার নদীর ধারে পড়েছিল। তাদের গুলি করে মারা হয়েছে। ঢাকার এক ইউরোপীয় নাগরিক বলেছেন, ছ’ জনের একটি পরিবার তাদের বাড়ির রাস্তাতেই খুন হয়েছেন। একজন কূটনৈতিক: প্রতি রাতেই গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতাদের খুঁজে ফিরছে সৈন্যের দল। শত শত লোক এক অজানা আশঙ্কায় প্রতিদিন শহর ছেড়ে যাচ্ছেন। তারা কেউ সাইকেলে, কেউ বা হেঁটে, অনেকে বাসে চেপে চলে যাচ্ছেন। প্রত্যেকটি বাস উদ্বাস্তু আর তাদের আত্মীয়-স্বজনে ভর্তি। ঢাকার সবচেয়ে বড় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এখন সামরিক কর্তৃত্বে। গোপন ভ্রমণকারীদের পক্ষে আসন জোগাড় করা কঠিন ব্যাপার। ঢাকায় ইনফরমারের ভয় রয়েছে আর বিশ্বাসঘাতকতা একটা স্থায়ী বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অমৃত বাজার পত্রিকা ইউ এন আই বরাতে ’কুমিল্লায় ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুক্তিফৌজের উপর প্রচ- আক্রমণ’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে,কুমিল্লায় মুক্তিফৌজ এর একটি দুর্গ পাক সেনারা ঘিরে ফেলেছে - দেরি হয়ে যাবার আগে তারা সেখানকার সাপ্লাই লাইন ধ্বংস করতে চায়। পাকসেনারা সেখানে আজ তীব্র আক্রমণ করে। তারা গোমতী নদী দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে বাংলাদেশের পূর্ব অঞ্চলের সাথে যোগাযোগের মূল সংযোগ আখাউরা- ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাব সেক্টর রক্ষার চেষ্টা করে। তিন কোম্পানি পাকিস্তানি সেনার সাথে পাকিস্তান এয়ার ফোর্স এর চারটি বিমান যোগ দেয়। তারা কসবা সহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তীব্র বোমাবর্ষন করে। উত্তর সেক্টরে লিবারেশন ফোর্স দিনাজপুর শহরে শক্ত অবস্থান নিয়ে আছে। সেখানে গত রাতে তারা একটি যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে। পূর্ব সেক্টরে পাকিস্তানের হামলায় দেখা যায়। তারা গুরুত্তপূর্ন আখাউড়া রেলওয়ে জংশন যা মিটার গেজ দিয়ে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের সাথে যুক্ত সেটা রক্ষা করতে চাইছে। জংশনটি যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর দখলে। পাকিস্তানের কৌশল দৃশ্যত ঢাকা ভিত্তিক। তারা মুক্তিফৌজকে সিলেট ময়মনসিংহ অঞ্চলে নিবন্ধ রাখতে চেষ্টা করবে। এটাকে বলা হচ্ছে "অপারেশন ঢাকা"। ঢাকা থেকে ১৮ কিলোমিটার অদূরে - সাভারে - আজ সকালে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের উপর ব্যাপকভাবে ঝাঁপিয়ে পরে। কুষ্টিয়া জেলা শহর বাংলাদেশ বাহিনীর দখলে। ভয়েস অব এমেরিকার মতে তাদেরকেও পাকিস্তান বিমান বাহিনী ও আর্টিলারি আক্রমণ করেছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা ভেড়ামারা, কামার খালি এবং শিলাইহদ এলাকা থেকে বিতাড়িত হয়েছে। বিমান বাহিনীর ভারী বোমা বর্ষণ সত্ত্বেও মুক্তিবাহিনী গোয়ালন্দে তাদের দখল বজায় রেখেছে। নগরবাড়িতে ১৫০ জন পাকিস্তানি সৈন্য মুক্তিবাহিনী ঘিরে রেখেছে বলে রিপোর্ট করা হয়। এমনকি মুক্তিফৌজ মুক্ত এলাকায় একত্রিত হচ্ছে - সদ্য ঘোষিত বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কাজ চালানোর জন্য তারা পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তার সমাধানে আজ সাত দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। নিউইয়র্ক টাইমস ’অর্থনৈতিক দুর্যোগ’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে, পূর্ব পাকিস্তানের অনেক অঞ্চলে কৃষকরা তাদের ধানের বীজ বপন করছে না কারণ পাকিস্তানি আর্মি এবং বাংলার স্বাধীনতা বাহিনীর কারণে তারা সামনে আসতে ভয় পায়। ১০০০ কিলোমিটার জুড়ে পশ্চিম পাকিস্তানে 'টেক্সটাইল মিলস' সস্তা তুলা পণ্য উৎপাদন করছে যার একমাত্র বাজার হল পূর্ব পাকিস্তান। তবে সেগুলো সেখানে বিক্রি করা যাচ্ছে না যতক্ষণ পাকিস্তানি বাহিনী স্বাধীনতা আন্দোলনকে নির্মূল করে এবং যুদ্ধ শেষ না করে। গত তিন সপ্তাহের যুদ্ধে প্রচুর জীবন নষ্ট হবার পাশাপাশি দেশের উভয় অঞ্চলের অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। যদিও এই সংবাদদাতা পূর্ব পাকিস্তানে কোন প্রকার ক্ষুধা দেখেন না, তবে গ্রামাঞ্চলে খাদ্য শস্য কম এবং কিছু এলাকায় দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয়। এমনকি স্বাভাবিক সময়ে পূর্ব পাকিস্তানকে একটি ক্ষুধার্ত এলাকা বলা হতে পারে, কারণ এখানে বার্ষিক খাদ্যশস্যের ঘাটতি ২৫ মিলিয়ন টন। পূর্ব পাকিস্তানে বিদেশী সাংবাদিকদের প্রবেশের উপর পাকিস্তানি সরকার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। পূর্ব বঙ্গের বঙ্গোপসাগরের বন্যাকবলিত ঘনবসতিপূর্ন কিছু বদ্বীপের কোন খবরই পাওয়া যায় না। গত বছরের নভেম্বরে একটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানায় কয়েক লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায়। এতে সেখানকার সকল ফসল ধ্বংস হয়। ত্রাণ সরবরাহের ফলে প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ বেঁচে আছে। মার্চ মাসের প্রথম দিকে রাজনৈতিক সংকট শুরু হয় এবং সেনা বাহিনী সাধারণ মানুষের উপর আক্রমণ চালায় যার ফলে ঘূর্ণিঝড় ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় খাদ্য সরবরাহ হ্রাস পায়। বিদেশী কূটনীতিক এবং অন্যেরা চিন্তিত আছেন যে সেখানে খাদ্য সমস্যা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মারাত্মক আকার ধারণ করবে । বর্ষা আসার সাথে সাথে- কারণ এই সময়ে দক্ষিণের কিছু এলাকায় প্রায় যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। প্রায় পাঁচ মাসের জন্য এই অবস্থা বলবত থাকে। এ ছাড়াও এটি অনুমান করা হয় যে প্রায় ১০০০০০ ঘূর্ণিঝড় থেকে বেঁচে থাকা মানুষ এখনো ঘর বা আশ্রয়হীন। বর্ষাকালে তারা করুন অবস্থার মুখোমুখি হবে। যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক সংকট বাড়বে। পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী - যা সম্পূর্ণরুপে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা গঠিত- তারা খাদ্য, , চা বাগান এবং পাটকলগুলি ধ্বংস করছে। যারা প্রতিরোধ করছে তারা গেরিলা কৌশল অবলম্বন করছে। তারা রেল লাইনগুলি উধাও করে দিচ্ছে, সেতু উড়িয়ে দিচ্ছে এবং সেনাবাহিনীর আক্রমণকে সীমাবদ্ধ করার জন্য তাদের রসদ আসার পথগুলো নষ্ট করে দিচ্ছে। পাক বাহিনীর মূল লক্ষ্য সাধারণ মানুষ - বললেন পূর্ব অঞ্চলের বেইজে প্রতিরক্ষা বাহিনীর কমান্ডার কর্নেল এম এ জি ওসমানি। তিনি বলেন,"তারা জনগণকে সন্ত্রাসের ভয় দেখাচ্ছেন ও খুধার্ত রাখার চেষ্টা করছে।"সেনাবাহিনীর সামরিক সরবরাহ ব্যতীত পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বন্দর চট্টগ্রামের মধ্য দিয়ে কিছু আসছে না। বাঙালিদের এখন তাদের নিজেদের এলাকায় যা পাওয়া যাবে তাই দিয়ে চলতে হবে। শত শত বছর, বন্যা, ঝড় ও গভীরতম দারিদ্রতার পর থেকে তাদের বেঁচে থাকার লড়াই চলছে। যদিও যুদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তানকে শারীরিকভাবে স্পর্শ করেনি তবে পূর্বের কারণে অর্থনৈতিক মন্দার শিকার হতে পারে। জাকার্তা টাইমস ’এই গণহত্যা বন্ধ কর’শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়,রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, ছাত্র, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এবং এমনকি নিরস্ত্র বেসামরিক নারী ও শিশুরা পূর্ব পাকিস্তানে নির্মমতার শিকার হচ্ছে। মুসলিম বিশ্ব কি এই কষ্ট দেখে বসে থাকবে? ইসলাম কি সশস্ত্র মুসলমানদের দ্বারা নিরস্ত্র মুসলমানদের হত্যার অনুমোদন করে? ইসলামী নীতি কি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায় বিচারের তাগিদে সংখ্যাগরিষ্ঠদের দ্বারা সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারকে ন্যায্যতা দেয়? মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর দ্রুত এগিয়ে আসা উচিৎ। ভাল মুসলমানরা অন্য মুসলমানদের উপর নির্যাতন চালাতে পারেনা। ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক সংগঠন পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থায় নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকা উচিত হবে না। গণহত্যা যথাসাধ্য বন্ধ করার জন্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের সব ব্যাবস্থা নিতে হবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলতে পারেন যে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা জাতীয় ব্যাপার কিন্তু যদি পূর্ব পাকিস্তান একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হত - তাহলে সেখানে যা হচ্ছে তাতে কি বিশ্বের অন্যান্য মুসলমান দেশগুলো উদ্বিগ্ন হতও না?
×