ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

দেশে সুযোগ না পেয়ে গায়ানার সহকারী কোচ

প্রকাশিত: ১২:০৩, ১৭ এপ্রিল ২০১৯

দেশে সুযোগ না পেয়ে গায়ানার সহকারী কোচ

বাংলাদেশের বাইরে অন্য কোন দেশের জাতীয় দলে কাজ করা প্রথম বাংলাদেশী তাফ রহমান। প্রবাসী এই সাবেক ফুটবলার এখন কাজ করছেন ক্যারিবিয়ান দেশ গায়ানার জাতীয় ফুটবল দলের সহকারী কোচ হিসেবে। এই কোচিং স্টাফের হাত ধরে দেশটি প্রথমবারের মতো খেলছে কনকাকাফ গোল্ডকাপের মূল পর্বে। ২৩ মার্চ। ক্যারিবিয়ান দেশ গায়ানার ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় একটি দিন। স্বাধীনতার ৫৩ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এদিন উত্তর ও মধ্য আমেরিকার ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বের আসর কনকাকাফ গোল্ডকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে দেশটি। যেই অর্জনের পেছনে ছিল একজন বাংলাদেশীর ভূমিকাও। তিনি তাফ রহমান। পুরো নাম তোফাজ্জালুর রহমান। জন্ম ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৮৩ সালে। ব্রিটেন প্রবাসী এই বাংলাদেশী ২০১৮ সালের জুন থেকে গায়ানার সহকারী কোচের দায়িত্বে। ফুটবলে যার শুরুটা আর্সেনাল একাডেমির হয়ে। এরপর সান্নিধ্য পেয়েছেন থিয়েরি অঁরি, রবার্ট পিরেস, ডেনিস বার্গক্যাম্পদের। ইনজুরির কারণে ফুটবল ছাড়ার পর কাজ করেছেন টটেনহ্যাম একাডেমির কোচ হিসেবে। আর এবার প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে কোচিং স্টাফে কাজ করার সুযোগ। আর এক বছরের মাথায় সাফল্যে উচ্ছ্বসিত তাফ রহমান। তিনি বলেন, ‘আমাদের জন্য ইউরোপের বাইরে কাজ করাটা অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ। সেখানে আমি এত তাড়াতাড়ি সাফল্য পাব, তা চিন্তা করিনি।’ তাফ আরও যোগ করেন, ‘কনকাকাফের মূলপর্বে খেলার এই সুযোগে শুধু গায়ানার নয়, যেন আমারও একটি স্বপ্নপূরণ হয়েছে। সত্যিই অবিশ্বাস্য। ক্যারিবিয়ান দেশ বলেই জনপ্রিয়তার বিচারে গায়ানায় ফুটবল থেকে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা একটু বেশি।’ ক্লাইভ লয়েড, কার্ল হুপার, রামনরেশ সারওয়ান, শিবনারায়ণ চন্দরপলের দেশে ভাল ফুটবলার খুঁজে বের করার চ্যালেঞ্জও নিতে হয়েছে। তবে লম্বা একটা সময় ইংলিশ এফএর কোচিং এ্যাডুকেটর হিসেবে কাজ করা তাফ সে পরীক্ষাতেও উতরে গেছেন। এটা ঠিক গায়ানা ক্রিকেটের জন্য বেশি পরিচিত। কিন্তু তারা ফুটবল উন্নয়নের জন্য ক্রমাগত কাজ করে যাচ্ছে। আর তাদের সহায়তায় শুধু গায়ানা নয়, গায়ানার বাইরে অনেক প্রবাসী ফুটবলারের খোঁজও তাফ পেয়েছেন ইউরোপে। নিজের কোচিং ক্যারিয়ার গড়তে নানা উত্থান-পতনের সাক্ষী হতে হয়েছে তাফকে। এ পর্যন্ত ৪৫ কিংবা ৫০ বারের মতো কোচিংয়ের চাকরি থেকে প্রত্যাখ্যাত হতে হয়েছে তাফকে! ‘ফুটবল এখন অনেক প্রতিযোগিতামূলক। খুব কম সুযোগই পাবেন আপনি। তাই আপনাকে চেষ্টা করে যেতেই হবে।’ তাফের উপলব্ধি। জুনে কনকাকাফ গোল্ডকাপের গ্রুপপর্বে তাফের গায়ানাকে খেলতে হবে বিশ্বকাপে খেলা তিন দেশ যুক্তরাষ্ট্র, পানামা ও ত্রিনিদাদ এ্যান্ড টোবাগোর বিপক্ষে। আর এভাবেই সব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে তাফ দেখেন প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে বিশ্বকাপে কাজ করার স্বপ্নও, ‘আমার স্বপ্ন সর্বোচ্চ পর্যায়ে কাজ করা। হতে পারে ক্লাব লেভেল কিংবা জাতীয় দল। কিন্তু এখন আমি অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চাই। আমরা যাদের বিরুদ্ধে খেলবো, তাদের কাছ থেকে অভিজ্ঞতা অর্জনই এখন মূল লক্ষ্য।’ মৌলভীবাজারের এই সন্তান সুযোগ পেলে কাজ করতে চান নিজের দেশেও। কিন্তু তাকে মূল্যায়ন করবে কে? তাফ রহমান এশিয়ান ফুটবল এ্যাওয়ার্ডস কর্তৃক কোচ অব দ্য ইয়ার ২০১৭-এর সম্মাননা পেয়েছেন। জন্ম বাংলাদেশে। তবে বেড়ে উঠেছেন লন্ডনে। শৈশব থেকে ফুটবল খেলতে শুরু করেন। মাত্র ছয় বছর বয়স থেকেই। ১২ বছর বয়সে তাফ আর্সেনাল ফুটবল ক্লাব কর্তৃক নির্বাচিত দশজনের মধ্যে একজন হয়ে ১২-১৬ বছর বয়সী তরুণদের জন্য আয়োজিত ফুটবলের এডুকেশন প্রোগ্রামে অংশ নেন। পরে তিনি রোহাম্পটন ইউনিভার্সিটি থেকে ‘স্পোর্টস সায়েন্স এ্যান্ড কোচ’ ডিগ্রী অর্জন করেন। লিভারপুল, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডসহ আরও অনেক নামী-দামী ক্লাবের হয়ে খেলার অফার পেয়েছিলেন। যখন কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্সের হয়ে খেলছিলেন, তখন আর্সেনাল থেকে ডাক আসে তার। প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন তাফ। আর্সেনালে খেলা এবং সেখানে প্রশিক্ষণ দেয়া ছিল তার কাছে এক দারুণ অভিজ্ঞতার ব্যাপার। ক্লাবের পরিবেশও ছিল চমৎকার। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত কোচ ডন হাউয়ের সঙ্গেও কাজ করেছেন তাফ। আর্সেনাল যুব দলের হয়ে খেলার সময় থিয়েরি অঁরি, রবার্ট পিয়ার্স, প্যাট্রিক ভিয়েরা, ডেনিস বার্গক্যাম্পের মতো বিশ্বকাপ বিজয়ী খেলোয়াড়দের সান্নিধ্যে থেকে শিখেছেন অনেক কিছু। পরে বেশকিছু পেশাদার ও অপেশাদার ক্লাবে খেলেন তিনি। ইনজুরির কারণে খেলোয়াড়ি জীবন বেশিদূর দীর্ঘায়িত হয়নি তারা। হাঁটু এবং হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটের জন্য মাত্র ২৬ বছর বয়সেই অকালে অবসর নেন। ওই বয়সেই তিনি সেমি প্রফেশনাল একটি সিনিয়র লেবেল টিমের কোচ হিসেবে নিয়োজিত হন। কোচিং ক্যারিয়ারে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের অন্যতম জায়ান্ট টটেনহ্যাম হটস্পারের একাডেমির কোচ ছিলেন। কোচিং করিয়েছেন হ্যারি কেন, গ্যারেথ বেলের মতো খেলোয়াড়দের। প্লেয়ার হিসেবে তাফ ছিলেন বৈচিত্র্যময়। খেলেছেন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে, এমনকি দুই উইংয়ে। ছিলেন স্ট্রাইকারও। বাংলাদেশ ফুটবলের জন্য কাজ করতে চাইলে বাফুফে তাকে নিয়ে কখনই কোন আগ্রহ দেখায়নি! তাফ রহমান নিজের কোচিং ক্যারিয়ারকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছেন। যার ফলে পৌঁছে গেছেন তার প্রাপ্য জায়গায়। এখন শুধু অপেক্ষা গায়ানা ফুটবল দলের জন্য কতটা সাফল্য এনে দিতে পারেন এই বাঙালী। তাফ চাইলে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন আধা পেশাদার লীগে খেলে যেতে পারতেন। তাতে আয়ও মন্দ করতেন না। আর্সেনালের রিজার্ভ দলে খেলার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই খেলোয়াড়কে লুফে নিতে চাইত যে কোন দলই। কিন্তু তাফের ভাবনা ছিল ভিন্ন। তিনি কোচিং পেশাকেই বেছে নেন। আর্সেনালের একাডেমিতে কাজ করলেন দীর্ঘ পাঁচ বছর। ক্লাবের ফুটবল এ্যানালাসিস্ট প্যানেলেরও একজন ছিলেন তাফ। প্রিমিয়ারশিপ ও চ্যাম্পিয়নশিপ দলগুলোর স্কাউট হিসেবে কাজ করেছেন। কোচিং করিয়েছেন বিভিন্ন আধা পেশাদার দলকে। তাফ রহমানকে এক অর্থে ফ্রিল্যান্সার কোচও বলা যায়! কত প্রকল্প, কত তরুণ প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচীতে কাজ করেছেন, তার হিসাব নেই! কমিউনিটি ফুটবল নিয়ে কাজ করার সুবাদে ২০১৪ সালের সেরা কোচের পুরস্কারের জন্য মনোনীতও হয়েছেন তিনি। ইন্ডিয়ান সুপার লিগে (আইএসএল) কাজ করার প্রস্তাব পেয়েছিলেন। উঠতি খেলোয়াড় হিসেবে যখন ঔজ্জ্বল্য ছড়াচ্ছিলেন, ক্যারিয়ারের সেই দুরন্ত সময়ে খেলতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে। বাফুফের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু বাফুফেও তাকে নিয়ে মাথা ঘামায়নি। ফলে তাফের সেই স্বপ্ন পূরণ আর হয়নি। এখন তার সব স্বপ্ন গায়ানাকে নিয়েই।
×