ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

শফিউল হত্যা মামলার রায়

প্রকাশিত: ১১:১৭, ১৮ এপ্রিল ২০১৯

শফিউল হত্যা মামলার রায়

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক অধ্যাপক শফিউল ইসলাম লিলনের চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার রায় প্রকাশ করে রাজশাহীর বিজ্ঞ আদালত। অভিযুক্ত ১১ আসামির মধ্যে ৩ জনকে মৃত্যুদ-ের আদেশ দেয়া হয়। বাকি ৮ জনকে বেকসুর খালাস দেয়ার কারণ দর্শানো হয় উপযুক্ত সাক্ষী প্রমাণের অভাব। রাষ্ট্রপক্ষ এতে সন্তুষ্ট হলেও নিহতের একমাত্র সন্তান সৌমিন শাহরিদ পিতার হত্যার রায়ের ওপর তার সন্দেহ আছে বলে জানান। যাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো কিংবা যাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ প্রমাণ করা গেল না সে প্রশ্ন পুরো তদন্তের ব্যাপারেও প্রয়াত অধ্যাপকের সন্তানের পক্ষ থেকে আপত্তি উঠে আসে। সাজা পাওয়া অভিযুক্তরা হলেন- আবদুস সামাদ ওরফে পিন্টু, আরিফুল ইসলাম ওরফে মানিক এবং পলাতক মোঃ সবুজ শেখ। দ-প্রাপ্তরা রাজশাহীর বিএনপি যুবদল ও ছাত্রদলের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ের সাংগঠনিক কর্মকর্তা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত একজন নিবেদিত লালনভক্ত। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে চৌদ্দপাই এলাকায় নিজ বাসভবনে নিয়মিত সঙ্গীতচর্চার আসর জমিয়ে তুলতেন এই গানপাগল মানুষটি। বাউল সঙ্গীতের আরাধ্য দেবতা লালনের সঙ্গীত ভা-ারকে অর্ঘ্য নিবেদন করতেন এই সঙ্গীতানুরাগী পৃষ্ঠপোষক। ২০১৪ সালের ১৫ নবেম্বর দুপুর ২টার দিকে তার আকস্মিক নিহত হওয়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। সে সময় ধারণা করা হয় শুদ্ধ সঙ্গীত চর্চার কঠিন প্রতিপক্ষ যে কোন মৌল কিংবা জঙ্গীবাদী সংগঠন ঘাতকের ভূমিকায় নেমে এমন লোমহর্ষক হত্যাকা-টি ঘটায়। শুধু তাই নয়, তার বাসভবনের সামনেই উপর্যুপরি কুপিয়ে দুর্বৃত্তরা এমন নৃশংস অভিযানটি পরিচালনা করে। সারা বাংলাদেশে তখন চলছিল মুক্তমনা শিক্ষক, প্রকাশক, ব্লগার এবং লেখক হত্যার মতো জঘন্য ধ্বংসযজ্ঞ। যার মূল নেতৃত্বে চলে এসেছিল আনসারুল্লাহ্ বাংলাটিম নামে এক মৌলবাদী জঙ্গী সংগঠন। শুধু তাই নয়, তারাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন হত্যার দায় নিজেদের কাধে নিতেও পিছপা হয়নি। অধ্যাপক শফিউল হত্যার পরদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এন্তাজুল হক মতিহার থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্ত শুরু হলে স্পষ্ট হয় কোন জঙ্গী সংগঠন নয়, বরং স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি মানুষের অভ্যন্তরীণ বিবদমান পরিস্থিতিই শেষ অবধি হত্যাকা- পর্যন্ত গড়াতে সময় লাগেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার নাসরিনের সঙ্গে কোন্দলের জের হিসেবে এই মুক্তমনা শিক্ষককে পৃথিবী থেকে চিরতরে চলে যেতে হয়। নাসরিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি আবদুল সামাদ পিন্টুর সহধর্মিণী। ফলে নাসরিনের পক্ষ হয়ে একজন শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক প্রতিহিংসার ছোবল মারতেও কুণ্ঠিত হয়নি স্বামী। এরই পরিণতিতে ঘটে যায় এমন নির্মম আর পৈশাচিক খুন। মামলার এজাহারে কাউকে সেভাবে নথিভুক্ত করা না হলেও তদন্তের সময় অভিযুক্তদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হয়। আর সেইসব শনাক্তকরণ প্রক্রিয়ায় ১১ জন অভিযুক্তকে মামলার আসামি করা হয়। নাসরিনকে আটক করার পর তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিলে মামলার মোড় মূল ঘটনার দিকে ঘুরে যায়। ফলে হত্যাকা-ের ১ বছরের মাথায় ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র গঠন করে মামলাকে আইনী কার্যক্রমে এগিয়ে নেয়া হয়। সেই ধারাবাহিকতায় ১৫ এপ্রিল সোমবার এমন নৃশংস হত্যাকা-ের রায় প্রকাশ করা হয়। ব্যক্তিগত বিরোধের জের হিসেবে সংঘটিত এই জঘন্য হত্যার বিচারের রায় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক অনুপ কুমার সাহা উপস্থিত অনেকের সামনে ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রপক্ষ এতে খুশি হলেও একমাত্র সন্তান এই বিচারের রায়কে প্রশ্নবিদ্ধ করে হত্যার সঠিক কারণ উঠে না আসায় ক্ষুব্ধ হন। আসামি পক্ষের আইনজীবীও এই রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, আসামিদের স্বীকারোক্তিতে প্রমাণ হয়নি যে তারা হত্যাকা-ে জড়িত ছিল। সুতরাং উচ্চ আদালতে আপীল করার কারণ এবং সুযোগ রয়েছে।
×