ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

এবারের ১৫ আগস্ট ও কিছু করণীয় -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ১১:১৮, ১৮ এপ্রিল ২০১৯

এবারের ১৫ আগস্ট ও কিছু করণীয় -স্বদেশ রায়

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর আগে এবারের ১৫ আগস্ট স্বাভাবিক ভিন্ন গুরুত্ব পায়। কারণ, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন যারা করবে তার সিংহভাগই তরুণ প্রজন্ম। বঙ্গবন্ধুর প্রজন্মের কেউ আর বেঁচে নেই। তাঁর স্নেহধন্য যারা বেঁচে আছেন তাদের সংখ্যাও কম। তাই সত্যি অর্থে অন্য মহামানবের মতো বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন তরুণরাই করবে। তারা তাদের হিরোর, বাঙালীর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ মানুষটির শততম জন্মবার্ষিকী পালন করবে। যে তরুণ সম্প্রদায় আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছে তারা সত্যি ভাগ্যবান। কারণ, এই বাংলাদেশে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে ’৯৬ অবধি তরুণ সম্প্রদায়ের একাংশ বেড়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে না জেনে। তখন তাদের কাছে বঙ্গবন্ধু মুজিব, বাঙালী ও বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকৃত ইতিহাস ছিল নিষিদ্ধ। বরং বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে অনেক অপপ্রচার শুনেই তারা বিভ্রান্ত হয়ে বড় হয়েছে। আজও বঙ্গবন্ধুবিরোধী যে সব তরুণ বাংলাদেশে ইসলামী ছাত্রশিবির, ছাত্রদল এমনকি একশ্রেণীর বাম ছাত্র সংগঠন করে এরা ওই বিভ্রান্ত তরুণদেরই একটি ধারাবাহিকতা। এদের দিকে তাকালে এই ব্যর্থতাই আমাদের প্রত্যেকের বুকে আঘাত করে যে, আমরা বাংলাদেশের শতভাগ তরুণকে এখনও সঠিক পথে, সত্যের পথে আনতে পারিনি। আগামী ১৭ মার্চ যখন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হবে দেশে ও বিদেশে সে সময়ে বাংলাদেশে একজন তরুণও যদি বঙ্গবন্ধুর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কোন ভুল মূর্তির দিকে চেয়ে থাকে, সে ব্যর্থতা আমাদের সকলকে স্বীকার করে নিতে হবে। যা হোক, তার পরেও দেশের সিংহভাগ তরুণের সৌভাগ্য ও আমাদের সৌভাগ্য, তথ্যপ্রযুক্তি উন্মুক্ত হওয়ায় ও গত দশ বছরের বেশি সময় আওয়ামী লীগ বা বিশেষ করে শেখ হাসিনা ক্ষমতা থাকায় তারা বঙ্গবন্ধুকে জানতে পেরেছে। তারা তাদের প্রকৃত হিরোকে বুকে ধারণ করে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছে। তবে এই জন্মশতবার্ষিকী যখন তরুণরা পালন করতে যাচ্ছে সে সময়ে আমাদের কয়েকটি বিষয় খুবই গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা করতে হবে। যেমন তরুণরা বঙ্গবন্ধুকে কতটুকু জানতে পেরেছে? তারা বঙ্গবন্ধুর আজীবনের সংগ্রামের অর্ধেকও জানতে পারেনি। কারণ, আমাদের যাদের ওপর দায়িত্ব ছিল তরুণদের বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানানো, তাঁকে নিয়ে কাজ করে তরুণদের মাঝে তুলে ধরা- আমরা সঠিকভাবে সেটা কেউই করিনি। তা ছাড়া সব থেকে বড় ব্যর্থতা হলো, দেশে বঙ্গবন্ধুকে গবেষণার জন্য কোন একাডেমি বা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। আশা করি, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে সরকার, বিশেষ করে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা দেশে ‘বঙ্গবন্ধু একাডেমি’ গড়ে তোলার ব্যবস্থা করবেন। এটা অবশ্যই সরকারী সিদ্ধান্ত ও সরকারী কাজ। এগুলো করতে হয়ত কিছু সময় লাগবে। তবে এবারের ১৫ আগস্ট পালন শুধু অন্যান্য বছরের মতো নিয়মিত কর্মসূচী পালনের মধ্য দিয়ে না করে অন্তত বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কয়েকটি বিষয় যাতে তরুণ প্রজন্ম জানতে পারে সেই লক্ষ্যে কাজ করা উচিত। সে বিষয়গুলো হলো, বঙ্গবন্ধু কিভাবে ধ্বংসস্তূপ থেকে একটি দেশ গঠন শুরু করে সাড়ে তিন বছরে কোথায় নিয়ে এসেছিলেন এবং তিনি বেঁচে থাকলে আজ বাংলাদেশ কোথায় যেত। বঙ্গবন্ধু যে শুধু দেশ স্বাধীন করেননি, একটি দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে শূন্য থেকে তিনি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন, গড়ে তুলেছিলেন। সেই অসাধ্য সাধনের ইতিহাস কিছু অংশ হলেও যদি সামনে আনা যায় এবং তরুণ প্রজন্ম জানতে পারে, তা হলে তার জন্মশতবার্ষিকীর আগের ১৫ আগস্ট পালন অনেক বেশি সার্থক হবে। কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। বঙ্গবন্ধু যখন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক গড়ে তোলেন তখন আমাদের রিজার্ভ বলতে কিছুই ছিল না। বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষের কাছে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহের জন্য সোনা সাহায্য চেয়েছিলেন এবং ইরাকসহ কয়েকটি বন্ধু রাষ্ট্রের সাহায্যে আমাদের রিজার্ভের যাত্রা শুরু হয়। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের পুলিশদের মশারিও ছিল না। বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে তাদের মশারি টাঙিয়ে দিয়ে তাদের মশার হাত থেকে রক্ষার কাজ শুরু করেন। পুলিশের কোন মনোগ্রাম পর্যন্ত ছিল না। কাগজ দিয়ে বাংলাদেশ পুলিশ লিখে নিয়ে অনেকে হাতে সেটা বেঁধে নিতেন। পুলিশের পোশাক, মনোগ্রাম তৈরি সবই তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। শুধু পুলিশ নয়, একটি রাষ্ট্রের সুপ্রীমকোর্ট থেকে বিআইডব্লিউটিসি পর্যন্ত সব প্রতিষ্ঠানের মনোগ্রাম সেদিন তাকেই মনোনীত করতে হয়েছে। মনোগ্রামের কথা বলছি এ কারণে যে, কত শূন্য থেকে তাঁকে দেশের সব কিছু গড়ে তুলতে হয়েছিল। কোন প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন যদি উদ্যোগ নিয়ে বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রথম দিন থেকে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট অবধি পত্রপত্রিকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে, তা হলেই একটি বড় চিত্র তুলে আনতে পারবে। যার মাধ্যমে দেশের তরুণ প্রজন্ম জানতে পারবে কীভাবে একটি দেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল এবং বঙ্গবন্ধু কীভাবে সংগ্রাম ও যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশটি অর্জন করে তাকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন। ওই সময়কালের পত্রপত্রিকা ও সরকারী নথি থেকে আরও একটি বড় ছবি বের করে আনা সম্ভব, তা হলো স্বাধীন দেশে পুনর্বাসন। সেদিন এক কোটি শরণার্থী দেশে ফিরে এসেছিলেন। তাদের কারও কিছু ছিল না। দেশের ভেতর কমপক্ষে দুই কোটি লোক তাদের সহায়সম্পদ সব ছেড়ে পালিয়ে বেড়িয়েছিলেন। এই বিশাল সংখ্যক মানুষকে পুনর্বাসন, ধ্বংসস্তূপ হয়ে যাওয়া বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর কীভাবে সেদিন আবার চালু করা হয়। পাশাপাশি সারাদেশের প্রায় সব ব্রিজ, কালভার্ট সবই ভাঙ্গা ছিল। যুদ্ধের প্রয়োজনে, নিজেদের সেদিন যেমন ভাঙতে হয়েছিল তেমনি মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রা ঠেকাতে পাকিস্তানী বাহিনীও ভেঙ্গেছিল ওই সব ব্রিজ ও রাস্তা। এ সবই ওই সাড়ে তিন বছরে গড়ে তোলা হয়। তাই স্বাভাবিকভাবে এই শূন্য থেকে দেশ গড়ে তোলা ও পুনর্বাসনÑ এই দুই ইতিহাস যদি এবারের ১৫ আগস্টে দেশের তরুণ সম্প্রদায়ের হাতে তুলে দেয়া যায়, সেটাই হবে প্রকৃত জন্মশতবার্ষিকী সামনে রেখে ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন। এ দুই ছাড়া আর যে কাজটি করা প্রয়োজন তা হলো, বঙ্গবন্ধুর প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, রাজধানী ঘিরে মাস্টার প্ল্যান, দেশের খনিজ সম্পদ, কৃষি সম্পদ, সর্বোপরি মানব সম্পদ ঘিরে যে সব মাস্টার প্ল্যান ছিল এগুলো বিশ্লেষণ করা এবং তার ওপর ভিত্তি করে প্রকৃত বিশ্লেষণ করা। যে বিশ্লেষণের মাধ্যমে বেরিয়ে আসবে বঙ্গবন্ধু যে আর্থ-সামাজিক কর্মসূচী নিয়েছিলেন, সেগুলো নিয়ে তিনি যদি আরও বিশ বছর এগুতে পারতেন তা হলে দেশ আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়াত। বিশ্বসভায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াত। এ কাজটুকুও বঙ্গবন্ধুর এই জন্মশতবার্ষিকীর আগের ১৫ আগস্টের অন্যতম শ্রদ্ধা নিবেদন হতে পারে। আর আমাদের সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. আতিউর রহমান দু’জনই শুধু অর্থনীতিবিদ নন, ভাল লেখকও। তাই তাঁদের নেতৃত্বে তাঁদের হাত দিয়ে যদি এ কাজ বের হয়ে আসে তা হলে দেশের তরুণ প্রজন্ম জানতে পারবে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধু দেশকে কোথায় নিয়ে যেতেন। আর এই জানার ভেতর দিয়েই তরুণ প্রজন্ম সত্যি অর্থে উপলব্ধি করবে কেন খুনীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল। তরুণ প্রজন্ম সত্যি সত্যি বুঝতে পারবে খুনীরা শুধু ১৫ আগস্ট হত্যাকা-ের ভেতর দিয়ে একজন ব্যক্তি ও একটি পরিবারের সকল সদস্যকে হত্যা করেনি- তারা একটি জাতি ও একটি রাষ্ট্রের সকল উন্নয়নকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। তারা জানতে পারবে আজ যে আমাদের হাজার হাজার তরুণ বিদেশে মেধা বিক্রির বদলে শ্রম বিক্রি করতে যাচ্ছে, এর মূল কারণ যে শিক্ষানীতির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু দেশের মানবসম্পদ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, তা বাস্তবায়িত হয়নি বলেই। আর দেশকে এই দুর্ভাগা অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার জন্যই সেদিন খুনীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল। বাস্তবে বঙ্গবন্ধুর এই জন্মশতবার্ষিকীর প্রাক্কালে এভাবে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সামগ্রিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে তুলে আনাই হবে এবারের ১৫ আগস্টে তাঁর প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা জানানো। [email protected]
×