ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সাজ্জাদ কাদির

দেশীয় সিনেমার বেলা অবেলা

প্রকাশিত: ১২:৩৭, ১৮ এপ্রিল ২০১৯

দেশীয় সিনেমার বেলা অবেলা

একটি সময় ছিল যখন এদেশের মানুষের বিনোদনের প্রধান আঁতুড়ঘর ছিল আমাদের সিনেমা হলগুলো। যখন আমরা যৌথ পরিবারের মানুষ ছিলাম তখন পুরো পরিবারের সবাই একসঙ্গে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতাম। সিনেমা হলগুলো ছিল এক একটি পারিবারিক ও সামাজিক বিনোদনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। প্রতিটি থানা শহরে ২-৩টি এবং বিভাগীয় ও জেলা শহরে ৫-৬টি সিনেমা হল ছিল। শুধু বিনোদনই নয়; এই সিনেমা হলগুলোকে কেন্দ্র করে হাজার হজার মানুষের কর্মসংস্থানও তৈরি হয়েছিল। নব্বই দশকের শুরুর দিক পর্যন্ত প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সিনেমা হল তৈরি হয়েছে। যার প্রেক্ষিতে একটি সময় দেশে সিনেমা হল সংখ্যা হাজার দেড়েক ছুঁতে যাচ্ছিল। নব্বই দশকের শেষ দিক থেকে এদেশে সিনেমা হল বন্ধ হতে থাকে। বন্ধ হতে হতে এক বছর আগেও সারা দেশে ৩০০শ’র ওপরে সিনেমা হল চালু ছিল। মাত্র গত এক বছরে সেই সংখ্যাটি কমে এখন নাকি ১৭৪-এ নেমে এসেছে (সূত্র : প্রথম আলো ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯)। দেশের বেশিরভাগ উপজেলা সদর, ১৫-২০টি জেলা সদর এবং বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে এখন কোন সিনেমা হল অবশিষ্ট নেই। যতদূর জানা যায় এই মুহূর্তে দেশের প্রায় সব হল মালিকই তাদের সিনেমা হল চিরতরে বন্ধ করে দেয়ার কথা ভাবছেন। এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরে ঢাকা শহরের সীমিত কয়েকটি অত্যাধুনিক সিনেমা হল ছাড়া এদেশে আর কোন সিনেমা হল অবশিষ্ট থাকবে না। প্রশ্ন হচ্ছে এই অবস্থা কেন হলো? এর পেছনে বহুমুখী কারণ আছে। প্রথম কারণটিই হল নব্বই দশকের শুরুর দিকে এদেশের সিনেমা ব্যবসায় কিছু অসাধু মানুষের আগমন ঘটে। যাদের সিনেমার সঙ্গে এমনকি কোন প্রকার শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক ছিল না। তারা শুধুই ব্যবসা এবং অসৎ উদ্দেশ্যে এই জগতে প্রবেশ করে। নতুন আগত এই নষ্ট মানুষগুলো প্রকৃত সিনেমা সংশ্লিষ্ট মানুষগুলোকে একেএকে কোণঠাসা করে ফেলতে থাকে। এই অসাধু মানুষগুলোর প্রভাবে ভাল চলচ্চিত্রের ভাল মানুষগুলো জিম্মি হয়ে পড়ে। এক সময় বেশিরভাগ ভালোরা এ জগত থেকে দূরে সরে যায়। আর সেই সুযোগে এদেশের গৌরবের সিনেমা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। এই নষ্ট মানুষগুলো প্রথম পদক্ষেপেই আমাদের সিনেমাই অশ্লীলতার আমদানি ঘটায়।যে মূহুর্তে এদেশীয় সিনেমায় অশ্লীলতা প্রবেশ করে ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই আমাদের সিনেমা দর্শকের নিকট দেশের শত শত সিনেমা হলগুলো পারিবারিক ও সামাজিক বিনোদনের কেন্দ্রবিন্দুর বাইরে চলে যায়। পরিবারের নির্মল বিনোদনের সেই জায়গা পরিণত হয় বখাটেদের আখড়ায়। যার কারণে সিনেমা হলগুলো দর্শক হারানো শুরু করে। দর্শক না থাকায় সিনেমা হলগুলোর ব্যবসায় ব্যাপক ধ্বস নামে। ব্যবসা না থাকায় বর্তমান শতাব্দীর শুরুর দিক থেকে সিনেমা হলগুলো বন্ধ হতে থাকে। কথায় আছে যে খাদের কিনারেও নাকি কিছুটা আলো থাকে। আমাদের সিনেমার ক্ষেত্রেও সেটি প্রযোজ্য। ওই সময়ের প্রতিকূল পরিবেশেও অল্প ক’জন ভাল সিনেমা পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা, কলা-কুশলী এই অঙ্গনে নিভুনিভু করে কাজ করতে থাকে। যারা মাঝেমাঝেই ভাল সিনেমা উপহার দিত। যা প্রয়োজনের তুলনাই নিতান্তই অপ্রতুল। এই অপ্রতুল সিনেমা দিয়ে আর ব্যবসা হয় না। অন্যদিকে ততদিনে সিনেমা হলের পরিবেশ পুরোপুরিই নষ্ট হয়ে গেছে এবং বেশিরভাগ বন্ধ হয়ে গেছে। আর এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে, ভাল হোক মন্দ হোক দেশের সিনেমা হল চালু রাখার মতো পর্যাপ্ত সিনেমাই তৈরি হচ্ছে না। সিনেমা নির্মাণ কমতে কমতে উদ্বেগজনক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান তাই বলে। যেখানে এক সময় বছরে প্রায় শ’খানেক সিনেমা নির্মাণ হতো সেখানে ২০১৫ সালে ৬৭টি, ২০১৬-১৭ সালে ৫৬টি এবং গত বছর ২০১৮ সালে মাত্র ৩৫টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। চলতি বছর প্রথম প্রান্তিক শেষে মাত্র অল্প কয়েকটি সিনেমার কাজ শুরু হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে বছর শেষে মুক্তির মিছিলে ২০টি সিনেমাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেক হতাশার মধ্যে আশার কথাও আছে। সিনেমা সংশ্লিষ্ট ভাল শ্রেণীটির হাত ধরে বর্তমান সময়েও অনেক শিক্ষিত ছেলেমেয়ে সিনেমায় কাজ করতে আসছে। অনেকে সিনেমার ওপর বিদেশ থেকে পড়ালেখা করেও আসছে। সিনেমা শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে যারা আসছে তাদের জন্য সরকারী বেসরকারী সকল মহল থেকে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। তারা যেন কাজ করতে এসে কোনভাবেই হতাশ হয়ে ফিরে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ জন্য সবার আগে যেটি প্রয়োজন সেটি হচ্ছে সিনেমা নির্মাণের জায়গাটি পরিচ্ছন্ন করা। বিশ্ব সিনেমা নির্মাণ প্রক্রিয়ার আদলে আমাদের সিনেমা সাধ্যমত সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা তৈরি করতে হবে। আবার অন্যদিকে অনেকে সিনেমার কিছুই না যেনেও আসছে। এই না যেনে আসা মানুষগুলো এক সময় আমাদের চরমভাবে ডুবিয়েছিল। ভবিষ্যতে যাতে এই শ্রেণীটি আর ডুবাতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে সিনেমা প্রদর্শনের জায়গা তৈরি করা। যেভাবে মহামারির মতো সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে সেই জায়গা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন নতুন সিনেমা হল গড়ে তুলতে হবে। এর ফলে একদিকে ভাল সিনেমা নির্মাণ হবে, অন্যদিকে ভাল পরিবেশে সিনেমাটি প্রদশন হবে। দেশের মানুষ নিজস্ব সিনেমার মাধ্যমে আবারও হারানও সেই সুস্থ বিনোদন উপভোগ করবে। তবে এই মুহূর্তে সিনেমা হলগুলো রক্ষার জন্য হলেও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ সারা পৃথিবীর সিনেমা আমদানির পদক্ষেপ নিতে হবে এবং আমদানি নীতি সহজ করতে হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতির এই যুগে সিনেমার অর্থনীতিকেও মুক্ত করে দিতে হবে। যেহেতু পর্যাপ্ত পরিমাণে আমাদের নিজস্ব সিনেমা নেই সেহেতু বিদেশী সিনেমা আমদানি করে হলেও এদেশের সিনেমা হলগুলো রক্ষা করা সময়ের দাবি। এক সময় সারা পৃথিবীর সিনেমা এই অঞ্চলের মানুষ হলে গিয়ে দেখার সুযোগ পেত। সময়ের পথপরিক্রমাই সেই পথ রুদ্ধ হয়। শুধু তাই নয় ওই সময় বিদেশি সিনেমার সঙ্গে আমাদের সিনেমা সমান তালে প্রতিযোগিতা করে চলত। তখন প্রতিযোগিতা করে আমাদের সিনেমা চলতে পারলে এখন পারবে না কেন?
×