ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

এপ্রিলেই বাঙালীর সশস্ত্র প্রতিরোধ জোরদার হয়

প্রকাশিত: ০৯:৩৯, ১৯ এপ্রিল ২০১৯

এপ্রিলেই বাঙালীর সশস্ত্র প্রতিরোধ জোরদার হয়

’৫২-এর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ’৬৬-এর ৬ দফা এবং ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সূত্র ধরে ১৯৭০ সালে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে বাধ্য হয়। নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রায়ের প্রতিফলনের কারণে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাঙালীদের পক্ষে জনতার রায় চলে আসে। এ রায়ের স্বীকৃতি হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান থেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেখা দেয়। কিন্তু পাকিস্তানের দুরন্তপনা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতির নিয়মই হলো পূর্ব পাকিস্তান তথা এ দেশের জনগণকে প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে জোর-জবরদস্তির রাজনীতি চালু করা। যেহেতু নির্বাচনের ফলাফলে পূর্ব পাকিস্তানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্ন অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থী বঙ্গবন্ধু এ পদে অধিষ্ঠিত হতে যাচ্ছেন, তখনই দুরন্তপনা খানসেনা ইয়াহিয়া খান ষড়যন্ত্রের জাল বুনে নির্বাচনের রায় স্থগিত করে বাঙালীদের বিরুদ্ধে ২৫ মার্চ কালরাতে অতর্কিতে ভয়াবহ নিধনযজ্ঞের ঘোষণা দিয়ে হাজার হাজার নিরীহ বাঙালীতে হত্যা এবং তাদের রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দেয়। এরপরই বাঙালীর নির্ভীক সাহসী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক করে সীমাহীন নির্যাতন চালিয়ে যায়। কিন্তু দূরদর্শী নেতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ স্বাধীনতার পূর্বাভাস হিসেবে এক দিকনির্দেশনামূলক শ্রুতিময় ভাষণে বলে দিয়েছিলেন যে, ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এ ভাষণে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালী জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন ও সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু স্বাধীনতার স্থপতি বিশ্বের অবিসংবাদী নেতা আমাদের মধ্যে সশরীরে উপস্থিত না থাকার কারণে আমরা যারপরনাই কিছুটা হতবিহ্বল হলে একটা শূন্যতা অনুভব করতেছিলাম। মনে হয়েছিল আমরা আমাদের আন্দোলন ও সংগ্রাম কিভাবে এগিয়ে নেব। আমাদের অস্ত্র এবং সেনাবাহিনী বলতে কিছু নেই। এ আন্দোলন ও সংগ্রাম টিকে থাকবে তো। এমন একটা ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছিল। মার্চের পর এপ্রিলের প্রথম দিন থেকেই আন্দোলনের একটা কাঠামো দাঁড়িয়ে যায়। ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের গঠন এবং ১৭ এপ্রিল ওই সরকারের শপথ অনুষ্ঠিত হয়। বলা যায়, ১৭ এপ্রিলের পরই বাঙালীর সশস্ত্র প্রতিরোধ আরও জোরদার হয়। এই প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণÑ আওয়ামী লীগের সুবিদিত একনিষ্ঠ সেবক বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলাম আমাকে কিশোরগঞ্জ জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের সাংগঠনিক দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তখনকার সময়ে নানা কারণে একশ্রেণীর মানুষ পাকিস্তানের পক্ষেই ঝুঁকেছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর অবস্থায় তাদের মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যত ফলাফল আমাদের জন্য সুফল বয়ে আনবে বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। দিন যায় আর সংগ্রাম-আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। বাঙালী দামাল যুবকরা ঐক্যবদ্ধ হতে হতে এক সময় সংগ্রাম-আন্দোলন তুঙ্গে উঠতে থাকে। সারা দেশে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ-সংগ্রাম বাড়তে থাকে। ইতোমধ্যে কুষ্টিয়ার মেহেরপুর আম্রকাননে মুজিবনগর সরকার গঠনের সুসংবাদ আমাদের মাঝে আশার আলো জ্বালিয়ে দেয়। অনেকটা শুকিয়ে যাওয়া তৃষ্ণার্ত গলায় এক ফোঁটা পানির আশ্রয় খুঁজে পাওয়া যায়। গা-ঝাড়া দিয়ে আরও দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে পাই। বিশেষ করে আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছিলাম এ কারণে যে, আমার নেতা মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের নাম শুনে। আমরা এতদিন দেশের জন্য যে সকল সংগ্রাম-আন্দোলন করেছি তা বাস্তবায়নের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে মুজিবনগর সরকার গঠনের মাধ্যমে। মুজিবনগর সরকার গঠনের প্রক্রিয়ার কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দলিল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে বিশ্বের কাছে স্বীকৃতি পেয়েছিল। তাই ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার আমাদের এক অনুপ্রেরণার স্মৃতির বিষয়। এইদিন বাংলাদেশ সরকার এবং রাষ্ট্রের ঘোষণার মাধ্যমে আমাদের হাজার বছরের বাঙালীর আন্দোলন ও সংগ্রামের ফসল হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি সার্বভৌম দেশ তথা সরকার এবং রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। শপথের এদিন থেকেই দেশের জনগণ এ সরকারকে কার্যকরী সরকার হিসেবে রাষ্ট্রীয় অনুমোদন এবং সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কর্তৃত্ব প্রদান করে। বাংলাদেশের জনগণ এতদিন পশ্চিমাদের অত্যাচার-অবিচার, নির্যাতন-নিপীড়ন, শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির বাসনায় অপেক্ষা করতেছিল তা থেকে মুক্তি পাওয়ার অদম্য বীরত্ব ও সাহস জয়ের মাধ্যমে। মুজিবনগর সরকার গঠনের মাধ্যমে বাঙালী একটি মুক্ত স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা করে সাম্য ভ্রাতৃত্ব সৌহার্দ্যপূর্ণ এক স্বপ্নীল বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখে, যা বাস্তবায়ন ঘটে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মাধ্যমে। পাকিস্তান কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষা এবং তাঁকে মুক্ত স্বদেশের মাটিতে ফিরিয়ে আনা ছিল মুজিবনগর সরকারের বিশাল এক সাফল্য। আগস্টের প্রথম দিকে খবর বের হয় পাকিস্তানের সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিচার শুরু হবে। এই খবর প্রকাশের পর মুজিবনগর সরকার শুরু করে কূটনৈতিক তৎপরতা। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ১৫০ জন সদস্য তাঁর নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেন। যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসে পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধ করার প্রস্তাব পাস করে। ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ ও বিশ্ববাসীকে এই বিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য মুজিবনগর সরকার সর্বতোভাবে তৎপরতা পরিচালনা করে। এদিকে বঙ্গবন্ধুর বিচারকে কেন্দ্র করে এদেশীয় কুচক্রীরা ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের জাল বিস্তার করে। চক্রটি বঙ্গবন্ধুর প্রাণ ও মুক্তির বিনিময়ে সমঝোতা করার প্রস্তাব দিয়ে প্রচার চালায়। এই অবস্থায় মুজিবনগর সরকার দৃঢ় অবস্থান নিয়ে ঘোষণা করে যে, বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেয়া হলে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দী পাকিস্তানী সব সৈন্যকে খতম করা হবে। আসলে মুজিবনগর সরকারের বহু সিদ্ধান্ত ছিল, একটি অপরটির পরিপূরক, যার সুফলও পেয়েছে বাঙালী। ভয়ও ছিল কোন এক ক্ষেত্রে যদি দুর্বলতা কিংবা ব্যর্থতার ছিদ্র সৃষ্টি হতো তবে এই ছিদ্র দিয়ে বিষধর সাপ ঢুকে সবকিছু ল--ভন্ড করে দিত। সে কারণে হয়ত বহির্বিশ্বের আস্থা ও অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করা তখন সম্ভব হতো না। দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে একাগ্রতা ও দৃঢ়তা, নীতি-কৌশল, জনগণ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার দক্ষতা, শক্তি ধরে রাখতে ধৈর্য ও মেধার সম্মিলনে মুজিনগর সরকারকে সাফল্য এনে দিয়েছেন। আসলে ব্যর্থ হওয়ার কোন সুযোগও এই সরকারের ছিল না। মুজিবনগর সরকার সত্যিকার অর্থেই আমাদের দেশের ইতিহাসের সৃষ্ট, জনগণের চেতনা ও তৎপরতার তাৎপর্যম-িত ফসল। যাকে কখনও বাংলাদেশের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ থেকে আলাদা করা যাবে না। তাই মুজিবনগর সরকারকে জাতীয় ইতিহাসের সঠিক ও যথার্থ স্থানে রাখা জরুরী। বাংলাদেশ আজ আর শিশু রাষ্ট্র নয়। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পেরিয়েছি আমরা। এক বছর পরই সুবর্ণজয়ন্তী। এই ৪৮ বছরে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির নানা পরিসংখ্যান দেয়া যাবে; কিন্তু যে স্বপ্ন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অংশ তা কি প্রত্যাশিতভাবে বাস্তবায়ন হতে পারছে? একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এই প্রশ্ন এখনও আমার। এখনও জঙ্গীবাদ ও স্বাধীনতার পরাজিত শক্তির আস্ফালন দেশকে গ্রাস করতে চাচ্ছে। যদিও গত ১০ বছরে দেশ অনেক এগিয়ে গেছে, তথাপি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান শর্ত সুষম বণ্টনের মাধ্যমে মানবিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক সুরক্ষা আর মনের শান্তি প্রতিষ্ঠা এক দুরাশার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু এমন দুরাশা দুঃস্বপ্নের দেশ দেখতে চাননি। আমরাও এমন স্বপ্ন নিয়ে পরিবার-পরিজনের মায়ামমতা ত্যাগ করে বুকের রক্ত ঢেলে দিতে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়িনি। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমি ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দাবি উত্থাপনের সময় থেকে বঙ্গবন্ধুর মোহনীয় সাংগঠনিক আকর্ষণে মুগ্ধ হয়ে এবং আওয়ামী লীগের সুবিদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলামের অনুপ্রেরণায় ছাত্রলীগের পর আওয়ামী লীগ করতে শুরু করি। সেই প্রেক্ষিতে আমার আওয়ামী লীগ করার বয়স হয়েছে ৫২ বছরের ওপরে। আমার সুদীর্ঘ জীবনে আওয়ামী লীগ এবং দেশের জন্য আত্মত্যাগ, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অফুরন্ত অবদান রাখার চেষ্টা করেছি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমাকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন, যা পরে নেত্রীর নির্দেশে প্রত্যাহার করি। দশম ও একাদশ সংসদে প্রার্থী হওয়ার প্রত্যাশা ছিল; কিন্তু দল মনোনয়ন দেয়নি। তারপরও নিরাশ হইনি। দলের প্রতি আনুগত্য থেকে বলছি, দেশের মানুষ যেন নিরাপদে-শান্তিতে থাকে, আমাদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনগণের প্রতি কল্যাণমুখী পদক্ষেপগুলো আরও জনমুখী হয় সে ব্যাপারে দলের সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা যেন সক্রিয় থাকে। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা দেখে যেতে চাই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ যেন তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার হাত দিয়েই প্রতিষ্ঠা পায়। লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক পরিচালক বিআরটিএ
×