ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জীবেন রায়

আফটার দি ডাস্ট সেটেলস ডাউন

প্রকাশিত: ০৯:৪১, ১৯ এপ্রিল ২০১৯

আফটার দি ডাস্ট সেটেলস ডাউন

প্রায় দুই সপ্তাহ হলো। বাংলাদেশে এক প্রলয়ঙ্করী ঘটনা ঘটে গেল। বাংলাদেশের মিডিয়া জগত একটা নৃশংস হত্যাকা-ের ঘটনাকে নিয়ে এক অভূতপূর্ব গণজাগরণ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু আমার প্রশ্নটা হলো, তারপরও নিত্য নৈমিত্তিকভাবে ধর্ষণ, নারী ঘটিত ঘটনা ঘটে চলেছে। এমনকি নুসরাতের ঘটনাটির পরেরদিন থেকেই ঘটে চলেছে, তবে পুড়িয়ে মারার ঘটনা হয়ত ঘটেনি। জনগণ আন্দাজ করতে পারছে, নুসরাত হত্যাকাণ্ডের বিচার হবেই এবং বিচারে কমপক্ষে ৪-৫ জনের মৃত্যুদ-ও হতে পারে। বাংলাদেশের বিচারিক রায়ে একটি হত্যাা-ের জন্য প্রায় এক ডজন মৃত্যুদণ্ড হয়েছে- এমন নজিরও রয়েছে। কিন্তু তারপরও মানুষ হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। মানব চরিত্র বলে কথা! কয়েকটি ধাপে তার বিশ্লেষণ দেখা যাক। এক. প্রথমেই জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারাকে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর এক নম্বরে ফেলা যায়। আর সেই জন্যই মৃত্যুদ-ের বিধানে পুড়িয়ে মারার বিধানটি কোন দেশেই রাখা হয়নি। তবে আমার মতে, ইনজেকশনের মাধ্যমে মৃত্যুদ- দেয়াটা সবচেয়ে ব্যথাহীন মৃত্যু। ফায়ারিং স্কোয়াড বা ফাঁসি দুটোই কেমন যেন ভয়াবহ। কেননা মৃত্যুর চোয়েও মৃত্যু-আতঙ্ক বড্ড দুর্বিষহ। কথা হলো মৃত্যু তো মৃত্যুই তা যেভাবেই হোক না? যিশু খ্রিস্টের জন্মেরও অনেক আগে গ্রীস ছিল প-িত দার্শনিকদের আড্ডাখানা। সেই তখনকার সময়ে প্লাটোর শিষ্য, এপিকারাস বলেছিলেন, ‘আমরা মানুষ ভয় করি ব্যথা-বেদনাকে এবং মৃত্যুর অন্তিম সময়টাতে ব্যথাও নেই আবার আনন্দও নেই। সুতরাং মৃত্যুকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’ কিন্তু যন্ত্রণা পেতে পেতে মৃত্যু কারোই কাম্য নয়। কিন্তু এই যে টিনএজার মেয়ে, নুসরাত পাঁচ পাঁচটা দিন ব্যথা-বেদনার চূড়ান্ত পর্যায়টি (ডাক্তারি স্কেলে ১০-এর মধ্যে ১০) অনুভব করেছে তার জবাবটা কে দেবে? এই যে কয়েক সপ্তাহ আগে বনানীতে বিল্ডিংয়ের আগুন থেকে বাঁচার জন্য ২০ তলা থেকে লাফ দিয়েছিল একজন। আগুনে মৃত্যু ভয়াবহতা থেকে বাঁচার জন্যই। প্রধানমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন, পুড়িয়ে মারার ব্যাপারটা জঘন্য এবং এক সময় রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে জামায়াত-বিএনপি সেই কাজটিই সজ্ঞানে করেছিল, তার ফল তারাই উপভোগ করছে এখনও। আমি যতটুকু জানি, ইসলাম ধর্মে মৃত মানুষকেও পুড়িয়ে সৎকার করা হয় না। সেক্ষেত্রে জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা এবং তা প্রয়োগ করা- কী ভয়াবহ? বিচারিক রায়ে এই মামলায় এক ডজনের মৃত্যুদ- হলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই! দুই. কিছু কিছু পুরুষ, মেয়ে-মহিলাদের ‘অধ্যক্ষ সিরাজ সাহেবের’ মতো এমনতর কুৎসিৎ প্রস্তাব, জোরপূর্বক বলাৎকার অথবা রিভেন্স নেয়া প্রতিনিয়তই ঘটিয়ে যাচ্ছে। এটা থামার পথ হয়ত কঠিন। তবে যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করে, বিশেষ করে ঈশ্বরের পথে নতুন প্রজন্মকে শিক্ষাদান করে থাকে, তাদের জন্য কঠোর সংযমই সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করে। অধ্যক্ষ ভদ্রলোক শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নন, প্রিন্সিপালও। তারপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি একটি মাদ্রাসা! দায়িত্বটা আরও হাজারো গুণ বেশি নয় কি? উন্নত বিশ্বে আমরা এ ধরনের ঘটনা প্রতিনিয়তই দেখছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, যিশু খ্রিস্টের উপাসনালয়ের যে প্রধান পাদ্রী, তারাই যদি সাধারণ মানুষের মতো কাজ করে তাহলে অত্যাচারিত মানুষ যাবে কোথায়? বাঘের ঘরে ঘোঘের বাসাÑ হরিণ বলে কোথা যাই? অতএব অধ্যক্ষ সিরাজ সাহেবÑ আপনি আপনার রেহাই পাওয়ার কোন পথই খোলা রাখেননি? আপনি নিশ্চয়ই মদ্যপান করেন না। সুতরাং সজ্ঞানে আপনি টিনএজার মেয়েটিকে আদিরসাত্মক প্রস্তাবটি দিয়েছেন। আপনি জেনেশুনে বিষ পানের দিকে এগিয়ে গিয়েছেন। আপনি তো মরবেন, সেই সঙ্গে আরও এক ডজনকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছেন। তিন. আমার একটা রোমান্টিক উপন্যাস, ‘হে ঈশ্বর একি জীবনের প্রতিচ্ছবি?’ কয়েক বছর আগে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক এক হাইস্কুল পড়ুয়া ছাত্রীর সঙ্গে প্রেম করছিল। উপন্যাসের নায়ক, রঞ্জু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে থাকত। টিনএজার নায়িকা, মলি হোস্টেলে প্রায়ই আসত। একদিন রঞ্জু ভাবছে, ‘বৃহস্পতিবার বাসা থেকে কোন একটা কথা বলে হঠাৎ করে দু’তিন ঘণ্টার জন্য মলি হোস্টেলে এলো।’ সরাসরি রঞ্জুর এখানে এসে বলল, ‘রঞ্জু, চলো আমরা ঢাকেশ্বরী মন্দিরে যাই এবং বিয়ে করে ফেলি। তারপর তোমার এখানেই থেকে যাব।’ পরবর্তী সময়ে কি হবে? হঠাৎ পুলিশ এসে কড়া নাড়বে। নাবালিকাকে কিডন্যাপ এবং আটকিয়ে রাখার অপরাধে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে গ্রেফতার এবং হাজতে প্রেরণ। মলিকে জোর করে ধরে নিয়ে যাবে। পরদিন পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠার খবর বেরুবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের কীর্তিকলাপ! কেমন রসাল খবরটা হবে? তার উপর পুলিশের দু’একটা পেঁদানি খেলে কেমন হবে? রঞ্জু আর ভাবতে পারছে না। শরীর শিহরে উঠছে। অথবা, মলি বাসায় প্রকাশ করল যে সে তার রঞ্জু স্যারকে বিয়ে করতে চায়। মলির মা-বাবা, দু’জনের মাথায় হঠাৎ বাজ পড়বে। এ নিয়ে বাকবিত-া। সুযোগ মতো বাড়ি থেকে মলি লাপাত্তা। রঞ্জুর এখানে এসে বলল, ‘রঞ্জু আমি বাসা থেকে, চলে এসেছি। চলো আমরা পালিয়ে ইন্ডিয়া চলে যাই।’ বাধ্য হয়ে যদি পালাতেও যায়, যশোর যাওয়ার বাস থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকসহ নাবালিকাকে উদ্ধার করা হবে। মলি হয়ত বলবে, আমি এডাল্ট। তাহলে বয়স পরীক্ষা কর। পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে ওদের দুজনকে আলাদা করে ফেলবে। কি অবস্থা হবে চিন্তা করা যায়? পরদিন পত্রিকার হেডলাইনই বা কি হবে ভাবা যায়? এরই মধ্যে মলিকে এক গ্রুপ পুলিশ টানাহ্যাঁছড়া করে নিয়ে যাবে। ওর কপালে কি হবে, রঞ্জু চিন্তাই করতে পারছে না। রঞ্জুর কপাল তো শুধু পুড়বে না, একেবারে ছাই হয়ে যাবে। চার. প্রিন্সিপাল সাহেব, আপনি একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক, একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান। আপনি কাজটা করার আগে রঞ্জুর মতো কিছুই ভাবলেন না? কিছুই ভাবলেন না? নুসরাত আপনার প্রেমিক নয়, ছাত্রী। তবে ছাত্রীও প্রেমিক হতে পারে। কিন্তু নুসরাত হতে চায়নি। তারপর কী করে এতটা দুঃসাহসী হয়ে গেলেন? তারপরও যখন জেলে গেলেন, চুপচাপ থেকে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইলে তেমন কিছু হতো না। আর হলেও হয়ত ছোটখাটো সাজা হতো। কিন্তু মেয়েটিকে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা করলেন- আপনি তো নিরক্ষরও নন। প্রভাবশালী বলে শক্তি পেয়েছিলেন, কিছুই হবে না। অপরাধ এবং অপরাধের বিচার সবার জন্য এক। দেখুন সরকারী পুলিশও ফেঁসে গেছে। সরকারী দলের লোকও ফেঁসে গেছে। পাঁচ. এবার মূল কেন্দ্রবিন্দু নিয়ে আলোচনা করা যাক। সৃষ্টির মূলে যে আদিরস তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। সারা বিশ্বজুড়ে অনাদিকাল থেকে চলে আসছে এবং চলবে। কিন্তু তাই বলে আপনি ক্ষমতাশালী হয়ে নিরীহদের নিগৃহীত করবেন- তা তো হয় না। আইন-কানুনের সৃষ্টি তো সেই জন্যই। আইন-কানুন সবার জন্য এক এবং প্রয়োগও এক। দেখুন না প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর জন্য অন্যদের মতো একই আইন প্রয়োগ করা হয়েছে। আইন-কানুন নিয়ে জনগণকে সজাগ এবং সচেতন করতে হবে। আইন এবং আইনের প্রয়োগ নিয়ে মিডিয়াকে আরও সোচ্চার হতে হবে। আমাদের কত ধারণা ভুল প্রমাণিত হচ্ছেÑ মসজিদের ইমাম, চার্চের পাদ্রী কিংবা মন্দির পুরোহিতগণ সুযোগ পেলেই শ্লীলতাহীন কাজ করতে পারে না। শিক্ষকতার পেশায় যারা নিয়োজিত, তারাও শ্লীলতাহীন কাজ করতে পারে না। আজ প্রায় ১৫ বছর ধরে একটি প্রধানত মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি। সেই ১৫ বছর আগে ইন্টারভিউতে আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘আপনি কি মহিলাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে অসুবিধা অনুভব করেন’? আমার উত্তর ছিল, ঘরে তো আমি চারজন মহিলার সঙ্গে বসবাস করি। রীতিমাফিক রুমের দরজা খোলা রেখেই আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। কেননা পান থেকে চুন খসলেই বিপদ। যুক্তরাষ্ট্রে কী তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে না? দেদার ঘটছে। ওই যে বললাম, আদিরসের ধাক্কা অনেকেরই বিপথগামী করে তোলে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ একেবারে সাচ্চা। বিচার বিভাগ এবং এফবিআই শতভাগ অনুকরণীয়। কোন ভেজাল নেই। পাঠকবৃন্দ, বিল কসবির নাম শুনেছেন হয়ত। বিলিয়নিয়ার সেলিব্রেটি, এক্টর, ডিরেক্টর, এবং কমেডিয়ানÑ আমিসহ সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ তার ভক্ত। প্রায় ৫০ বছর আগে ঘটিত যৌন হেনস্তার জন্য তিনি অনেক বছর ধরে হাজত বাস করছেন। ‘হ্যাসট্যাগ মি টু মুভমেন্ট’ এই দেশ থেকেই চালু হয়ে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। কে জানে নুসরাত মাদ্রাসায় পড়লেও, হিজাব পড়লেও, বিশ্বের খবরাখবর, এমন ক্ মি টু মুভমেন্টের খবরও অবশ্যই রাখত। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা, বিচারকগণ এবং আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে যারাই জড়িত, তারা একসঙ্গে, সবাই মিলে সৎ ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করলে বাংলাদেশের সামাজিক শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি, শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই তা সম্ভব এবং আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই তা সম্ভব। ১৬ এপ্রিল ২০১৯ লেখক : আমেরিকা প্রবাসী অধ্যাপক [email protected]
×