রহিম শেখ ॥ ঢাকার ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) আওতাধীন এলাকায় ২২ লাখ স্থাপনা রয়েছে। এরমধ্যে একতলা থেকে ৬ তলার স্থাপনা রয়েছে ২১ লাখ ১২ হাজার। যা নগরীর মোট ভবনের ৯৬ শতাংশ। এসব ভবনের প্রায় ৯৮ শতাংশেরই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। রাজধানী ঢাকার এসব ভবনের অধিকাংশই ভাড়াটিয়া। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্য বলছে, নগরীতে ভাড়াটিয়ার সংখ্যা ৫০ লাখেরও বেশি। রাজধানীর অধিকাংশ বাড়ির মালিকই রাত এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে গেটে তালা দিয়ে চাবি নিজের কাছে রাখেন। এরপর ভাড়াটিয়ারা বাড়ি থেকে বের হতে বা ঢুকতেও পারেন না। অনেক মালিক আবার নিরাপত্তার অজুহাতে দিনের বেলায়ও গেট তালাবদ্ধ রাখেন। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এসব কারণে ভূমিকম্প বা অগ্নিকা-ের মতো বড় ধরনের দুর্যোগ ঘটলে হতাহতের সংখ্যা অনেক বাড়তে পারে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীতে বহুতল ভবন রয়েছে ২ হাজার ৯শ’র বেশি। এসব ভবনের প্রায় ৯০ শতাংশেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। সে হিসেবে প্রায় ২৭শ’ ভবনই অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, ১০ তলার বেশি উচ্চতার ইমারত বহুতল ভবন হিসেবে স্বীকৃত। নগরীতে ১০ তলা এবং ১০ তলার বেশি উচ্চতাসম্পন্ন বহুতল ইমারত রয়েছে ২ হাজার ৯শ’র বেশি। তবে রাজধানীতে বহুতল ভবনের সংখ্যা বেশি নয়। রাজধানীতে যেসব বহুতল ভবন রয়েছে তার বেশি রয়েছে মতিঝিল, গুলশান ও বনানী এলাকায়। বহুতল ভবনগুলোয় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখার পাশাপাশি অগ্নি-প্রতিরোধক দরজা; অগ্নি-প্রতিরোধক ক্ষমতাসম্পন্ন নির্মাণ উপকরণ এবং অগ্নি-নিরাপদ সিঁড়ি রাখার বিষয়টি উল্লেখ আছে। কিন্তু এসবের ধার ধারেন না ইমারত মালিকরা।
জানা গেছে, নগরীর বহুতল ভবনের ফায়ার ফাইটিং সিস্টেমের সক্ষমতার ওপর ২০১১ সালে একটি সার্ভে করা হয়। বুয়েট ও ফায়ার সার্ভিস যৌথভাবে এ সার্ভে পরিচালনা করে। তাতে দেখা গেছে, নগরীর বহুতল ভবনের ৯০ শতাংশেরই অর্থাৎ প্রায় ২৭শ’ ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা সঠিক পাওয়া যায়নি। এসব ভবনে যারা বসবাস বা ব্যবসা-বাণিজ্যর অফিস করেছেন তারা অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সেফটি ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ টিপু জনকণ্ঠকে বলেন, বহুতল যেসব ভবনে সঠিকভাবে ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম স্থাপন করা হয়নি সেগুলোতে অগ্নিকা-ে প্রাণহানি ঘটতে পারে। এটি থেকে বাঁচতে ভবনগুলো রিপেয়ার করে ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম স্থাপন করতে হবে। আর নতুন বহুতল ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড মানতে হবে। তিনি আরও বলেন, বিশেষভাবে তৈরি দরজা যা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাপ ও আগুন সঞ্চালনের প্রতিরোধ কাজ করে এমন দরজা; অগ্নি-প্রতিরোধক ক্ষমতাসম্পন্ন নির্মাণ উপকরণ এবং অগ্নি-নিরাপদ সিঁড়ি যা বিভিন্ন তলা থেকে ল্যান্ডিং বা লবি দ্বারা সংযোজিত অগ্নি-প্রতিরোধক দরজা দ্বারা মূল ভবন থেকে আলাদা হবে ও ইমারতের বহির্ভাগে খোলা স্থানের সঙ্গে উন্মুক্ত থাকবে।
জানা যায়, ঢাকার ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) আওতাধীন এলাকায় ২২ লাখ স্থাপনা রয়েছে। একতলা থেকে ৬ তলার স্থাপনা ২১ লাখ ১২ হাজা। যা নগরীর মোট স্থাপনার ৯৬ শতাংশ। এসব ভবন নিয়ে কখনই কোন সার্ভে করা হয়নি। এসব ভবনের বেশিরভাগেই ভাড়াটিয়াদের বসবাস। ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরে ভাড়াটিয়ার সংখ্যা ৫০ লাখের বেশি। রাজধানীর বাড়িভাড়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নিয়মকানুন না থাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাড়ির মালিকের কথাই হয় শেষ কথা। যদিও ভাড়ার ক্ষেত্রে দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তি হওয়ার বিধান আছে। রাজধানীর অধিকাংশ বাড়ির মালিকই রাত ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে গেটে তালা দিয়ে চাবি নিজের কাছে রাখেন। এরপর ভাড়াটিয়ারা বাড়ি থেকে বের হতে বা ঢুকতে পারেন না। এ কারণে অনেককেই পড়তে হয় দুর্ভোগে। তবে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ভূমিকম্প বা অগ্নিকা-ের মতো বড় ধরনের দুর্যোগে এই ‘কঠোর নিয়মের’ কারণে হতাহতের সংখ্যা বাড়তে পারে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ বাড়িতে দিনের বেলায় নিরাপত্তার জন্য গেটে তালা দেয়া থাকে। সেই তালার একটি করে চাবি থাকে ভাড়াটিয়াদের কাছে। তবে রাতে বাড়িওয়ালা মূল গেটে অতিরিক্ত তালা দেন এবং ওই তালার চাবি সাধারণত ভাড়াটিয়াদের দেয়া হয় না। মালিকদের এই তালা দেয়া হয় রাত ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে। এরপর কোন প্রয়োজনে হলে চাবির জন্য যেতে হয় বাড়ির মালিকের কাছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইতিবাচক সাড়া মেলে না। চাবি চাওয়ায় অনেক বাড়ির মালিক ভাড়াটিয়ার সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও করেন।
জাতীয় ভাড়াটিয়া পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মীর মোফাজ্জল হোসেন মোস্তাক বলেন, এ শহরে বেশিরভাগ মানুষ ভাড়া থাকেন। কিন্তু ভাড়া থাকা এ মানুষগুলোর অধিকার নিশ্চিত হচ্ছে না। বাড়িওয়ালারা ইচ্ছেমতো নিয়ম করেন, যা মানতে হয় ভাড়াটিয়াদের। ১১টার পর গেট বন্ধ করার নিয়ম কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এমনও ঘটনা শুনেছি, কেউ পরিবারের অসুস্থ সদস্যকে রাতে হাসপাতালে নিতে গেটের চাবি চাইতে গেছেন, কিন্তু বাড়িওয়ালা খারাপ ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেন, বাড়িওয়ালার ঘরে থেকেই অগ্নিকা- ঘটলে তাদের উদ্ধার করে বের করে নিতে হলেও গেটের তালা ভাঙতে হবে। সব সময় হাতের কাছে গেটের তালা ভাঙার উপকরণ তো থাকে না।
রাজধানীর সিপাহীবাগ এলাকার ভাড়াটিয়া শরিফুল ইসলাম নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, ‘একদিন রাতে মাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরতে রাত ১১টা পার হয়ে যায়। বাড়িওয়ালার দরজার কলিং বেল বাজিয়ে, ফোন দিয়েও সাড়া পাচ্ছিলাম না। এক ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় মাকে নিয়ে। বাড়িওয়ালা পরে গেট খুলে দিয়েছেন, তবে অনেক খারাপ ব্যবহারও করেছেন।’ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, নানা কারণে দুর্যোগে মানুষ আহত বা নিহত হতে পারে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনাস্থল থেকে মানুষজনকে দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরাতে না পারার কারণে হতাহতের ঘটনা বেশি ঘটে। রাতে গেট যদি বন্ধ হয়, আর আগুন বা ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটে মানুষ দ্রুত বের হতে পারবে না। গেটের কাছে গিয়ে আটকে থাকবে। যেকোন দুর্ঘটনায় হতাহত কমবে শুধুমাত্র দ্রুত সময়ের মধ্যে মানুষজনকে সরানো গেলে। এ কারণে এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি বলেন, শুধু দুর্যোগে নয়, নানা কারণে রাতে বের হওয়া জরুরী হতে পারে। ফলে নিরাপত্তার কারণে গেট বন্ধ করা হলেও সবাই যেন বের হতে পারে সেটির ব্যবস্থা করতে হবে। রাজধানীর মিরপুরের একটি বাড়ির মালিক হাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, বাড়ির গেটে তালা দেয়া হয় ভাড়াটিয়াদের নিরাপত্তার জন্য। আর কেউ বিপদে-আপদে চাবি চাইলে তো দেয়া হয়ই। অন্য বাড়ির মালিকরা কী করেন, আমি জানি না। তবে এটা ঠিক বড় ঘটনা ঘটলে বাড়ি থেকে দ্রুত বের হওয়া জরুরী।’
