ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

টাকা ফেরত না দিতে হত্যা করে এসিডে গলিয়ে দেয়া হয় লাশ

প্রকাশিত: ১১:১৭, ১৯ এপ্রিল ২০১৯

টাকা ফেরত না দিতে হত্যা করে এসিডে গলিয়ে দেয়া হয় লাশ

গাফফার খান চৌধুরী ॥ মালয়েশিয়া পাঠানোর কথা বলে ডেকে নিয়ে হত্যার পর লাশ এসিড দিয়ে গলিয়ে দেয়া সেই হতভাগ্য যুবকের পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। পরিচয় জানার পর বেরিয়ে এসেছে গা শিউরে ওঠা লোমহর্ষক কাহিনী। যা সিনেমার কাহিনীকেও হার মানিয়েছে। খুবই পরিকল্পিতভাবে ওই যুবককে ডেকে নিয়ে অপহরণের পর হাত পা বেঁধে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হত্যার পর লাশ চটের বস্তায় ভরে গভীর জঙ্গলে নিয়ে এসিড দিয়ে গলিয়ে দেয়া হয়েছে। এমন পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড সেই আদম ব্যবসায়ী আজও গ্রেফতার হয়নি। তাকে গ্রেফতার করতে নানা ছদ্মবেশে অভিযান চালাচ্ছেন মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই সদস্যরা। একমাত্র ছেলের এমন পরিণতিতে দিশেহারা পিতামাতা। গাজীপুর সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আতিকুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, চলতি বছরের ১৩ মার্চ স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ নিয়ে গাজীপুরের জাতীয় উদ্যানের গভীর জঙ্গল থেকে প্রায় পুরোপুরি গলিত ও বিকৃত এক পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়। যেখান থেকে ওই পুরুষের লাশটি উদ্ধার করা হয়, সেই জায়গাটি গাজীপুর জাতীয় উদ্যানের ৩ নম্বর গেট থেকে অন্তত দুই কিলোমিটার পূর্ব দিকে ৯ নম্বর অবকাশ নামের পিকনিক স্পটের অনেক দক্ষিণে খালেক ডিলারের পুকুরের পশ্চিম পাশে অবস্থিত। সেখানে ঘন জঙ্গলে ঘেরা। উদ্ধারকালে দেখা যায়, ওই ব্যক্তির প্রায় পুরো শরীর পচে গেছে। আর পচন ধরা শরীরে লাখ লাখ পোকা মাকড় কিলবিল করছিল। মুখের দাড়ি পচন ধরে ওঠে গেছে। মুখম-ল ও গলা পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছিল। হাত দুইটি বাঁকা হওয়া। হাতের আঙ্গুলের মাংস পোকায় খেয়ে ফেলেছিল। শুধু হাড়গুলো দেখা যাচ্ছিল। বুক, পেট, পিঠ, কোমর থেকে পা পর্যন্ত পুরোপুরি পচে গিয়েছিল। লাশটি গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। এ ঘটনায় গাজীপুর সদর থানায় ওই দিনই ৬২৪ নম্বর একটি জিডি করা হয়। পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার জনকণ্ঠকে বলেন, চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকা-ের রহস্য উদ্ঘাটনে পুলিশের সঙ্গে ছায়া তদন্ত করে যাচ্ছে পিবিআই। ইতোমধ্যেই পিবিআই হত্যাকা-ের শিকার হওয়া সেই যুবকের পরিচয় শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। পরিচয় জানার পর বেরিয়ে এসেছে সেই যুবক হত্যার লোমহর্ষক কাহিনী। পিবিআইয়ের গাজীপুর জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাসির আহমেদ জনকণ্ঠকে জানান, ঘটনাস্থল থেকে নিহতের নানা আলামত সংগ্রহ করা হয়। আর অজ্ঞাত লাশ হিসেবে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পড়ে থাকা লাশ থেকেও আলামত সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত আলামত বিদেশ থেকে সরকারের তরফে পিবিআইয়ের জন্য আমদানি করা বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। আর তাতেই মিলে নিহতের পরিচয়। পরবর্তীতে সেই ব্যক্তির পরিচয় সরেজমিনে গিয়েও যাচাইবাছাই করে সত্যতা পাওয়া গেছে। নিহত ব্যক্তির নাম আবদুল কাইয়ুম (৩২)। পিতার নাম জালাল উদ্দিন আহাম্মদ। মায়ের নাম ফাতেমা আক্তার। বাড়ি গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর থানাধীন নিশিন্দহাটি গ্রামে। কাইয়ুম পরিবারের সঙ্গে ঢাকার তেজগাঁও থানাধীন তেজকুনিপাড়ায় বসবাস করতেন। নিহত কাইয়ুমের পিতা জালাল উদ্দিন আহাম্মদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। জনকণ্ঠকে বলেন, তিনি এক সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চাকরি করতেন। সেই সুবাদে থাকতেন তেজকুনিপাড়ায়। নিহত কাইয়ুম আমাদের একমাত্র পুত্র ছিল। কাইয়ুম সূতার ব্যবসা করত। পাশাপাশি আইটি বিষয়ে পড়াশোনা করত। আমাদের দুই মেয়ে বিবাহিত। আমি চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর ছেলে আমাদের অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল করার চেষ্টা করতে থাকে। বেশি পড়াশোনা না করায় সে বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কাইয়ুম তার দুই আত্মীয়ের সঙ্গে মিলে তিন জন একত্রে বিদেশ যাওয়ার জন্য চেষ্টা করছিল। মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য ঢাকার একটি রিক্রুটিং এজেন্সিকে তিন জনে মিলে ৯ লাখ টাকা দিয়েছিল। আড়াই বছর আগে নয় লাখ টাকা দিলেও এজেন্সিটি তাদের বিদেশ না পাঠিয়ে ঘুরাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত তারা তিন জনই বিদেশ না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা পাওনা টাকা এজেন্সির কাছে ফেরত চায়। এরপর চলতি বছরের ৯ মার্চ বেলা এগারোটার দিকে কাইয়ুম বাড়ি থেকে বের হয়। যাওয়ার সময় বলে যায়, রিক্রুটিং এজেন্সির ওখানে যাচ্ছে। তারা খবর দিয়েছে। মালয়েশিয়া যাওয়ার আগে তারা প্রশিক্ষণ দিবে। প্রশিক্ষণ খুবই কঠিন। খুবই কষ্টকর কাজ। এজন্য খুব একটা মোবাইল ফোনে তাকে পাওয়া যাবে না বলে জানায়। বাড়ি থেকে বের হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর থেকেই তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। সর্বশেষ চার দিনের মাথায় তার লাশ পায় পুলিশ। আমরা ছেলের খুন হওয়ার খবর পাই আরও দেরিতে। ছেলের পরিচয় জানার পর পুলিশের মাধ্যমে আমরা ছেলের মৃত্যু সংবাদ পাই। পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলছেন, এখন পর্যন্ত আমাদের তদন্তে যা পাওয়া গেছে, সে মোতাবেক কাইয়ুম বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় যে কথাগুলো তার পরিবারকে বলেছিল, সেগুলো ছিল রিক্রুটিং এজেন্সির লোকজনের শিখিয়ে দেয়া। এটি ছিল মূলত কাইয়ুমকে নিরাপদে অপহরণ করার কৌশল। সেই ফাঁদে পা দিলে কাইয়ুমকে তারা নিরাপদে অপহরণ করে। এরপর আর যাতে কাইয়ুমদের তিন জনের পাওনা নয় লাখ টাকা না দেয়া লাগে, এজন্য তারা কাইয়ুমকে অপহরণ করে। কারণ কাইয়ুম ছাড়া অপর দুইজন রিক্রুটিং এজেন্সি সম্পর্কে তেমন জানত না। যে তিন জনের বিদেশ যাওয়ার কথা ছিল, তারা ছিল স্পরস্পর খালাত ভাই। বিশ্বাস করে কাইয়ুমের মাধ্যমে অপর দুই জন টাকা দিয়েছিল। এজন্য ওই দুইজন কাইয়ুমের কাছে পাওনা টাকা চাইত। এজেন্সির কাছে তারা টাকা চাইত না। এজন্য এজেন্সির ধারণা ছিল, কাইয়ুমকে হত্যা করে লাশ গলিয়ে দিলে আর কোন দিনই নয় লাখ টাকা দিতে হবে না। তার সূত্রধরেই ফাঁদ পেতে কাইয়ুমকে বিদেশ পাঠানো বা টাকা ফেরত দেয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে অপহরণ করে। তদন্ত মোতাবেক কাইয়ুমকে গাজীপুর এলাকায় যেতে বলেছিল অপহরণকারীরা। সেখানে যাওয়ার পর তাকে অপহরণ করে। অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হত্যার পর লাশ চটের বস্তায় ভরে গভীর জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বস্তায় এসিড ঢেলে পুরো লাশ গলিয়ে দেয়া হয়।
×