ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শিল্পীর চোখে দগ্ধ নারী এবং সচেতনতা

প্রকাশিত: ১৩:৪৩, ১৯ এপ্রিল ২০১৯

শিল্পীর চোখে দগ্ধ নারী এবং সচেতনতা

নারীর অর্জন ও কৃতিত্ব এবং নারীর এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে বাধাবিপত্তি ও এর সমাধানকে চিহ্নিত করতে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া একটি নারীবাদী আন্দোলনের নাম ‘উইমেন অফ দা ওয়ার্ল্ড ‘যা সংক্ষেপে ‘ওয়াও’ নামে পরিচিত। ব্রিটিশ কাউন্সিলের উদ্যোগে গত ৫-৬ এপ্রিল বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ওয়াও উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে এই আয়োজনটি ছিল এবারেই প্রথম যা নয় বছর আগে লন্ডনে জুড কেলির হাত ধরে যাত্রা শুরু করে। এই উৎসবে এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের ব্যানারে শিল্পী ফারজানা হোসেনের তিনটি ভিন্ন আঙ্গিকের শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে। এই শিল্পকর্মগুলোর বিষয়বস্তু হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বলি এসিডদগ্ধ ও আগুনে প্রজ্বলিত তিনজন তরুণীর মর্মস্পর্শী জীবনকাহিনী। শিল্পী ফারজানা হোসেন মূলত ডকুমেন্টারি নির্মাতা ও আলোকচিত্রী। শিল্পীর সঙ্গে এই শিল্পকর্ম নিয়ে কথা বলেছি, কথা বলেছি এসিড সন্ত্রাসের শিকার অসহায় নারীদের নিয়ে এবং এর সমাধান ও উত্তরণের উপায় নিয়েও তিনি কথা বলেছেন। অপরাজিতা : তিনটি ভিন্ন আঙ্গিকের চিত্রকর্ম এ সম্পর্কে বলুন। ফারজানা : আমার এই কাজগুলো মূলত একটি কাজ এবং সেটি নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে। যৌতুক দিতে না পারা, স্বামীর দ্বিতীয় বিয়েতে সম্মতি না দেওয়া, বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়া এবং প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা- এসব কারণে নারীরা সাধারণত সহিংসতার শিকার হয়। এখানে তিনজন তরুণীর জীবনের গল্প আমি বলেছি। মারিফা নামের একজন সম্ভাবনাময় তরুণী পড়ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগে। সহপাঠীর প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায় ছেলেটি তার বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতে থাকে। এই আবেগপ্রবণ মেয়েটি সেটি সহ্য করতে না পেরে তার বিভাগের ল্যাব থেকে এসিড নিয়ে গিলে ফেলে। তাকে দ্রুত হাসপাতালে আনা হয়, এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন তার পাশে দাঁড়ায় কিন্তু সে বাঁচে না। মারিফার ডায়েরি ও ছবি আমি সংগ্রহ করেছি এবং সেসব এখানে প্রদর্শন করছি। অপরাজিতা : চাদর দিয়ে ঢাকা নারীর অবয়ব।’ জানতে চাই। ফারজানা : আসলে তিনটি শিল্পকর্মে আমি অভিন্ন একটি মাত্রা যোগ করতে চেয়েছি যে কারণে আমার কাছে তিনটিই একইসূত্রে গাঁথা। এটি হচ্ছে মারিয়াম নামের একজন তরুণী শীতের রাতে কম্বল গায়ে দিয়ে গভীর ঘুমে নিমগ্ন ছিল। ঘুমের মধ্যে একটি উষ্ণ প্রবাহের অস্তিত্ব সে অনুভব করে, মনে হচ্ছিল সেটি হবে আরামদায়ক। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার শরীর ঝলছে যায় স্বামীর দেওয়া এসিডে। গরিব ঘরের মেয়েকে যৌতুক দিতে না পারার শাস্তি হিসেবে এভাবেই সহিংসতার শিকার হতে হয়। স্বামী ছিল সিএনজি ড্রাইভার তাই এসিডের জন্য বেশিদূর যেতে হয়নি সিএনজিতে রক্ষিত এসিড দিয়ে সে তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে। মেয়েটিকে এরপর প্রতিবেশীদের সাহায্যে দ্রুত হাসপাতালে আনা হয় এবং সৌভাগ্যক্রমে সে প্রাণে বেঁচে যায়। তার আসল নাম প্রকাশ করিনি, মারিয়াম তার ছদ্মনাম। অপরাজিতা : একটি ছবিতে শুধু আগুনের শিখা এটা কি? ফারজানা : এই ভিডিওটি করেছি এনি নামের একটি মেয়ের দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা মনে রেখে। যৌতুক দিতে ব্যর্থ হওয়ায় সে শ্বশুর, শাশুড়ি ও ননদের প্রতিহিংসার করুণ শিকারে পরিণত হয়। তারা সম্মিলিতভাবে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে তার মৃত্যু হয়। সে ছিল হিন্দু মেয়ে, তাই মৃত্যুর পর তাকে চিতার আগুনে পোড়ানো হয়। সে অগ্নিদগ্ধ হবার পর হাসপাতালে যখন জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিল তখন আমি তার সঙ্গেই ছিলাম। এই দুই বার যে তাকে পোড়ানো হয় সেটি আমার মনে বিশেষভাবে দাগ কাটে। তাই আমি তার জীবনের শেষ দৃশ্য চিতার আগুনকে ভিডিও তে দেখিয়েছি। অপরাজিতা : দায়িত্ববোধ অথবা মানসিক তাড়নায় এমন শিল্প কর্ম? ফারজানা : আমি পাঠশালায় ফটোগ্রাফিতে পড়াশোনা করেছি। এখানে তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী থাকাকালীন সময়ে সোশাল ডকুমেন্টারি নিয়ে কাজ করার বাধ্যবাধকতা ছিল। তখনই আমি আমাদের সমাজে নারী নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্রটি আমার কাজের মাধ্যমে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নেই। এসিড সন্ত্রাসের মতো ভয়াবহ ঘটনা আমার হৃদয়কে আলোড়িত করে প্রচ-ভাবে তাই গত ছয়বছর ধরে এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের সঙ্গে কাজ করছি। এতে এসিড সন্ত্রাসের শিকার অসহায় মেয়েদের কাছে থেকে দেখার সুযোগ হচ্ছে। আর একজন শিল্পী হিসেবে সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গাটিকে অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। শিল্পকর্মের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। অপরাজিতা : এসিড নিক্ষেপ এবং আরও নির্যাতন নিয়ে ভাবনা। ফারজানা : এসিডকে নারী নির্যাতনের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতা অনেকটা কমে এসেছে কিন্তু অন্য অনেকভাবে নারী নির্যাতনের হার বেড়ে চলেছে। আমার মতে, এসিড নিক্ষেপসহ যে কোন ধরনের সহিংসতার ক্ষেত্রে আইনকে আরও শক্তিশালী করে এর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধ করার পর দোষীরা যদি স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে এবং নির্যাতনের শিকার মেয়েদেরকে ও তাদের পরিবারকে হুমকি দিতে থাকে, তবে এসব মেয়েরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে ও সেটি কাটিয়ে ওঠা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। পুরুষদের মধ্যে মনুষ্যত্ব বোধ সৃষ্টি করতে হবে ছোটবেলা থেকে পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষার মাধ্যমে। প্রয়োজনে তাদের কাউন্সিলিং করতে হবে।
×