ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান

ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলা

প্রকাশিত: ১৩:৪৬, ১৯ এপ্রিল ২০১৯

ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলা

বাঙালী সংস্কৃতির মূল পটভূমি হচ্ছে গ্রাম। হাজার বছরের গ্রামীণ সংস্কৃতি হচ্ছে আমাদের ঐতিহ্য। এই ডিজিটাল যুগে, আধুনিকায়ন ও বিশ্বায়নের প্রভাবে গ্রামগুলো এখন আর গ্রাম নেই। কালের বিবর্তনে ও আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতি হুমকির মুখে। বর্তমানে গ্রামে গিয়ে পাওয়া যায় না, সেই ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ সংস্কৃতি। ইতোমধ্যেই হাজার বছরের বাঙালী সংস্কৃতির অনেক কিছুই বিলুপ্তির পথে আবার অনেক কিছুই প্রায় বিলুপ্ত। বিশেষ করে ঐতিহ্যবাহী অনেকগুলো লোকজ খেলা এখন প্রায় বিলুপ্ত। এসব বিষয়ে আমাদের খুব বেশি একটা মাথা ব্যথা নেই। বই পুস্তকে বাঙালী সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলাগুলোর নাম পাওয়া গেলেও বর্তমানে অধিকাংশ খেলার প্রচলন নেই। সরকারী ও বেসরকারীভাবে হাজার বছরের বাঙালী সংস্কৃতির লোকজ খেলাগুলোর বিকাশে তেমন একটা উদ্যোগ চোখে পড়ে না। বৈশাখ মাস আসার আগেই আমরা শহুরে মানুষগুলো ষোলো আনা বাঙালী হওয়ার প্রস্তুতি নেয়া শুরু করি। বর্তমানে ঈদ ও পূজার মতোই পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বৈশাখী পাঞ্জাবি ও শাড়ি কেনায় আমরা কাপড়ের দোকানে ভিড় করি। বাঙালী সংস্কৃতির শিকড়ে পৌঁছে ধুমধাম করে পহেলা বৈশাখ পালন করতে আমাদের থাকে নিরন্তর প্রচেষ্টা। দেশের সর্বত্র বিভিন্ন সরকারী, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসহ আরও বিভিন্ন ধরনের সংগঠনগুলো প্রতিযোগিতামূলকভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। কারা কতটা বাঙালী সংস্কৃতির শিকড়ে পৌঁছে বৈশাখী অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পেরেছে, সেটা নিয়ে পুরো বৈশাখ মাসজুড়ে চলে আলোচনা ও সমালোচনা। অধিকাংশ আয়োজন পান্তা ভাত এর সঙ্গে সর্ষে ইলিশ ভাজা খাওয়া আর বাউল গান গাওয়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে। আমরা অনেকেই ভুলে গেছি, গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলাগুলো আমাদের বাঙালী সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান অংশ। বাঙালী সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলাগুলো সম্পর্কে আমাদের বর্তমান প্রজন্মের কোন ধারণা নেই। পহেলা বৈশাখের বিভিন্ন আয়োজনে বাঙালী সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলাগুলো নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে উল্লেখযোগ্য তেমন কোন উদ্যোগ দেখা যায় না। বাঙালী সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ লোকজ খেলাগুলোর মধ্যে কুতকুত, কড়ি খেলা, লুডু, সাত চারা, ধাপ্পা, রস-কস, ঘুড়ি ওড়ানো, পাশা খেলা, ডাংগুলি, গোল্লাছুট, বউচি, এক্কাদোক্কা, এচিং বিচিং, এলাটিং বেলাটিং, কানামাছি, দাঁড়িয়াবান্ধা, মার্বেল খেলা, মাটিম খেলা, ষোলোগুটি, কাবাডি, নুনতা খেলা, পুতুল খেলা, চড়ুইভাতি, ব্যাঙের বিয়ে, লাঠি খেলা, মোরগ লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই, ঘোড়া দৌড়, নৌকা বাইচ, কুস্তি, বলি খেলা প্রভৃতি হচ্ছে উল্লেখযোগ্য। এসব খেলা এক সময় অনেক বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় ছিল। এছাড়াও আরও অনেক গ্রামীণ লোকজ খেলা আছে। বর্তমানে এসব খেলার চর্চা না থাকার কারণে অধিকাংশ খেলা এখন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আমাদের নতুন প্রজন্ম ঘরে বসে প্রযুক্তির আধুনিক খেলা খেলে ও কার্টুন দেখে বিনোদন করে। গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলার সঙ্গে তাদের কোন সম্পৃক্ততা নেই। অধিকাংশ শহুরে বাচ্চারা এসব খেলার নাম পর্যন্ত জানে না। গ্রামের বাচ্চারাও শহুরে বাচ্চাদের মতোই প্রযুক্তির আধুনিক খেলা নিয়ে ব্যস্ত। তারাও এখন লোকজ খেলাগুলো থেকে বহু দূরে সরে গেছে। যদি এভাবেই চলতে থাকে, অদূর ভবিষ্যতে হাজার বছরের বাঙালী সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলাগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির কম্পিউটার বা মোবাইল গেমস ও দেশে প্রচলিত বিদেশী খেলাগুলো থেকেও অনেক বেশি মজার খেলা হচ্ছে আমাদের ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলা। আমাদের গ্রামীণ লোকজ খেলাগুলোর অধিকাংশ খেলার মাঝে আছে অনেক মজার মজার ছড়া ও গান। এই খেলাগুলো নতুন প্রজন্মের কাছে সুন্দরভাবে তুলে ধরতে পারলে, তারা খেলাগুলোতে আকৃষ্ট হয়ে সহজেই রপ্ত করে নেবে এবং প্রাণবন্ত বিনোদন পাবে। গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলাগুলো বাঁচিয়ে রাখতে এখনি সময় ভাল কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা। নতুন প্রজন্মের প্রাইমারি বা কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। সেই জন্য সংশ্লিষ্ট স্কুল কর্তৃপক্ষের এগিয়ে আসতে হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করে ছিলাম। আমি ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলাগুলো বাঁচিয়ে রাখতে কিছু পরামর্শ প্রদান করে ছিলাম। স্কুল কর্তৃপক্ষ আমার পরামর্শের প্রশংসা করলেও কেউ কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। অনেকটাই নিরাশ হয়ে শিশু একাডেমির একজন পরিচালকের কাছে গিয়ে বিস্তারিতভাবে এই বিষয়ে আলোচনা করি। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেছিলেন, এই বিষয়ে উনারা উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। তারপর আমি উনার সঙ্গে আরও দুই একবার এই বিষয়ে যোগাযোগ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ছিলাম। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা সবচেয়ে বেশি জরুরী। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে খুব সুন্দর ও আকর্ষণীয়ভাবে আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলাগুলো তুলে ধরতে পারে। এছাড়াও শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে এগিয়ে আসতে পারে। গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলাগুলো যেন স্কুল পর্যায়ে চর্চা করা হয়, এই বিষয়ে নির্দেশনা দিতে পারে। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলো এগিয়ে আসতে পারে। হাজার বছরের বাঙালী সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ লোকজ খেলাগুলো নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতামূলক ইভেন্ট আয়োজন করতে পারে। আমরা দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে গানের, নাচের, অভিনয়েরসহ বিভিন্ন মেধাভিত্তিক ইভেন্ট আয়োজন করতে দেখি। বাঙালী সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলাগুলো নিয়ে এমনিভাবে কিছু ইভেন্ট আয়োজন করলে খেলাগুলো আবারও জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। আমাদের নতুন প্রজন্ম বিদেশী খেলার পাশাপাশি দেশীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলোর দিকে ধাবিত হবে। এতে করে আবারও গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলাগুলোর সুদিন ফিরে আসবে। সর্বোপরি, এই দেশ আমাদের এবং দেশের লোকজ সংস্কৃতি আমাদের ঐতিহ্য। যদি দেশকে ভালবাসি, তাহলে দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি ভালবাসা থাকবেই। সেই ভালবাসা থেকেই বাঙালী সংস্কৃতির গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলাগুলো বাঁচিয়ে রাখতে আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে।
×