ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শরণার্থীবাহী কনভয়ে পাকবাহিনীর গুলিবর্ষণ

প্রকাশিত: ০৯:১৮, ২০ এপ্রিল ২০১৯

 শরণার্থীবাহী কনভয়ে পাকবাহিনীর গুলিবর্ষণ

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল দিনটি ছিল মঙ্গলবার। এই দিনে এমএনএ আতাউর রহমান কায়সার, এমএনএ এ্যাডভোকেট নূর আহমদ, এমএনএ এম ইদ্রিস, এমপিএ ডা. বিএম ফয়েজুর রহমান, এমএনএ আবু সালেহ, এমপিএ ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী, এমপিএ এ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম, ডা. জাফর, ডা. কামাল-এ-খান নাফ নদী পার হয়ে আরাকানের বলিবাজারে বার্মা সরকারের প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন। বার্মা কর্তৃপক্ষ উত্তরে জানায়, শরণার্থী বাঙালীদের তারা আশ্রয় দেবে। তবে, শরণার্থীদের ক্যাম্পে অন্তরীণ থাকতে হবে। খাদ্য-চিকিৎসা-নিরাপত্তার ব্যবস্থা বার্মা সরকার করতে পারবে না। ক্যাম্প থেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোন কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না। বার্মা সরকার হতে অসহযোগিতামূলক আচরণ পেয়ে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। সকাল ১০টায় ইপিআরদের নেতৃত্বে কুড়িগ্রাম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থানীয় যুবকদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ওইদিন দুপুর ২টার দিকে পাকবাহিনী কুড়িগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। ইপিআর নতুন শহরে গিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পাকবাহিনীর ভারী অস্ত্রশস্ত্রের প্রচ- গোলাবর্ষণের কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের অপ্রতুল প্রতিরোধ ভেঙ্গে যায়। সন্ধ্যার দিকে পাকবাহিনী নতুন শহরে প্রবেশ করে। সেদিনই কুড়িগ্রাম শহর পাকবাহিনীর দখলে চলে যায়। মুক্তিবাহিনী সিলেটে পাকবাহিনীর একটি দলকে শেওলা ঘাট এলাকায় আক্রমণ চালায়। এতে ৮ জন শত্রুসেনা নিহত হয়। পরে মুক্তিযোদ্ধারা শেওলাঘাট ফেরী ধ্বংস করে পাকসেনাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিঘ্নিত করে। এদিন পাকবাহিনী প্রথম সাতক্ষীরাতে আসে। আসার সময় যশোর-সাতক্ষীরা সড়কের ঝাউডাঙ্গা বাজারে তাদের কনভয় পৌঁছলে ভারতগামী এক বিশাল শরণার্থী দলের ওপর তারা গুলিবর্ষণ করে। তাতে বহু নারী-পুরুষ ও শিশু হতাহত হয়। হানাদার বাহিনী হেলিকপ্টার থেকে শেরপুরে প্রতিরোধ বাহিনীর ওপর শেলিং করে। এতে বহু সামরিক, বেসামরিক ব্যক্তি হতাহত হয়। সারা শেরপুরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে নেতৃবৃন্দ। কেননা যারা ভারত যেতে চাচ্ছে, তাদেরকে বাধা প্রদান করছে পাকিস্তানের দালালরা। এমন সময় সুবেদার হাকিম শেরপুরে এলেন। তিনি যারা দেশত্যাগ করছে, তাদের নিরাপদে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নিলেন। মুক্তিবাহিনীর মিরেশ্বরাই অবস্থানের ওপর পাকবাহিনীর দুটি ব্যাটালিয়ন ভারি অস্ত্রশস্ত্রসহ আক্রমণ চালায়। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধে শতাধিক শত্রুসেনা নিহত হয়। পাক বাহিনী বুড়িঘাট-নানিয়ারচর হয়ে মুক্তিবাহিনীর মূল প্রতিরক্ষা কেন্দ্র মহালছড়ির দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা চালায়। এ সময় ৮ম ইস্ট বেঙ্গলের একটা অংশ এবং ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের কতিপয় সদস্য পার্বত্য চট্টগ্রামে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিল। ঐদিন ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফ বুড়িঘাট অঞ্চলের চিংড়ি খালের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত কোম্পানির মেশিন গানার হিসেবে রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি নৌপথে প্রহরারত ছিলেন। মুন্সী আবদুর রউফ তাঁর নিজের অবস্থান থেকে মেশিনগান দিয়ে শত্রুর ওপর গোলাবর্ষণ অব্যাহত রাখেন- যার ফলে শত্রুর ২টি লঞ্চ ও ১টি স্পীড বোট পানিতে ডুবে যায় এবং এক প্লাটুন শত্রু সৈন্য সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়। তার বীরত্বপূর্ণ পদক্ষেপের ফলে পাকবাহিনী মহালছড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের মূল প্রতিরক্ষা ব্যুহের দিকে অগ্রসর হতে পারেনি। হঠাৎ করেই মর্টারের গোলা তাঁর অবস্থানে আঘাত করলে তিনি শাহাদাতবরণ করেন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ মুক্তাঞ্চল থেকে এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। এদিন গর্ভনর ও সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল টিক্কা খান স্বাধীন বাংলাদেশের মহামান্য উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, বেতারের উপদেষ্টা আবদুল মান্নান এমসিএ, আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমদ ও দি পিপল-এর সম্পাদক আবিদুর রহমানকে আগামী ২৬ এপ্রিল সকাল ৮ টায় ঢাকার এক নম্বর সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়। নেজামে ইসলাম পার্টির আলহাজ সৈয়দ মোস্তফা আল মাদানী, হাজী আকিল সাহাব, এ্যাডভোকেট সৈয়দ আনিসুর রহমান, মওলানা আজিজুল হক ও হাফেজ আহমদ করিম ঢাকায় এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, ভারতের সহযোগিতায় সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রবেশ পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের ওপর পরিষ্কার হামলা স্বরূপ। ঢাকায় খাজা খয়েরউদ্দিনের সভাপতিত্বে শান্তি কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে শান্তি কমিটির নেতারা দেশের সব জায়গায় শান্তি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। এ ব্যাপারে যোগাযোগের জন্য গোলাম আযম, মাহমুদ আলী, এ. জে. খদ্দর, আবুল কাশেমকে দায়িত্ব দেয়া হয়। একাত্তরের এই দিনে ব্রিটেনে ম্যারিয়েটার নিজ বাড়িতে অনুষ্ঠিত এক সভায় অংশ নেন পিস প্রেজ ইউনিয়ন, ইন্টারন্যাশনাল কনসেন্স ইন এ্যাকশন, পিস নিউজ, ইয়ং লিবারেলস, থার্ড ওয়ার্ল্ড রিভিউ, বাংলাদেশ নিউজ লেটার ফ্রেন্ডস পিস কমিটি এবং বাংলাদেশ স্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধিগণ। এই সভাতেই সর্বসম্মতিক্রমে পল কনেটকে সভাপতি আর ম্যারিয়েটাকে সাধারণ সম্পাদক করে গড়ে তোলা হয় একটি নতুন সংগঠন- এ্যাকশন বাংলাদেশ, যার প্রধান কাজ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীদের দ্বারা সংঘটিত নৃশংসতা সম্পর্কে বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করা। এই দিন আনন্দবাজার পত্রিকা মেহেরপুর আবার মুক্ত, শালুটিকরও বাংলাফৌজ নিয়ে নিল- সোমবার সাফল্যের পর সাফল্য শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, শ্রীহট্ট শহরের অদূরে শালুটিকর বিমানবন্দরে গত কয়েকদিন ধরে দুই পক্ষের মরীয়া আক্রমণ চলছিল। পাকফৌজ সেখানে যেতে বাধ্য হয়েছে। আমাদের সংবাদদাতা শ্রী ধ্রুব মজুমদার জানাচ্ছেন, প্রায় ১৫০ জন্য পাকসেনা আত্মসমর্পণ করেছে মুক্তিফৗজের কাছে, ওদিকে হতাহতের সংখ্যা অনেক। এদিন দুপুরের দিকে খবর আসে যে, ভারতে সীমান্তবর্তী মেহেরপুর পাকফৌজ দখল করে নিয়েছে। সন্ধ্যার পর আবার আনন্দ সংবাদ। মুক্তিবাহিনী এখান থেকে হটিয়ে দিয়েছে হানাদারদের। আগরতলা থেকে ২০ মাইল দূরে ভারত সীমান্তের কমলাসাগরের ওপাশে কসবায় পাকবাহিনী ক’দিন ধরে ছাউনি গেড়েছিল। এই সমৃদ্ধ গ্রামটিতে পাকফৌজ যথেচ্ছ লুটতরাজ ও অগ্নিকা- চালিয়েছে। এদিন ভোর তিনটার দিকে ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে মুক্তিফৌজ অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে দেড়’শ’ শত্রুসৈন্য হত্যা করে অঞ্চলটি দখল করে নিয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও পাকফৌজ কঠিন প্রতিরোধের সম্মুখীন। হার্ডিঞ্জ বা সারা সেতুর লড়াই এখন তুমুল। ফেনীর কাছে এক আকস্মিক সংঘর্ষে দেড়শ’ পাকফৌজ নিহত হয়েছে। এখানে পাক বিমান বাহিনী বোমাবর্ষণ করেছে। রংপুর ও লালমনিরহাটের মধ্যে সড়ক ও রেলপথের যোগাযোগ ব্যবস্থাও আজ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে মুক্তিফৗজের তৎপরতায়। ঢাকা শহরের আশপাশে এবং টাঙ্গাইলেও অবিরাম লড়াইয়ের খবর পাওয়া গেছে। আজ পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, বাংলাদেশের বড় বড় শহরগুলো বস্তুত জনশূন্য। সেনাবাহিনী অধিকৃত খুলনা বেতার কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে, এই শহরের প্রায় তিন হাজার অধিবাসী গ্রামে চলে গেছেন। রংপুর অঞ্চলে ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর থেকে উত্তর অগ্রসরমাণ একটি পাক বাহিনীকে মুক্তিফৗজ প্রবলভাবে বাধা দেয়। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×