ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা ইস্যুতে ষড়যন্ত্র থামছে না মিয়ানমারের

প্রকাশিত: ১০:২৪, ২০ এপ্রিল ২০১৯

 রোহিঙ্গা ইস্যুতে ষড়যন্ত্র থামছে না মিয়ানমারের

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ রোহিঙ্গা ইস্যুটি বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আলোচিত। সে দেশের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানে টিকতে না পেরে বাংলাদেশে ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়ে আছে। বাংলাদেশ সরকার এদের ‘জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে তাদের প্রতি মানবিক আচরণ অব্যাহত রেখেছে। বিশ্বের এমন কোন দেশ নেই, যারা মিয়ানমারকে তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানায়নি। বিপরীতে মিয়ানমার পক্ষ এসব আহ্বান কোনভাবে আমলে না নিয়ে উল্টো নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, মিয়ানমার তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থে বলি করেছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের। বাংলাদেশের পক্ষে দফায় দফায় আহ্বান জানানোর পর এদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মিয়ানমার পক্ষ সমঝোতা স্বাক্ষর করেও তা বাস্তবায়ন থেকে বিরত রয়েছে। এটি তাদের পূর্ব পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রেরই একটি অংশ হিসেবে বিভিন্নভাবে স্থান করে নিয়েছে। একটি প্রতিবেশী দেশ হিসেবে মিয়ানমার বাংলাদেশের প্রতি এখনও যেসব আচরণ প্রদর্শন করে চলেছে তা কূটনৈতিক সম্পর্কের শিষ্টাচার বহির্ভূত বলে বিবেচিত হয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুর পর মিয়ানমার তাদের সরকারী ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনকে তাদের মানচিত্রে নিজেদের বলে দেখিয়ে নতুন ষড়যন্ত্রের বহির্প্রকাশ ঘটিয়েছে। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে সশস্ত্র বিজিবি দলের সদস্যদের মোতায়েন করেছে। সর্বশেষ মিয়ানমার বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্ত বরাবর নিজেদের অভ্যন্তরে খালের ওপর ব্রিজ নির্মাণ প্রকল্পও আরেক ষড়যন্ত্র বলে আলোচনার ঝড় তুলেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শূন্য রেখা বরাবর ঘুমধুম পুরো ইউনিয়নটি এই ব্রিজ নির্মাণের কারণে বিপর্যয়ের কবলে পড়বে। আগামী বর্ষা মৌসুমে এর জের টানতে হবে সীমান্তের উভয় পারের ঘুমধুমের অধিবাসীদের। এছাড়া রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের এখনও প্রায় পাঁচ হাজার মিয়ানমার অভ্যন্তরে শূন্য রেখায় আশ্রয় নিয়ে আছে। খালের ওপর পিলার সর্বস্ব ব্রিজ নির্মাণের কারণে আগামী বর্ষায় এসব রোহিঙ্গাদের আশ্রয়স্থল পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এলাকাবাসীর পক্ষে ওজোর আপত্তির কারণে বৃহস্পতিবার তুমব্রুর জিরো পয়েন্টে বাংলাদেশ অভ্যন্তরে বিজিবি ও বিজিপির মধ্যে প্রায় দু’ঘণ্টাব্যাপী ফ্লাগ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে নানা বিষয়ে আলোচনা হলেও মিয়ানমার পক্ষ তাদের ব্রিজ নির্মাণ বন্ধ করার কোন সিদ্ধান্ত দেয়নি। শুধু বলেছে, বর্ষায় ব্যাপক জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলে তারা ব্রিজ সংলগ্ন স্লুইচগেট খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। কিন্তু এলাকাবাসীর অভিযোগ, এটি পরিকল্পিত ব্রিজ নির্মাণ প্রকল্প, যাতে শূন্য রেখায় আশ্রয় নেয়া হাজার হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা সেখানে আর অবস্থান নিয়ে থাকতে না পারে। পতাকা বৈঠকের পর বিজিবির পক্ষে জানানো হয়েছে, আলোচনা সৌহার্দ্যপূর্ণ হয়েছে। মিয়ানমার পক্ষ নির্মাণাধীন ব্রিজের নিচ থেকে লোহার রড সরিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিজিবির কক্সবাজার ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক ও মিয়ানমারের ঢেঁকিবুনিয়ার বিজিপি ব্যাটালিয়ান অধিনায়ক স্ব স্ব দেশের পক্ষে পতাকা বৈঠকে নেতৃত্ব দেন। এদিকে, সরকারী নির্দেশ উপেক্ষা করে উখিয়া টেকনাফের ৩০ আশ্রয় শিবিরের বিভিন্ন ক্যাম্পে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের বাংলা ভাষা শেখাতে তৎপরতা চালাচ্ছে কিছু এনজিও। এদের সরবরাহ করা হয়েছে বাংলা পাঠ্য বই। রোহিঙ্গা শিশুদের হাতে বিতরণ করা হয়েছে সরকারী বিনামূল্যে দেয়া বাংলা বই। বিভিন্ন সূত্রে অভিযোগ করা হয়েছে, এদেরকে কিছু এনজিও ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বাংলা ভাষা শিখিয়ে এদেশের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এক করে ফেলতে তৎপর হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, যেহেতু ওরা মিয়ানমারের নাগরিক এবং ওদের নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে এসব শিশুদের তাদের দেশের ভাষা শেখানোর পরিবর্তে কেন বাংলা ভাষা শেখানো হচ্ছে। ভবিষ্যতে এদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হলে তখন এসব শিশুরা বর্মী ভাষার বিপরীতে যখন বাংলায় কথা বলবে তখন মিয়ানমার পক্ষ সহজভাবে দাবি তুলবে এরা বাংলাদেশের নাগরিক এবং বাঙালী। সূত্র জানায়, এমনিতেই রোহিঙ্গারা বর্মী ভাষা জানলেও বাংলা ভাষার সঙ্গে মিশ্রিত ভাষায় কথা বলে থাকে। সে ক্ষেত্রে রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা শিশুদের বাংলা ভাষা রপ্ত করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ার কোন কারণই থাকতে পারে। এছাড়া এ বিষয়ে শুরু থেকে সরকারী নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। কিন্তু তা কোনভাবেই মানা হচ্ছে না। অপরদিকে রোহিঙ্গাদের উখিয়া টেকনাফ থেকে হাতিয়ার ভাসানচরে স্থানান্তরের প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র দিন দিন জোরাল হচ্ছে। আশ্রয় শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ক্যাডাররা এতই তৎপর যে, কারও মুখ দিয়ে ভাসানচরে স্থানান্তরের আগ্রহ বা ইচ্ছা প্রকাশের কোন সুযোগ নেই। ইতোমধ্যে আশ্রয় ক্যাম্পে ৩৪ খুনের ঘটনা ঘটেছে। গত ২১ ফেব্রুয়ারি উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হয়েছে তিন জার্মান সাংবাদিক। ভাংচুর হয়েছে তাদের বহনকারী যানবাহনও। মূলত রোহিঙ্গারা এদেশে অবস্থানের সকল সুযোগ পেয়ে এর অপব্যবহারই করে যাচ্ছে। দিন দিন ওরা বেপরোয়া মনোভাবে তৎপর রয়েছে। এমনিতেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের একটি বড় অংশ ইয়াবা কারবারে জড়িয়ে পড়েছিল। সরকারের কঠোর মনোভাব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জোরাল অভিযানের কারণে বর্তমানে ইয়াবা চোরকারীদের তৎপরতা ইতিপূর্বেকার চেয়ে অনেকাংশে ভড়কে আছে। ফলশ্রুতিতে পূর্বের ন্যায় অবাধে ইয়াবা পাচার প্রক্রিয়ায় আগ্রহী রোহিঙ্গারা সহজে জড়াতে পারছে না। এতে তাদের বাড়তি আয়ের পথও রুদ্ধ হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে আশ্রয় শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া মনোভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। একথা সত্য যে, রোহিঙ্গাদের কিছু সদস্য ওপারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে এদেশে নানা অঘটনে লিপ্ত রয়েছে।
×