ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পেট্রাপোলে নয়া নির্দেশনা, বেনাপোল বন্দরে বাণিজ্যে স্থবিরতার আশঙ্কা

প্রকাশিত: ১০:২৫, ২০ এপ্রিল ২০১৯

 পেট্রাপোলে নয়া নির্দেশনা, বেনাপোল বন্দরে বাণিজ্যে স্থবিরতার আশঙ্কা

আবুল হোসেন, বেনাপোল থেকে ॥ ভারতের পেট্রাপোল বন্দরে আমদানি-রফতানি পণ্য চালান খালাস হওয়ার পূর্বে আনলোড করে শতভাগ পরীক্ষণের নির্দেশনা দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এতে পণ্য আমদানি-রফতানিকারী ব্যবসায়ীরা বিষয়টিকে ব্যবসার জন্য জটিল একটি প্রক্রিয়া হিসেবে দেখছেন। এমনকি বেনাপোল বন্দর দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন তারা। ব্যবসায়ীরা জানান, বিভিন্ন অব্যবস্থাপনায় এমনিতেই একটি পণ্য চালান ভারত থেকে আমদানি হতে পাঁচ থেকে শুরু করে অনেক ক্ষেত্রে ১৫ দিন পর্যন্ত সময় লেগে যায়। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া পেট্রাপোল বন্দরে এবার প্রতিটি পণ্য চালান শতভাগ পরীক্ষাতে এ ভোগান্তি আরও কয়েকগুণ বাড়বে। এতে পণ্য খালাস একদিকে যেমন কঠিন হয়ে পড়বে তেমনি আমদানি খরচও যাবে বেড়ে। যার প্রভাব পড়বে দেশীয় বাজারে। ব্যবসায়ীরা এই বন্দর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। তাই বিষয়টি নিয়ে এখনই পদক্ষেপ নেয়ার দাবি তাদের। বাংলাদেশের কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছে, অফিসিয়ালভাবে এখন পর্যন্ত তারা কোন চিঠি হাতে পায়নি। তারও বলেন, এ নিয়ম চালু হলে দ্রুত বাণিজ্য সম্পাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। জানা যায়, পেট্রাপোল বন্দর থেকে বেনাপোল বন্দরে প্রবেশের আগে সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ ছাড়া এর আগে ট্রাক থেকে পণ্য নামিয়ে পরীক্ষা করা হতো না। একই নিয়মে বেনাপোল বন্দর থেকে পণ্য রফতানি হতো ভারতে। কিন্তু হঠাৎ করে মঙ্গলবার (১৬ এপ্রিল) ভারতের পেট্রাপোল কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সেখানকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয়, আমদানি-রফতানি পণ্য চালান খালাসের আগে পেট্রাপোল বন্দরে শতভাগ পরীক্ষা করতে হবে। যার স্মারক নম্বর ১১(২৬)১১৩/পিটিপিএল-আরডি/আইএমপি/এমআইএসসি/২০১৮-১৯/২৭২৫। এতে এদিন ভারত থেকে বাংলাদেশের বন্দরে পণ্য চালানের সব ট্রাক আটকে যায়। পরে ব্যবসায়ীরা অনুরোধ করে কিছু পণ্য চালান বেনাপোল বন্দরে প্রবেশ করে। তবে নতুন নিয়মে পণ্য ঢুকতে না পারায় পেট্রাপোল বন্দরে পণ্য জটের সৃষ্টি হয়েছে। ব্যবসায়ীদের জানিয়ে দেয়া হয়, খুব দ্রুত এ সিদ্ধান্ত মেনে ব্যবসায়ীদের বাণিজ্য সম্পাদন করতে হবে। এতেই বাঁধে সব বিপত্তি। ভারতের পেট্রাপোল বন্দরের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, এ নিয়মে এ পথে বাণিজ্য সম্পাদন কঠিন হয়ে যাবে। বিশেষ করে পচনশীল পণ্য চালান রফতানি কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। আগে পাস করা হয়েছে এমন পণ্য চালান বন্দরে প্রবেশ করেছে। প্রতিবাদ জানিয়ে তারা নতুন করে পণ্য চালান এন্ট্রি বন্ধ রেখেছেন। বন্দর ব্যবহারকারীরা জানান, ভারতীয় পেট্রাপোল কাস্টমসের সহকারী কমিশনারের স্বাক্ষরিত ওই চিঠি পাওয়া মাত্রই বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার/সিএ্যান্ডএফ এ্যাসোসিয়েশনসহ বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি দফতরে অবহিত করেছেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে এখনই না বসলে এ বন্দর দিয়ে বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়বে বলেও জানান তারা। বেনাপোল আমদানি-রফতানি সমিতির সহসভাপতি আমিনুল হক জানান, এমনিতেই একটি পণ্য চালান ভারত থেকে আমদানি হতে ৫ থেকে শুরু করে অনেক ক্ষেত্রে ১৫ দিন পর্যন্ত সময় লেগে যায়। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া পেট্রাপোল বন্দরে পণ্যবাহী সকল ট্রাক শতভাগ পরীক্ষাতে এ ভোগান্তি আরও বাড়বে। এতে ব্যবসায়ীরা এ বন্দর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। মারাত্মকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাণিজ্যে। বেনাপোল কাস্টমস কার্গো শাখার রাজস্ব কর্মকর্তা আজিজুর রহমান জানান, এ বিষয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের অফিসিয়াল কোন চিঠি দেয়নি। তবে ব্যবসায়ী ও চালকদের কাছ থেকে বিষয়টি তিনি শুনেছেন। এ নিয়ম চালুতে দ্রুত বাণিজ্য সম্পাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে বলে মত প্রকাশ করেন তিনি। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে ২৩টি স্থলবন্দরের মধ্যে চলমান ১৩ বন্দরের অন্যতম বেনাপোল স্থলবন্দর। ১৯৭২ সাল থেকে এ পথে ভারতের সঙ্গে বেনাপোল বন্দরের বাণিজ্যিক যাত্রা। প্রতিবছর এ বন্দর দিয়ে ভারত থেকে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়ে থাকে। যা থেকে সরকারের প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজের কারণে প্রথম থেকে এ পথে বাণিজ্যে আগ্রহ বেশি ব্যবসায়ীদের। কিন্তু কয়েক বছর ধরে বন্দরে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রশাসনিক বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয়হীনতা আর ব্যবসায়িক হয়রানি ও ঘুষ দুর্নীতির কারণে সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে কাক্সিক্ষত রাজস্ব আসছে না এ বন্দর থেকে। জানা গেছে, গেল ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বেনাপোল বন্দরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৪ হাজার ১৯৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকার বিপরীতে আদায় হয়েছিল ৪ হাজার ১৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এ সময় ঘাটতি ছিল ১৭৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা। জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গত ৬ মাসের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে আদায় হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৪৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। ঘাটতি রয়েছে ৬০৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা। বন্দর সূত্রে জানা যায়, গত বছর (২০১৮) বেনাপোল বন্দরের সঙ্গে ভারতের পেট্রাপোল বন্দরের আমদানি-রফতানি কার্যক্রম বন্ধ ছিল ১৫২ দিন। এর মধ্যে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাস্টমসের সঙ্গে সীমান্তরক্ষী বিজিবির দ্বন্দ্ব, শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের আন্দোলন আর বন্দরে অগ্নিকা-ের ঘটনায় বাণিজ্য বন্ধ ছিল ২৬ দিন এবং সরকারী ছুটিতে বন্ধ ছিল ১২৬ দিন। তবে সাপ্তাহিক ছুটিতে শনিবার আমদানি-রফতানি সচল থাকলেও কাস্টমস ও বন্দরের অধিকাংশ কর্মকর্তারা অনুপস্থিত এবং বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো নগদ অর্থেও লেনদেন না করায় ব্যবসায়ীরা বন্দর থেকে চাহিদা মতো পণ্য খালাস নিতে পারেনি। নতুন করে এই ব্যবস্থা চালু করায় আরও রাজস্ব ঘাটতি হবে বলে ধারণা করছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি পেট্রাপোল বন্দরে আগের নিয়মেই চলুক। নতুন করে এমন হঠকারী নিয়ম যেন চালু না হয়।
×