ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

নুসরাত হত্যা মামলায় উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা আটক

প্রকাশিত: ১০:৫৬, ২০ এপ্রিল ২০১৯

  নুসরাত হত্যা মামলায় উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা আটক

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ফেনীর সোনাগাজী ইসলামীয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলায় সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিনকে আটক করেছে পিবিআই। এদিকে সেই মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটি বাতিল করা হয়েছে। অন্যদিকে সেই শম্পা ওরফে উম্মে সুলতানা পপি ফেনীর আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার জানান, শুক্রবার বিকেলে ফেনী থেকে রুহুল আমিনকে গ্রেফতারের পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পিবিআইর চট্টগ্রাম রেঞ্জের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) মোহাম্মদ ইকবাল জানান, বিকেলে নিজ এলাকা রুহুল আমিনকে আটক করা হয়। এর আগে একাধিক আসামির জবানবন্দীতে তার নাম এসেছে। তাই তাকে আটক করা হয়েছে। তিনি আমাদের হেফাজতে রয়েছেন। ফেনী পিবিআই’র অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামান বলেন, রুহুল আমিনকে তার নিজ এলাকা থেকে আটক করা হয়েছে। এর আগে মামলার অন্যতম দুই আসামি নুরুদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। এতে রুহুল আমিনের নাম উঠে আসে। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। শাহাদাত জবানবন্দীতে জানায়, নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়ার পর সে (শাহাদাত) দৌড়ে নিচে নেমে উত্তর দিকের প্রাচীর টপকে বের হয়ে যায়। এর মিনিট খানেকের মধ্যে নিরাপদ স্থানে গিয়ে রুহুল আমিনকে ফোনে নুসরাতকে আগুন দেয়ার বিষয়টি জানায় সে। তখন রুহুল আমিন বলেন, আমি জানি। তোমরা চলে যাও। ফেনীর নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, নুসরাত হত্যা মামলায় জড়িতদের সহযোগীদের নাম প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। যৌন নির্যাতনের হোতা ওই মাদ্রাসার সাবেক অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা নিজের অপকর্ম ঢাকার জন্য ওই মাদ্রাসার পরিচালনা পরিষদ সহ-সভাপতি হিসেবে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি রুহুল আমিনের অন্তর্ভুক্ত করেন। এরপরই একের একের পরম মাদ্রাসার অর্থ আত্মসাত ও নানা অপকর্ম চালিয়ে আসছিলেন সিরাজ। এরপর ছাত্রী যৌন হয়রানিসহ নানা অপকর্ম প্রকাশ্যে এলে ওই আওয়ামী লীগ নেতার কারণে ধামাচাপা পড়ে যায়। এ নিয়ে এলাকায় বিভিন্ন গুঞ্জন রয়েছে। এ মাদ্রসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা জামায়াতের রোকন থাকলেও রুহুল আমিনের হাত ধারে আওয়ামী ওলামা লীগের উপজেলা সভাপতি হয়েছেন। এই রুহুল আমিন ও এক ইউপি চেয়ারম্যান ছাত্রদলের নুরউদ্দিন, শিবিরের মোঃ শামিম, যোবায়ের, আবদুর রহিম শরিফকে ছাত্রলীগে যোগদান করিয়ে নিজের বাহুবল বৃদ্ধি করেন। এতে রুহুল আমিন ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হলেও স্থানীয় দলীয় ত্যাগী নেতাদের মাঝে ক্ষেভের সৃষ্টি হয়। কেউ মুখ খুলে কিছু বলতে সাহস করেনি। রুহল আমিন মাদ্রাসার অধ্যক্ষের মাধ্যমে নুর উদ্দিন, শরিফ ও আরিফকে মাদ্রাসার হেফজখানায় থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। এছাড়া মাদ্রাসার সামনের মার্কেটের দোতলায় এক ইউপি চেয়ারম্যানের অফিসে তাদের অবসর সময় কাটর জন্য আড্ডার আসর জমানোর ব্যবস্থা করে দেয় রহিম উল্লার ঘনিষ্ঠ এক ইউপি চেয়ারম্যান। এক সময় রুহুল আমিন জাতীয় পর্টির নেতা হিসেবে পরিচিত ছিল। পরে ’৯৬ সালে তৎকালীন উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ফয়জুল কবিরের হাত ধরে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করে। বর্তমানেও ফয়জুল কবির উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি থাকলেও রুহুল আমিন স্বঘোষিত সভাপতি হিসেবে সোনাগাজীতে প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনে ছড়ি ঘুরিয়ে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। সরেজমিন এলাকা ঘুরে জানা যায়, রুহুল আমিন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের থেকে বিএনপি ক্যাডারদের সঙ্গে তা ঘনিষ্ঠতা বেশি। নিজের দলে নেতাকর্মীকে মামলায় ফাঁসিয়ে বিএনপি জামায়াতের কর্মীদের সুযোগ দেয়া অভিযোগ রয়েছে। সোনাগাজী থানার ওসি মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন রুহুল আমিনের এ সব অপকর্মকে সহযোগিতা করে আসছিল। তারই ধারাবাহিকতায় নুসরাতের গায়ে আগুন দিয়ে হত্যার চেষ্টাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। ওসি মোয়াজ্জেম ও তার সহেযোগী স্থানীয় সুবিধাভোগী নামধারী সাংবাদিক। ওসি মোয়াজ্জেম নিজেকে আওয়ামী লীগ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হানিফের ভাগ্নে বলে পরিচয় দিয়ে আওয়ামী লীগসহ স্থানীয়ভাবে প্রভাব বিস্তার করে আসছিল। এদিকে শুক্রবার বিকেলে ফেনীর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শরফউদ্দিনের আদালতে পিবিআই ৫ দিনের রিমান্ড শেষে উম্মে সুলতানা পপি ওরফে শম্পা ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী জন্য হাজির করে। সে জবানবন্দীতে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা আদালতে স্বীকার করেছে। জবানবন্দী শেষে আদালত তাকে জেল হাজাতে পাঠানোর আদেশ দেন। এদিকে আলোচিত নুসরাত হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত ১৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলো অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ দৌলা, কাউন্সিলর ও পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম, শিক্ষক আবছার উদ্দিন, সহপাঠী আরিফুল ইসলাম, নূর হোসেন, কেফায়াত উল্লাহ জনি, মোহাম্মদ আলাউদ্দিন, শাহিদুল ইসলাম, অধ্যক্ষের ভাগ্নি উম্মে সুলতানা পপি, জাবেদ হোসেন, জোবায়ের হোসেন, নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, মো” শামীম, কামরুন নাহার মনি, জান্নাতুল আফরোজ মনি, শরীফ, হাফেজ আবদুল কাদের ও আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন। সেই মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটি বাতিল ॥ নুসরাত জাহান রাফির নির্মম হত্যাকাণ্ডে মাদ্রাসা কমিটির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠায় সোনাগাজী ইসলামীয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা ১৩ সদস্যবিশিষ্ট পরিচালনা কমিটি বাতিল (বিলুপ্ত) ঘোষণা করেছে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাকা)। মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোঃ হোসাইন আহমদ জানান, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. আহছান উল্লাাহ কমিটি বাতিলের (বিলুপ্তির) বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, আগামী ২/১ দিনের মধ্যে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট এডহক কমিটি গঠন করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলে জানান, ২৭ মার্চ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা নুসরাতকে যৌন হয়রানি করার মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর ৬ এপ্রিল সেই হত্যার ঘটনায় মাদ্রাসা কমিটির সহ-সভাপতি উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি রুহুল আমিনসহ অন্যদের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ উঠে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও পুলিশ সদর দফতরের প্রাথমিক তদন্তে তা প্রমাণিতও হয়। বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের মানববন্ধন ॥ নারী নির্যাতন বন্ধ এবং নিরাপদে চলাফেরা নিশ্চিতের দাবিতে রাস্তায় নেমে মানববন্ধন করেছে পুরান ঢাকার কিশোরীরা। শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে নুসরাত হত্যাকারীদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন করেছে কয়েকটি সংগঠন। সেখানে অংশ নেয় পুরান ঢাকার কিছু কিশোরী শিক্ষার্থী। নুসরাত হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চেয়ে মানববন্ধনে অংশ নেয় শ্রমজীবী নারী মৈত্রী। সংগঠনের সভাপতি বহ্নিশিখা জামালী বলেন, ধর্ষক ও নারী নির্যাতনকারীর আশ্রয়দাতাকে শাস্তি দিতে হবে যেন কোনভাবেই এর সঙ্গে জড়িত কেউ আইনের বাইরে না থাকতে পারে। নারী নিপীড়ত ও ধর্ষকের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। অপরদিকে নুসরাত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আসামিদের দ্রুত বিচারের দাবিতে ফেনীতে বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিবাদ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। শুক্রবার সকালে ছাগলনাইয়া বাজারের জিরো পয়েন্টে ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলা ছাত্রলীগ (জাসদ) মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করে। এদিকে নুসরাত জাহান রাফিকে কেরোসিন ঢেলে হত্যার ঘটনায় মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা ও তার সহযোগীদের শীঘ্রই বিচারের আওতায় এনে শাস্তির দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ জার্নালিস্ট ফোরাম (বিজেএফ)। শুক্রবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এ কর্মসূচীতে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তারা। সংগঠনের সভাপতি শাহিদুল ইসলাম শাহিদের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক জাফরুল আলমের সঞ্চালনায় মানববন্ধন কর্মসূচীতে আরও উপস্থিত ছিলেন রেজাউল হক, মনসুর আহমেদ, গোলাম কিবরিয়া, টুটুল, সাঈদ, সবুজ, রুবেল ও খন্দকার হাফিজুর রহমান বিপ্লব প্রমুখ।
×