ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা সেলিম

আমাদের মেধাসম্পদের নিরাপত্তা শিক্ষা- কেন জরুরী?

প্রকাশিত: ০৮:৫০, ২১ এপ্রিল ২০১৯

আমাদের মেধাসম্পদের নিরাপত্তা শিক্ষা- কেন জরুরী?

২৬ এপ্রিল বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস। ২০০০ সাল থেকে জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থা বা ‘ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশন’ যা WIPO নামে সুপরিচিত তাদের উদ্যোগে দেশে দেশে এই দিবসটি বিশেষ তাৎপর্যের সঙ্গে পালিত হয়ে থাকে। প্রতি বছর এই দিবসের একটি প্রতিপাদ্য থাকে, এ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে Reach for Gold : IP and Sports। বাংলায় এই বক্তব্যের অফিসিয়াল কোন অনুবাদ করা না হলেও খুব সহজেই বোঝা যায় এর মূল বক্তব্য হলো মেধাসম্পদ ও স্পোর্টস (ক্রীড়া)। ওয়াইপোর ঘোষণায় বলা হয়েছে ক্রীড়া জগতের সর্বস্তরে যে কারিগরি কৌশলের ব্যবহার হয় তার ভেতরের সৃজনশীল সম্পদেরও একটি মর্যাদা আছে যা নিশ্চিত থাকা দরকার। দেশগুলো ও যারা এই জগতের সুবিশাল অর্থনৈতিক ও কারিগরি সম্পদ সৃজন এবং উদ্ভাবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের জন্য এখন একটি নতুন বিবেচনা সর্বস্তরের প্রয়োগে থাকা চাই। বাংলাদেশ খেলাধুলায় বিশেষ করে ক্রিকেট যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দিয়েছে তার অর্থনৈতিক মূল্য অপরিসীম যা কিছুদিন আগেও আমরা ভাবতে পারিনি। এর সঙ্গে রয়েছে আমাদের ক্রিকেটারদের সৃজনশীল ক্রীড়া নৈপুণ্য। সকল নৈপুণ্য আর্থিক বিবেচনা দিয়ে বাধা যায় না কিন্তু মেধার যে স্বীকৃতি তা সকল সৃজনশীল মানুষের প্রাপ্য। একটু চিন্তা করে দেখলেই আমরা বুঝতে পারব যখন ক্রিকেটারদের প্রশিক্ষণের জন্য একজন কোচ নেয়া হয় সেই কোচ কিন্তু তার অধীত জ্ঞানেরই সর্বোচ্চ প্রয়োগ করেন, যা অনুশীলনে চর্চা হয়। তাহলে আমাদের বোঝা দরকার আমরা কি সেই কোচের সময়ের পারিশ্রমিক-ই দেই নাকি তার সৃজনশীল কৌশলের জন্যও দেই? নিশ্চয়ই এর উত্তর হবে উভয়ই। তাহলে আমরা স্বীকার করে নিচ্ছি ওই কোচের অভিজ্ঞতা ও সময়ের মূল্য ছাড়াও তার কুশলী নৈপুণ্যের জন্য তিনি তার যে মেধাসম্পদ প্রয়োগ করছেন আমরা তার স্বীকৃতি দিচ্ছি। এই স্বীকৃতি সাময়িক আর্থিক বিষয়ের বাইরেও আর একটি অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বহন করে তা হলো দুনিয়ার সকল সৃজনশীল কর্মকা- প্রকৃতপক্ষে মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশমান উন্নয়নের অংশ যেখানে মেধা সম্পদের স্বীকৃতি থাকা একটি অনিবার্য অনুষঙ্গ। একবার চিন্তা করে দেখুন স্টেডিয়াম থেকে শুরু করে সারা দুনিয়ার মানুষের বাড়ি বাড়ি টেলিভিশনের পর্দা পর্যন্ত শুধু ক্রীড়া জগতের কী পরিমাণ অর্থনৈতিক আয়োজন থাকে কিন্তু মানুষ বা দর্শক সবচেয়ে আকৃষ্ট হয় খেলোয়াড়দের সৃজনশীল ক্রীড়া নৈপুণ্যে। খেলা শেষেও দীর্ঘদিন এমনকি বহু বছর পরেও অনেক খেলা ও খেলোয়াড়দের নৈপুণ্য নিয়ে আলোচনা অব্যাহত থাকে। এ থেকে বুঝা যায় মানুষের প্রধান আরাধ্য হলো সৃজিত সম্পদ, আর সেই সম্পদের স্বীকৃতি কেমন করে আমরা দেব বাংলাদেশের জন্য তা এখন খুবই প্রাসঙ্গিক কারণ আমরা যে ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরি করেছি সেখানে আমাদের সকল ক্ষেত্রের মেধাসম্পদের নিশ্চিত শিক্ষা আয়ত্তে রাখতে হবে। বিশ্ব মেধাসম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা বিধানের আর একটি জরুরী বিষয় হলো সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন। ঊষালগ্ন থেকে মানব সভ্যতা তার নিজস্ব ভৌগোলিক বলয়ে ক্রমান্বয়ে যে সংস্কৃতির অব্যাহত বিকাশ করেছে তারও একটি নির্ধারিত নির্দেশক আছে, যা ওই ভৌগোলিক মেধাসম্পদের অন্যতম ঐতিহ্য। দেশে দেশে এখন সেসব নিয়ে ভাবনা হচ্ছে বিশেষ করে জাতীয়তাবোধ মানুষকে এই বিষয়ে এখন অনেক বেশি সতর্ক করেছে। জাতিতে জাতিতে স্বকীয়তাবোধ পাশাপাশি বিশ্ব বাণিজ্য স্বার্থের কোটারি এখন মেধাসম্পদের মর্যাদার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশকে এখন এইসব বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে ও সেমতে কাজও করতে হবে। সম্প্রতি বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ডওচঙ প্রধান (মহাপরিচালক) ফ্রান্সিস গুরির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেছেন। সে বৈঠকে বাংলাদেশে একটি ‘মেধা সম্পদ একাডেমি’ প্রতিষ্ঠায় উভয় পক্ষ একমত হয়েছেন। ২০১০ সালে ফ্রান্সিস গুরি বাংলাদেশ সফর করেছিলেন তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশে এই রকম একটি শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের আগ্রহ প্রকাশ করে ডওচঙ-র সহায়তা চান। ন’বছর পরে হলেও বর্তমান মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের প্রস্তাবে কাজটি আগাচ্ছে বলে আশা করা হচ্ছে। এই উদ্যোগ ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য খুবই জরুরী। এরকম একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে স্থাপিত হলে অন্তত বাংলাদেশ তার জ্ঞান সমাজে মেধা সম্পদ স্বীকৃতি ও চর্চার পরিবেশ নিশ্চিত রাখতে সমর্থ হবে। বাংলাদেশের মতো কৃষি সমাজ ব্যবস্থায় মেধাসম্পদের চর্চা ও নিরাপত্তার সবচেয়ে জরুরী বিষয় হলো জনসংখ্যার ক্রমবৃদ্ধি মেনে নিয়ে কেমন করে তাকে শ্রমশক্তির কাজে নিয়োজিত করা যাবে তা নিয়ে সৃজনশীল কাজের ভাবনায় গবেষণা করা। আমাদের কৃষিখাতে এখন যে প্রভূত উন্নতি হয়েছে তা শুধু কায়িক শ্রমের জন্য নয়, লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিজ্ঞানসম্মত উন্নয়ন কৌশলের ভূমিকাও এখানে কম নয়। এসবে দেখতে হবে আমাদের উদ্ভাবন কিসে! যদি কেউ গবেষণা করে দেখে কুমিল্লা সমবায়ের ভূমিকা আমাদের কৃষিকাজে কি কি প্রভাব ফেলেছে, নিশ্চিত জানা যাবে উৎপাদন বাড়াতে বিজ্ঞানসম্মত প্রচেষ্টার অবদান কি কি? কৃষি উন্নয়নে ‘কুমিল্লা সমবায় পদ্ধতি’ যা ‘কুমিল্লা এপ্রোচ’ নামে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত, আমরা খুব কমই সে খবর রাখি। আমাদের এসব উন্নয়ন সৃজনশীল কাজের স্বীকৃতি বাংলাদেশের কৃষি ইতিহাস অধ্যয়নের জন্য কম জরুরী নয়। মেধা সম্পদকে অনেকে কম্পিউটার বা তথ্য-প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট কাজের মধ্যে আটকে ফেলেন, এটা সীমাবদ্ধ চিন্তা, তবে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কৃষি ও শিল্প যুগের ক্রম-রূপান্তরের ফলে পৃথিবী এখন জ্ঞান সমাজে প্রবেশ করেছে। এই মুহূর্তে আমরা যে সমাজে আছি তাকে একটি ‘সর্বময়ী তথ্য সমাজ’ (ইনক্লুসিভ ইনফরমেশন সোসাইটি) বলছি। এখানে আসা ও এখান থেকে এগিয়ে যেতে সবচেয়ে বড় শক্তি তথ্য-প্রযুক্তি যা কিনা আগামী অর্ধ শতকে একটি নতুন বিপ্লবের জন্ম দিতে যাচ্ছে (যাকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বলে অভিহিত করা হচ্ছে)। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন সেই বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে কিন্তু যে কাজগুলো তার পূর্বশর্ত হবে সেগুলোর অন্যতম নিজের স্বকীয়তাকে সমুন্নত রাখা। আর তাই আমাদেরও বুঝতে হবে তা কেমন করে হবে বা কোন কোন ক্ষেত্রে সেগুলো সুবিন্যস্ত করে নেবার সুযোগ আমাদের কাছে আছে। আইপি শিক্ষা বা মেধাসম্পদ নিরাপত্তার অনুচর্চায় আমাদের আগ্রাধিকার দিতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা ও প্রশিক্ষণে। শিক্ষিত সমাজে এখন সব মানুষই জ্ঞান কর্মীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে যাচ্ছে। বিশ্বায়নের এ যুগে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে আমাদের অফিসারদের জানা দরকার কোন কোন ক্ষেত্রে আমাদের মেধা অপচয় ও অবচয় হয় সেই সেই ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো চালিত হতে হবে যেন আমরা মেধার অবমূল্যায়ন ঠেকাতে পারি। আমাদের শিক্ষকবর্গের কাছে থাকতে হবে উদ্ভাবনের সব কৌশলের অনুচিন্তা যেন সে সবের বাধাগুলো শিক্ষার্থীরা অতিক্রম করতে ঠিকমতো নির্দেশনা পায়। আমাদের গবেষণাগুলো হতে হবে প্রায়োগিক, তা না হলে কাগুজে ফলাফল সমাজের কোন কাজে আর আসবে না। কারণ সে স্তর আমরা অতিক্রম করেই এই পর্যন্ত এসেছি। আর সৃজনশীল সংস্কৃতিকর্মীর কাজ হবে সমাজের সকল স্তরে মানুষের কাছে মেধার সম্মান পৌঁছে দেয়া তা গান দিয়ে হোক আর কবিতা-উপন্যাস দিয়ে হোক, হোক কোন উন্নয়ন পরামর্শ দিয়ে। বুদ্ধির সমাজ নিশ্চিত করতে আমাদের সংবাদমাধ্যমগুলো হবে সত্য প্রকাশের প্রচারপত্র। ভয়ের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে আমরা নিশ্চয়ই তখন একটি মেধার নিরাপদ সমাজ গড়ে তুলতে পারব। এবারের ২৬ এপ্রিল বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবসের প্রতিপাদ্য যাই-ই হোক আমরা নিজেদের জন্য নানারকম প্রতিজ্ঞা করে নিয়ে এগুতে পারি। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্য-প্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×