ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রমজানে স্বল্প পরিসরে ও ঈদের পর কোমর বেঁধে মাঠে নামছেন কেন্দ্রীয় নেতারা ;###;অপকর্মে জড়িতদের হটিয়ে জনপ্রিয়দের মূল নেতৃত্বে আনার সিদ্ধান্ত

সামনে শুদ্ধি অভিযান ॥ আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ

প্রকাশিত: ১০:৪৪, ২১ এপ্রিল ২০১৯

সামনে শুদ্ধি অভিযান ॥ আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ

উত্তম চক্রবর্তী ॥ মধুচন্দ্রিমা কাটিয়ে দলে বড় ধরনের শুদ্ধি অভিযানে নামছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। আট বিভাগে আটটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় টিম সারাদেশে সাংগঠনিক সফরের মাধ্যমে তৃণমূল থেকে দলকে ঢেলে সাজার পাশাপাশি এই শুদ্ধি অভিযান চালাবেন। বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে মাঝি হয়েও নৌকা ডোবানোর সঙ্গে জড়িত মন্ত্রী-এমপি-বড় বড় নেতাও রেহাই পাবেন না এই শুদ্ধি অভিযানে। একইসঙ্গে ক্ষমতার মধু খেতে দলে অনুপ্রবেশকারী হাইব্রিড, বহিরাগত এবং দখল-চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িত নেতাদের চিহ্নিত করে সংগঠন পুনর্গঠনের সময় তাদের হটিয়ে জনপ্রিয় নেতাদের সংগঠনের মূল নেতৃত্বে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। আগামী অক্টোবরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় জাতীয় সম্মেলনের আগ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে সারাদেশে দলকে চাঙ্গা ও শক্তিশালী করে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েই মাঠে নামছে ক্ষমতাসীন দলটি। শুধু তৃণমূলই নয়, দীর্ঘদিন সম্মেলন না হওয়া মেয়াদোত্তীর্ণ দলের সহযোগী সংগঠনগুলোকেও দ্রুত সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। আগামী ২৪ এপ্রিল থেকে শুরু হচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশন। এ কারণে আগামী রমজান মাসে স্বল্প পরিসরে এবং ঈদের পর কোমড় বেঁধে সারাদেশে এই শুদ্ধি অভিযানে নামবেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। ইউনিয়ন থেকে শুরু করে উপজেলা, থানা, জেলা ও মহানগরে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলো সম্মেলনের মাধ্যমে ঢেলে সাজানো এবং বিতর্কিত নেতাদের দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে হটিয়ে জনপ্রিয় নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে এনে সারাদেশেই দলকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলবেন আট বিভাগের জন্য গঠিত আটটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক টিম। কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগ পর্যন্ত এই শুদ্ধি অভিযান ধারাবাহিকভাবে চালানোর সিদ্ধান্ত রয়েছে কেন্দ্রীয় হাইকমান্ডের। আর এসব টিমে প্রত্যেক সংসদ সদস্যের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ জনকণ্ঠকে বলেন, সাংগঠনিক সফরের মাধ্যমে সারাদেশে দলকে শক্তিশালী ও ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি শুদ্ধি অভিযান চালানো হবে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার সুযোগে যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতসহ অন্য কোন দলের বিতর্কিত নেতারা কোথায় কোথায় অনুপ্রবেশ করেছে, তা চিহ্নিত করা হচ্ছে। অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা যাচাই-বাছাই করার জন্য দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। যাচাই-বাছাই শেষে অনুপ্রবেশকারীদের দল থেকে বের করে দেয়া হবে এবং দলের যেসব নেতা এসব বিতর্কিতদের দলে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধেও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে যারা দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন, দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করেছেন তাদের বিষয়েও যাচাই-বাছাই চলছে। যদি সত্যিই কেউ অভিযুক্ত হন, তবে তাঁকেও দল থেকে কেন বহিষ্কার করা হবে না এ বিষয়ে কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়া হবে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থমকে গেছে রাজনীতি। রাজনৈতিক ময়দান এখন রাজনীতিশূন্য। রাজনীতির মাঠে প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি চরমভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের মধুচন্দ্রিমা যেন কাটছেই না। নির্বাচনের পর থেকে গত চার মাস রাজনীতির মাঠে দলটির কোন সাংগঠনিক তৎপরতা নেই। শুধুমাত্র দিবসভিত্তিক কর্মসূচী ও ঘরোয়া সভা-সমাবেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকা-। থমকে রয়েছে সাংগঠনিক কর্মকা-ও। সারাদেশেই মানুষের মধ্যে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পেলেও মাঠে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ না থাকায় দেশের অধিকাংশ স্থানেই আওয়ামী লীগের মুখোমুখি এখন আওয়ামী লীগই। প্রায় প্রতিটি সাংগঠনিক জেলা শহরেই দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল-দ্বন্দ্ব সময়ের ব্যবধানে যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। সবশেষ অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে দলের মধ্যে চরম বিভেদ স্পষ্ট হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক সৈনিক দাবি করলেও স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক নৌকাকে ডুবাতেও কুণ্ঠাবোধ করছেন না ক্ষমতার মোহে অন্ধ নেতাকর্মীরা। এ পর্যন্ত ৪১৮ উপজেলার মধ্যে দেড় শতাধিকেরও বেশি উপজেলাতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তথা নৌকাকে ডুবিয়েছেন নৌকার মাঝিরাই (বিদ্রোহী)। অনেক স্থানেই নৌকাকে ডুবাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন অনেক ডাকসাইটে নেতা-মন্ত্রী-এমপিরাও। কেন্দ্র থেকে যাচাই-বাছাই করে উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একক প্রার্থী ঘোষণা করে তাদের হাতে নৌকা প্রতীক তুলে দিলেও কেন্দ্রের সেই নির্দেশ অমান্য করতেও ন্যূনতম কুণ্ঠবোধ করেননি তৃণমূলে দলের বড় বড় পদে থাকা নেতারাও। বহিষ্কারের হুমকি-ধামকি দেয়া হলেও কার্যত কেন্দ্র থেকে কঠোর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় নৌকার বিরোধিতা করে নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়া আওয়ামী লীগের যেন এখন একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। অনেক কেন্দ্রীয় নেতা ও মন্ত্রী-এমপিকেও কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত অমান্য করে শুধুমাত্র নিজেদের পারিবারিক কিংবা গোষ্ঠী বলয় ধরে রাখতে প্রকাশ্যে বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষ নিয়ে নৌকা ডুবাতে মাঠে নামতেও দেখা গেছে। তবে সবশেষ আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন দলের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে কয়েকজন সিনিয়র কেন্দ্রীয় নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে দলের নির্দেশ অমান্যকারী নেতাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান প্রধানমন্ত্রীর কাছে। জবাবে প্রধানমন্ত্রী দলের সিদ্ধান্ত অমান্যকারী মন্ত্রী-এমপি- নেতাদের চিহ্নিত করে একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করার জন্য বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের নির্দেশ দেন এবং দলের সিদ্ধান্ত অমান্যকারীদের কারণ দর্শানোর নোটিস প্রদানের বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোন বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায়নি। এছাড়া দীর্ঘদিন ক্ষমতার সুযোগে দলের মধ্যে অনুপ্রবেশকারী এবং হাইব্রিড নেতাদের কর্মকা-ে প্রায়শই আওয়ামী লীগকে বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে। দেশব্যাপী আলোচিত ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকে যৌন নিপীড়ন ও আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার মূল হোতা জামায়াত নেতা অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার সঙ্গে আওয়ামী লীগের স্থানীয় কয়েকজন নেতার জড়িত থাকার ঘটনায় বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় ক্ষমতাসীন দলটিকে। টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসায় সারাদেশেই বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন দল থেকে অসংখ্য সুবিধাভোগী আওয়ামী লীগে ভিড়ে নানা অপকর্ম চালাচ্ছে। গত চার মাসে সাংগঠনিক কর্মকা- নিষ্ক্রিয় থাকলেও ফেনীর ঘটনার পর নড়ে চড়ে বসেছে আওয়ামী লীগের হাইকমা-। অনুপ্রবেশকারী ও হাইব্রিডদের বিষয়ে বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে খোঁজ নেয়া শুরু করেছেন তারা। জানা গেছে, দেশব্যাপী শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে এদের দল থেকে বের করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হবে। টানা প্রায় সাড়ে দশ বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে সারাদেশে দলের মধ্যে সৃষ্ট এসব বিভেদ, দ্বন্দ্ব ও বিশৃঙ্খলা দূর করতেই তৃণমূল থেকে দলকে ঢেলে সাজানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। গত শুক্রবার দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদের যৌথ সভাতেও এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারাদেশে দলকে ঢেলে সাজানোর নির্দেশ প্রদানের পাশাপাশি বেশকিছু পরিকল্পনা ও নির্দেশনাও দিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতাদের। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে আওয়ামী লীগকে নতুন করে ঢেলে সাজানো হবে। বিভাগীয় পর্যায়ে যে আটটি টিম গঠন করা হয়েছে, সেসব টিমের সাংগঠনিক সফরের তারিখ সংসদের ™ি^তীয় অধিবেশনের পর নির্ধারণ করা হবে। কেননা সামনে সংসদ অধিবেশন থাকায় সংসদ সদস্যরা এলাকায় থাকতে পারবেন না। তাই সংসদ সদস্যদের উপস্থিতিতে সাংগঠনিক সফরের লক্ষ্যে দিন তারিখ ঠিক করে আটটি সাংগঠনিক টিম সফর করবে। বৈঠকে কেন্দ্রীয় নেতাদের উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ কোন বিপর্যয়ে পড়লে তৃণমূলই দলকে রক্ষা করে। এ কারণে তৃণমূলকে সবসময় সংগঠিত রাখতে হবে। সাংগঠনিক সফরকালে তৃণমূলে দলকে শক্তিশালী করতে উদ্যোগ নিতে হবে। কোথায় দলের সাংগঠনিক অবস্থা কী- সে বিষয়ে খোঁজ নিতে হবে। যেসব জায়গায় কমিটি নেই বা কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে, সেসব জায়গায় সম্মেলন করে নতুন কমিটি গঠন করতে হবে। আওয়ামী লীগের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, শুধু তৃণমূলেই নয়, দলের সহযোগী ও ভাতৃপ্রতীম সংগঠনগুলোকেও আগামী জাতীয় সম্মেলনের আগে ঢেলে সাজানো হবে। সম্প্রতি ছাত্রলীগের কিছু কর্মকা-েও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দীর্ঘদিন হয়ে গেলেও ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে দ্রুত তা সম্পন্ন করতে কেন্দ্রীয় পাঁচ প্রভাবশালী নেতাকে দায়িত্ব দিয়েছেন তিনি। এছাড়া গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোর মেয়াদ দুই বছর হলেও চার বছরেও নতুন কমিটি পায়নি ক্ষমতাসীন দলটির চার সহযোগী ও ভাতৃপ্রতীম সংগঠন। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি নিয়ে চলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ, আওয়ামী যুবলীগ, কৃষক লীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগের নেতাকর্মীরা আগামী অক্টোবরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগেই নতুন কমিটি পাওয়ার আশা করছে। জানা গেছে, তৃণমূলে সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগের পাশাপাশি মেয়াদোত্তীর্ণ এসব সহযোগী সংগঠনও সম্মেলনের মাধ্যমে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা রয়েছে আওয়ামী লীগের। আগামী ঈদের পর পরই সম্মেলনের মাধ্যমে এসব সংগঠনে নতুন নেতৃত্ব আনা হবে বলেও দলটির একাধিক সূত্র জানিয়েছেন।
×