ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

আসুন, সন্ত্রাসবাদ আর উগ্রবাদকে ‘না’ বলি!

প্রকাশিত: ০৯:২২, ২৫ এপ্রিল ২০১৯

আসুন, সন্ত্রাসবাদ আর উগ্রবাদকে ‘না’ বলি!

‘শ্রীলঙ্কার আকাশে মেঘ, অথচ আমার চাতালে বর্ষণ’- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলর সম্প্রতি অনুষ্ঠিত শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনের অন্যতম প্রার্থী অধ্যাপক হারিসুল হকের নির্বাচনী টেক্সটের অংশবিশেষ এটি। কার্ডিওলজির অধ্যাপক হিসেবে ভদ্রলোক কর্মরত আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে কার্ডিওলজি না কাব্য কোথায় তার বিচরণ বেশি সাবলীল তা নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে। প্রযুক্তির এই চরম উৎকর্ষের সময়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা যখন বানাচ্ছে বাংলায় কথা বলা রোবট, তখন কবি অধ্যাপক হারিসের মুঠোফোনের বার্তাটি একটু ত্বারিত করে। আমাদের হাতের মুঠোয় এখন গোটা বিশ্ব। জিপিএস আমাদের চেনাচ্ছে শহরের সদ্য জনপ্রিয় ওঠা লাউঞ্জটা কোথায়। সিঙ্গাপুর যাবেন? আগামী ৩-৪টা দিন ওখানে আবহাওয়া কেমন থাকবে, রোদ হবে না বৃষ্টি, তার উত্তর আছে মোবাইল এ্যাপসেই। কক্সবাজার গিয়ে এখন আর জোয়ার-ভাটার খোঁজে চুল ছিঁড়তে হয় না। সব তথ্য নিয়ে হাজির গুগল সব সময়। কম্পিউটারের কী-বোর্ড আর মাউসের ক্লিকে এখন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে পান্তা থেকে পাস্তা আর ফোন থেকে ফুল। দেশে দেশে যে রাজনৈতিক সীমান্ত তা এখন অনেকটাই অকার্যকর। আজকের ভার্চুয়াল পৃথিবীতে কোথাও হারিয়ে যেতেই আমাদের নেই কোন মানা। কাজেই শ্রীলঙ্কার বৃষ্টি আমার চাতালে পড়তেই পারে। দোষের কি তাতে? সমস্যাটা অন্যখানে। অধ্যাপক হারিসের সংশয়ের জায়গাটাও এখানেই। গত চার দশকে বেশি সময় ধরে যে ফেনোমেননটি একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৈশ্বিক হয়ে উঠেছে তা হলো জঙ্গীবাদ আর সন্ত্রাসবাদ। এটি কখনও অভ্যন্তরীণ, কখনও উপ-আঞ্চলিক বা আঞ্চলিক আবার কখনও বা আন্তর্জাতিক। প্যারিসের রাজপথে যখন কোন উগ্র মৌলবাদী নিরপরাধ পথচারীদের গাড়িচাপা দিয়ে গাজায় শিশু হত্যার প্রতিশোধ নিতে চায়, তখন তার প্রতিধ্বনি আমরা শুনতে পাই ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে। একইভাবে শ্রীলঙ্কার গির্জায় উৎসব যখন রক্তে লাল তখন রাশিয়ার বার্তা সংস্থা তাস জানাচ্ছে এটি ক্রাইস্টচার্চেরই পাল্টা জবাব মাত্র। অথচ কোটি বাঙালীও তখন কাতর নিষ্পাপ শিশু জায়ানের শোকে। কে কাকে মারছে, কেন মারছে আর কবে আবার মারবে- তা না জানে যে মরছে, না জানে যে মারছে। শান্তিপ্রিয় জাপানীরা কেন জবাই হলেন ত্রাণ দিতে গিয়ে সিরিয়ায় কিংবা মেট্রোরেল বানাতে যেয়ে এই ঢাকায় হলি আর্টিজানে সেই প্রশ্নের উত্তর কে জানে কোথায়। আমাদের শাস্ত্রে আছে কারণ জেনে রোগের চিকিৎসা করতে হবে। আজকের বৈশ্বিক ভিলেজের মহামারী জঙ্গীবাদ আর সন্ত্রাসবাদ। এর কারণেই ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরছে নিরীহ লিবীয় আর এদিকে বঙ্গোপসাগরে ডুবছে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা। এদের প্রত্যাশা ছিল সামান্যই, নিরাপদে আরেকটু ভালভাবে বেঁচে থাকার প্রত্যাশা, যা প্রতিটি মানব সন্তানের মৌলিক অধিকার। অথচ এই অধিকারটুকুই আজকের বৈশ্বিক ভিলেজে কি নির্মমভাবেই না লঙ্ঘিত, কখনও উগ্র মৌলবাদের থাবায়, আবার কখনও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। ধূলায় যখন লুটায় মানবতা, তখন আমরা তর্কে মাতি ‘মুরগি আগে না ডিম।’ আগে ক্রাইস্টচার্চ না আগে প্যারিস। কেউ বলবেন আগে আইএস তো কেউ আগে টানবেন ফিলিস্তিনের উদাহরণ। কেউ কেউ আবার খুঁড়ে বের করবেন ক্রুসেডের ইতিহাসও। খুঁড়তেই পারেন। কেউ যখন বলবে বাবরি মসজিদ নেই কেন তখন অন্য বলবে ‘আরে ওটা তো রামের জন্মস্থান। মসজিদটা আসল কোত্থেকে?’ আমি যখন বলব বাগদাদের লাইব্রেরিতে কত হাজার কোরান শরীফ পুড়িয়ে দিয়ে ভাল করেনি নাদির শাহ, তখন অন্য কেউ হয়ত বলবেন তার চেয়ে বেশি বৈ কম নয় কোরান শরীফে তো আগুন দেয়া হয়েছে ক’দিন আগে এই ঢাকার বুকে বায়তুল মোকাররমের আশপাশে। চলবে আলোচনা আর যুক্তি, চলতেই থাকবে। ঝড় উঠবে চায়ের কাপে, এক সময় জুড়িয়েও যাবে চা। কিন্তু থামবে না আলোচনা, মিলবে না কারণ। কারণ, কারণটা খুবই সাধারণ। কোন সন্ত্রাসবাদী, উগ্র মৌলবাদী কিংবা গণদুশমন সরকার- কাউকে দায় দিয়েই দায়মুক্তির সুযোগ নেই। এই দায়ভার আপনার আমার সবার। এই দায়ভার যেমন মুসলমানের, তেমনি এর ষোলোআনা দায়ভার সনাতনের, খ্রীস্টানের আর বৌদ্ধেরও। কারও হাতই আর সাদা নেই, সবারটাই লাল। চাঁদে যখন রাজাকারের ছবির গুজব শুনে আমি-আপনি রাস্তায় নামি তখন তার পরিণতিতে যে চল্লিশজন মানুষ প্রাণ হারায়, তার দায়ভার কোন মৌলবাদই নয়। ওরা সুযোগ নেবেই যখন ওরা ক্রাইস্টচার্চে বা কলম্বোয় কিংবা খোদ এই ঢাকার বুকে কাউকে আত্মঘাতী হতে প্ররোচিত করতে পারবে সাত-সাগরের ওপারে কোন ঘটনার জের ধরে। কানাডায় বেড়ে ওঠা কিংবা ব্রিটেনে জন্ম নেয়া এদেশীয় বংশোদ্ভূত কোন তরুণ বা তরুণী যখন সারা দেয় সিরিয়ায় কালো পতাকার অন্ধকারের আহ্বানে তখনই ইয়েমেনে ঝড়ে রক্ত আর জায়ানের শোকে কাতর হতে হয় আমাদের। এর সমাধানও তাই আমাদের কাছেই। এর সমাধান আমার হাতে, আপনার ঘরে আর আমাদের প্রতিবেশীর বেডরুমে। আমি আর আপনি তো জন্মেছিলাম ‘মানুষ’ হিসেবে, ‘হিন্দু, সনাতন, খ্রীস্টান কিংবা বৌদ্ধ’ হিসেবে না। তা হলে কেন ধর্মের ব্যবসায়ী ধর্মের দোহাই দিয়ে আমার-আপনার মগজে চালান দিতে পারে উগ্রবাদের পোকা। কেন আমাদের মনে থাকে না শত শত বছর আগে এই ভূ-খ-েই চ-ীদাস বলেছিলেন ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই?’ কেন আজকে বাউল আব্দুল করিমকে গাইতে হয় ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’? এই বৈশ্বিক ভিলেজকে যদি আপনার আমার সুকন্যা-সূর্যদের জন্য বসবাসযোগ্য রেখে যেতে চান, যদি চান তারা কলম্বোয় বেড়িয়ে নিরাপদে ফিরবে ঢাকায়, তাদের কেউ সিরিয়ায় কালো পতাকার আহ্বানে সাড়া দেবে না, তা হলে উপায় কিন্তু এই একটাই। আসুন, চ-ীদাসে বিশ্বাস করি আর আপ্তবাক্য হিসেবে অন্তরে ধারণ করি বঙ্গবন্ধুর সেই অমর বাণী, ‘আমি প্রথমে মানুষ, তারপর বাঙালী, তারপর মুসলমান।’ আসুন হাতে হাত ধরে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গাই ‘সম্প্রীতির গান’ আর লাখো কণ্ঠে সন্ত্রাসবাদ আর উগ্রবাদকে বলি ‘না’! লেখক : সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×