ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং আমাদের প্রত্যাশা

প্রকাশিত: ০৮:৫৩, ২৬ এপ্রিল ২০১৯

জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং আমাদের প্রত্যাশা

আগামী ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী। বাংলা ও বাঙালীর ইতিহাসে আলাদা রকম মহিমাময় এই মাহেন্দ্রক্ষণ। বছরব্যাপী স্বতঃস্ফূর্ত এবং প্রাণবন্ত আয়োজনে এই উৎসব উদযাপিত হবে। এ জন্য আমরা সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। এ বছর আমাদের জীবন অভিজ্ঞতার অসাধারণ অংশ হয়ে থাকবে। সরকার ইতোমধ্যে এই লক্ষ্যে দুটি কমিটি গঠন করেছে : ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটি’ এবং ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি।’ এই দুই কমিটিতে রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিশিষ্টজন যেমন : স্পীকার, প্রধান বিচারপতি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, শিক্ষাবিদ, শিল্প-সংস্কৃতি-ক্রীড়া ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এবং ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটির সভাপতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের কর্মসূচি সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করছে জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি। এ কমিটি জাতীয় কমিটির সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনার আলোকে সার্বিক কার্যক্রম গ্রহণ করবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বাস্তবায়ন কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করছে। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত ৮টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিসমূহ বিবিধ পরিকল্পনা ও কর্মসূচী গ্রহণের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই কমিটির প্রথম যৌথসভা করেছেন। এ সভায় উপস্থিত সদস্যবৃন্দ দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা করেছেন, বছরব্যাপী উৎসব আয়োজন বিষয়ে বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছেন এবং অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই জন্মশতবার্ষিকী একটি বিশেষ সময়কালের অর্জন ও গৌরবের সঙ্গে যুক্ত। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর সুগভীর তাৎপর্যের সঙ্গে এ সময় যোগ হবে উন্নয়ন ও অগ্রগতির কয়েকটি মাইলফলক। বঙ্গবন্ধু একটি সমৃদ্ধ সোনার বাংলার স্বপ্নযাত্রা শুরু করেছিলেন। তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেই স্বপ্নযাত্রা গতি পেয়েছে। আজ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের নানা বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশ বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। দেশে যে কয়টি মাইলফলক এই সময়ে অতিক্রান্ত হবে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ। এ সবই বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার ও প্রত্যয়ের ধারাবাহিকতার দৃষ্টান্ত। এই বিষয়গুলো নিয়ে বহু লেখা হয়েছে। আমি সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিস্তারিত উল্লেখের দিকে যাচ্ছি না। জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন ও সরকারী অঙ্গীকার বাস্তবায়নের এই মেলবন্ধনের ইতিহাস সম্ভবত অন্য কোন দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে ‘মহান স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ পূর্তির দ্বারপ্রান্তে উপনীত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনকালে সুখী সমৃদ্ধ ভবিষ্যত বিনির্মাণে রূপকল্প ২০২১ সফলভাবে সম্পন্ন করা জাতির কাছে আমাদের অঙ্গীকার।’ জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঙ্গে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রত্যয়কে যুক্ত করা হয়েছে যা এ উৎসব আয়োজনকে সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যে অভিষিক্ত করবে। জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন পৃথিবীতে নতুন ঘটনা নয়। এর আগেও অনেক বিখ্যাতজনের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন সম্পর্কে আমরা জানি। বর্তমানে ভারতে মহাত্মা গান্ধীর ১৫০তম জন্মশতবার্ষিকীর উদযাপন চলছে। মহাত্মা গান্ধী জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর। এ উপলক্ষে ভারতেও বিভিন্ন কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং উদযাপিত হচ্ছে। ইতোপূর্বে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর জন্মশতবার্ষিকীও উদযাপন করা হয়েছে। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯১৭ সালের ১৯ নবেম্বর। দক্ষিণ আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মশতবার্ষিকী কিছুদিন আগে উদযাপিত হলো। নিকট অতীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ আয়োজনে উদযাপন করা হয়েছে। জনগণ ইতিহাসের চালিকাশক্তি। কিন্তু ব্যক্তির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিজ গুণে, সক্ষমতায়, সাহস ও মেধার অসাধারণ দীপ্তিতে এবং আন্দোলন সংগ্রামের দীর্ঘ ও কষ্টকর পথ পেরিয়ে কোন কোন ব্যক্তি আবির্ভূত হন জাতির কণ্ঠস্বর হিসেবে। জনতার অভিপ্রায়, আকাক্সক্ষা ও স্বপ্ন ধারণ করে জাতিকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও মুক্তির নতুন দিগন্তের সন্ধান দেন তারা। পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা এ রকম অনেক মহামানব সম্পর্কে জানি। বঙ্গবন্ধু তার সাহস, অনমনীয় দৃঢ়তা এবং অসাধারণ বাগ্মিতার অভূতপূর্ব সমন্বয়ে বাঙালীর শ্রেষ্ঠতম নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। জেল, জুলুম, অত্যাচার কিছুই তাকে বাঙালীর মুক্তির স্বপ্নযাত্রা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। সম্প্রতি জেলখানা থেকে প্রকাশিত একটি গ্রন্থে দেখা যায়, ৩০৫৩ দিন তিনি জেলখানায় অতিবাহিত করেছেন। সেই যে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনকালে গ্রেফতার হয়েছিলেন, তারপর থেকে জেলখানাই হয়ে উঠেছিল তার নিত্য আবাসস্থল। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ এই দুটি অসাধারণ গ্রন্থে এবং সম্প্রতি প্রকাশিত তার Secret Documents of Intelligence Branch on Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman গ্রন্থে আমরা এসব দিনের অনেক খুঁটিনাটি সম্পর্কে জানতে পারি। বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষ থেকে অসাধারণ উচ্চতায় আসীন হয়েছেন। রূপান্তরিত হয়েছেন ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে। তার ৭ মার্চের ভাষণ আজ ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত। এ ভাষণ বাঙালীর ইতিহাসের বাঁক বদলের ভাষণ। কারণ এর আগে বাঙালীকে কেউ এভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি, কেউ এভাবে স্বাধীনতার ডাক দেয়নি তার ডাকেই বাঙালী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনে। এ ভাষণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যুদ্ধাবস্থার ভাষণ। একদিকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর রক্তচক্ষু ও তাদের ট্যাঙ্ক-কামান প্রস্তুত অন্যদিকে নিরস্ত্র বাঙালীর হৃদয়ে স্বাধীনতার আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছেন অকুতোভয় এক মহানায়ক। ৭ মার্চের অগ্নিগর্ভ ভাষণে তিনি আবির্ভূত হয়েছেন জাতির একমাত্র প্রতীক হিসেবে। সেদিন তিনি শুধু ব্যক্তি নন, শুধু নেতা নন, বাঙালী জাতিসত্তার হাজার বছরের অতিক্রান্ত ইতিহাসকে ধারণ করে নিজেই রূপান্তরিত হয়েছেন জনতার কণ্ঠস্বরে। প্রথম সার্বভৌম বাঙালী হিসেবে জনতার শক্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার উদাহরণও তিনি সৃষ্টি করেছেন। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ধ্বংসস্তূপ থেকে পৌরাণিক ফিনিক্স পাখির মতো তাঁর নেতৃত্বে জেগে উঠেছিল নতুন দেশ। আরাধ্য সোনার বাংলা গঠনের লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের স্বপ্নযাত্রা শুরু করেছিলেন তিনি। ঘাতকের বুলেটে তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটেছে। কিন্তু আমাদের জীবনাচরণে, প্রাত্যহিকতায় চিরকালীন বাতিঘরের মতো তিনি সমুজ্জ্বল। নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি প্রতিমুহূর্তে আবির্ভূত হচ্ছেন প্রেরণার দীপশিখা হিসেবে। আজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের যে অভিযাত্রা, সেখানে তিনিই সাহস ও আলোকবর্তিকা। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী তাই বাঙালীর কাছে নিছক জন্মদিন নয়, বাঙালীর কাছে মুক্তিদাতার প্রতি সম্মান জানানোর বিরল সুযোগের দিন। সেই সঙ্গে যে জাতিকে তিনি সৃষ্টি করেছেন, তার অবয়ব দিয়েছেন এবং বিশ্বসত্তার গর্বিত অংশে রূপায়িত করেছেন, তাঁর প্রতি সেই জাতির সম্মিলিত কৃতজ্ঞতা প্রকাশেরও সময় এটি। জীবদ্দশায় তিনি শোষিতের নেতা হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মতো বিশ্বনায়কের চোখেও তিনি ছিলেন হিমালয়। বিশ্ব মিডিয়ায় তিনি ছিলেন ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে নন্দিত। বঙ্গবন্ধু যুগপৎ জাতির নেতা এবং বিশ্বনেতা। এই জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের মানুষ এবং বিশ্বের মুক্তিকামী, স্বাধীনতাকামী মানুষ বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানাবে, ভালবাসা জানাবে। আমরা আশা করি, এ আয়োজন একদিকে হবে গৌরবের নিরিখে ইতিহাসের উত্তরাধিকার এবং অন্যদিকে স্মৃতিময় ও উৎসবমুখর। আমাদের প্রত্যাশা, তরুণ প্রজন্ম ব্যাপকহারে এই আয়োজনে সম্পৃক্ত হবে। তাঁর জীবন ইতিহাস থেকে পাঠ নিয়ে আগামী দিনের বাংলাদেশের কুশীলব হিসেবে তারা আবির্ভূত হবে। বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন এই দেশে। আজ পৃথিবী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতিতে ৪র্থ বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। উদ্ভাবনা ও অগ্রগতির এই বিস্ময়কর যাত্রার সঙ্গে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পাঠ বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশে পরিণত করতে সহায়ক হবে। বঙ্গবন্ধু আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তিনি আমাদের অতীত, বর্তমান ও উজ্জ্বল ভবিষ্যত। বাংলাদেশ সেই উজ্জ্বলতার আলোকসম্পাতে আলোকিত হবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন আয়োজনের প্রাক্কালে এই আমাদের প্রত্যাশা। লেখক : কবি, সাবেক মুখ্য সচিব ও সদস্য সচিব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটি
×