ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শহর, চলচ্চিত্র ও সত্যজিৎ

প্রকাশিত: ১২:৩৯, ২৬ এপ্রিল ২০১৯

শহর, চলচ্চিত্র ও সত্যজিৎ

শহরের সঙ্গে চলচ্চিত্রের সম্পর্ক কেমন? আদৌ আছে কি? অথবা যদি অনুসন্ধান করা হয় শহর কেমন করে জায়গা করে নেয় রুপালি দুনিয়ায়? এই দুনিয়াটাই বা কি করে তুলে ধরে শহরকে? শহর মানে তো যান্ত্রিকভাবে এগিয়ে থাকা জায়গা। আধুনিকতা যেখানে বসবাস করে। গ্রাম পিছিয়ে থাকা জনপদ। নগরের মানুষ যেভাবে দিন যাপন করে, তার সঙ্গে চলচ্চিত্রের সম্পর্ক আছে কি? সত্যজিৎ রায় প্রথম ছবিতেই দৃষ্টি কেড়েছেন, সেটি ছিল গ্রামের পটভূমি, কিন্তু সেই ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫) ছবির পরবর্তী ছবিগুলোতে শহর প্রবেশ করেছে, অর্থাৎ অপু ত্রয়ীর বাকি দুটি ছবি: ‘অপরাজিত’ (১৯৫৬) ও ‘অপুর সংসার’ (১৯৫৯)। এই ত্রয়ী ছাড়াও সত্যজিতের আরো একটি ত্রয়ী রয়েছে : ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ (১৯৭০), ‘সীমাবদ্ধ’ (১৯৭১) ও ‘জন অরণ্য’ (১৯৭৫), এগুলোকে বলা হয় কলকাতা ত্রয়ী, একেবারে নগরকে কেন্দ্র করেই নির্মিত চলচ্চিত্র। এগুলো ছাড়াও নগরের নাম নিয়েই আরও একটি ছবি সত্যজিৎ নির্মাণ করেছেনÑ ‘মহানগর’ (১৯৬৩)। শুরুর প্রশ্নগুলোর উত্তর যদি সত্যজিতের ছবিকে সামনে রেখে দেয়ার চেষ্টা করা হয় তা হলে সেই উত্তর কেমন হবে? চলুন সেই চেষ্টা কিছুটা করা যাক। ‘পথের পাঁচালী’তে যেমনটা দেখা যায় সামান্য ঠা-া-জ্বরেই মারা যেতে হয় দুর্গাকে। আর এই মৃত্যুই যেন ঝড়ের তা-ব নিয়ে হাজির হয় হরিহর ও সর্বজয়ার সংসারে। ছোট্ট অপুকে নিয়ে তারা গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়। সেখান থেকেই শুরু হয় বিচ্ছিন্নতার পালা। অপুও একসময় কলকাতা শহরে আসে লেখাপড়া করতে। গ্রামে ভাল বিদ্যালয় নেই। শিক্ষা, চিকিৎসা ও অর্থনৈতিক কারণেই মানুষ মূলত গ্রাম থেকে শহরে পাড়ি জমায়। তারা আধুনিক জীবনযাত্রায় শামিল হতে চায়। নগরের আধুনিক সুযোগ সুবিধা গ্রামে সহসা পৌঁছায় না। নানা মাত্রিক সুযোগ-সুবিধা বা অসুবিধার কারণেই তাই বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ শহরে ভিড় করে। আর তাতেই বিচ্ছিন্ন হতে থাকে মানুষ। মার্কিন নৃতাত্ত্বিক লুইস ওয়ার্থ নিজের বিখ্যাত ‘আরবানিজম এজ আ ওয়ে অব লাইফ’ (১৯৩৮) প্রবন্ধে বলছেন, শুদ্ধ বিশাল সংখ্যক জনসংখ্যার কারণেই মানুষ শহরে গ্রামের মতো সামাজিক বন্ধন গড়ে তুলতে পারে না। শহরে এসে মানুষ অনেক বেশি বিষয়বুদ্ধি সম্পন্ন হয়ে ওঠে এবং অনেক বেশি মেপে মেপে পা ফেলে চলে। নিরন্তর ছুটে চলা মানুষের নগরে বন্ধু পাওয়া বেশ মুশকিল। শহরে নানা সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে আসা মানুষের কারণেই একক মানুষগুলো এক ধরনের অস্থির, আস্থাহীন ও আমোদহীন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে। লুইসের এই পর্যবেক্ষণকে যদি মিলিয়ে দেখা যায়, তাহলে অপুর ক্ষেত্রেও এমন অস্থিরতা ও নিরানন্দ অবস্থার দেখা পাওয়া যায়। সর্বক্ষণ মায়ের তথা গ্রামের প্রতি টান, শহরে আশ্রয় নিয়ে দ্বিধা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা সব মিলিয়ে অপু যেন গ্রাম থেকে আসা সকল তরুণের প্রতিনিধি হয়ে ওঠে। ভাগ্যিস ছাপাখানায় একটা চাকরি পেয়ে গিয়েছিল অপু। নয় তো উজ্জ্বল ও উন্নত নগরের বিপরীতে যে অন্ধকার ও জরাজীর্ণ আরেকটা নগর আছে সেটা কি অপুর দেখা হতো? দিনে পড়ালেখা, রাতে ছাপাখানার কাজ। হাড় ভাঙ্গা খাঁটুনির নামই শহর। এখানে বিজলি বাতি আছে বটে, মনের ভেতর এখানে ভর করে থাকে একরাশ অন্ধকার। কলেজে যখন অপুর শিক্ষক লক্ষণা শব্দটির ইংরেজী সিনেকডকি নিয়ে বক্তৃতা দেয়, তখন মনে হয় শহরের বাইরে থেকে আসা নানা ধরনের মানুষের লক্ষণ যেন ফুটে ওঠে এই সদ্য শহরে আসা ছেলেটির চোখেমুখে। অসহায়। অভিভাবকহীন। বিমর্ষ। এরপর অপু যখন বড় হয়, কলেজ পাস করে মেসবাড়িতে থাকে, তখনো বৈষয়িক অবস্থার উন্নতি হয়নি তার। বাড়িওয়ালা ভাড়ার জন্য তাড়া দেয়। শহরে এই বাড়ি ভাড়ার অর্থনীতিতে অপু ঠিক নিজেকে মানিয়ে চলে। এতদিনে সে চালাকিটা রপ্ত করে নিয়েছে। কথায় সে কুপোকাত করে বাড়িওয়ালাকে। তিন মাসের ভাড়া বাকি, তার পরও এতটুকু চিন্তিত দেখা যায় না অপুকে। বোঝা যায় শহরে টিকে থাকার মন্ত্র তার আর অজানা নেই। সমাজতাত্ত্বিক জর্জ সিমেল যেমনটা বলেন, শহরে বিদ্যমান আধুনিক বাজার অর্থনীতিই এখানকার মানুষের নানা মাত্রায় গড়ে তোলে, এমনকি একে অপরের সঙ্গে কেমন আচরণ করবে সেটাও নির্ধারণ করে দেয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। বেকার অপুর জন্য এখানে কেউ সহমর্মিতা দেখায় না। যে যার যার মতো করেই ছোটে জীবন ও জীবিকার তাগিদে। এক ভবনে থাকলেও এক অপূর্ব কুমার রায়ের সঙ্গে কখনও মোলাকাত হয় না আরেক রায়ের। তাই একজনের চিঠি আরেকজনের হাতে চলে যায়। এমন নাম বিভ্রাট শহরেই সম্ভব। এটা দিয়ে শহুরে বিচ্ছিন্নতার রূপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এখানে কেউ কাউকে চেনে না ভাল করে। এই না চেনাচিনির ভেতরেই অপু ঘটনাচক্রে বিয়ে করে স্ত্রী আনে ঘরে। সে সন্তান জন্মদানের সময় মারা যায়। পুত্রসন্তান কাজলকে বাধ্য হয়েই গ্রামে রাখে অপু। এক সময় অপু আর কলকাতা সমার্থক হয়ে ওঠে কাজলের কাছে। বাবা কলকাতা থাকে, এর মধ্যে যে দূরত্ব রচিত হয়, সেটাই গ্রাম ও শহরের দূরত্ব। শহরের জটিলতা গ্রামে বিরাজ করে না। অর্থাৎ গ্রাম যে ছন্দে চলে, শহর সে ছন্দে চলে না। গ্রাম যদি ধ্রুপদী ওলন্দাজ চিত্রকর্ম হয়, শহর হলো কোলাজ। শহরের যে বিচ্ছিনতা সেটাকে ভাল করে না বুঝলে নাকি গোটা শহরকে ভাল করে বোঝা যায় না, এমনকি চলচ্চিত্রকেও পড়া যায় না। হাঙ্গেরিয়ার চলচ্চিত্র প-িত বেলা বালাজ মনে করতেন, শহরকে পাঠ করতে জানলে চলচ্চিত্রকে পাঠ করা যাবে। শহরে যাপনের অভিজ্ঞতা চলচ্চিত্র বুঝতে সহায়তা করে। তিনি আসলে ইঙ্গিত করেছিলেন চলচ্চিত্রের একক বিচ্ছিন্ন শটকে দৃশ্যের মাঝে বসিয়ে পুরো বয়ানকে বোঝার ক্ষমতার দিকে। শহরেও এমন বিচ্ছিন্ন সব দৃশ্যাবলী ঘুরে বেড়ায়। শহরকে বুঝতে হলে এই টুকরো টুকরো দৃশ্যকে মালায় গাঁথতে জানতে হবে। তাই বালাজ বলেছিলেন, শহরের জীবনে অভ্যস্ত লোকেরাই চলচ্চিত্র ভাল বোঝে। যদিও বিষয়টি একেবারেই ভ্রান্ত। কারণ চলচ্চিত্র বুঝতে গ্রাম ও শহরের জীবনযাপন কোন পূর্বশর্ত হতে পারে না, সেটা প্রমাণিত। তবে বালাজের কথা থেকে আমরা বিচ্ছিন্নতার যে মিল, শহর ও চলচ্চিত্রের, অতটুকু নিতে পারি। নগরে ইজমাইলি বলি বা যৌথ বলি, সে সবের কোন বলাই নেই। এই যে শহর জটিল, বিচ্ছিন্ন, একঘেয়ে, যান্ত্রিক, এর সঙ্গে চলচ্চিত্রের মিলের কথা শুধু বালাজই নন, বলেছেন চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক সিগফ্রিড ক্র্যাকুয়ার ও সাহিত্য সমালোচক বাল্টার বেনিয়ামিন। তাদের মতে চলচ্চিত্র নানাভাবে নগরের অভিজ্ঞতার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। নাগরিক জীবনের যে প্যাঁচ সেটি খোলার ক্ষমতাও এই চলচ্চিত্রের আছে বলে মনে করতেন তারা। শহুরে আধুনিকতার যে দ্বন্দ্ব সেগুলোর নন্দনতাত্ত্বিক রূপায়ণ চলচ্চিত্রেই সম্ভব বলেও মনে করতেন ক্র্যাকুয়ার ও বেনিয়ামিন। এর কারণ শহর ও চলচ্চিত্রের অন্তর্গত মিল। কারখানার ভাষা রপ্ত করা চলচ্চিত্র যেমন খ- খ- দৃশ্য ও মন্তাজের মতো দ্বান্দ্বিক উপাদানগুলোকে ধারণ করতে পারে, তেমনি শহরও আধুনিকতার দ্বন্দ্বকে বুকে লালন করে সামনে এগুতে পারে। নয় তো এত সম্ভাবনার শহরে বেকার থাকত না, আলো ঝলমলে হোটেলের পাশেই অন্ধকার বস্তি গড়ে উঠত না। এই দ্বন্দ্বের ভেতরেই সমাধান লুকিয়ে আছে। নাগরিক জীবনের দ্বন্দ্বময় আধুনিকতা থেকে বেরিয়ে আসার ইঙ্গিত চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দেয়া সম্ভব। ক্র্যাকুয়ার যেমন মনে করতেন, চলচ্চিত্র এমন আধুনিকতার বিদায় ঘণ্টা বাজানো দেখাতে পারে, যদিও বেশিরভাগ সময়ে সেটা দেখা যায় না; অন্যদিকে, বেনিয়ামিন আশাবাদী, তিনি মনে করতেন, খ- খ- থেকেও অখ- বয়ান তৈরির যে ক্ষমতা চলচ্চিত্র ধারণ করে, সেটি নগরবাসীকে আধুনিকতার মায়াজালকে ছিঁড়ে ফেলতে সাহায্য করবে। এভাবেই তাদের বয়ানে চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে ইউটোপিয়ার ভাষাও। মানে চলচ্চিত্র দিয়ে মানুষকে জাগানো সম্ভব বলেই মানতেন তারা। নান্দনিকভাবে চলচ্চিত্র যে পাদপ্রদীপের নিচে অন্ধকারকে বেশ ভালভাবে তুলে ধরতে পারে, আধুনিকতার স্বরূপকে দৃশ্যায়ন করতে পারে তার আরও উদাহরণ টানা যায় সত্যজিতের কলকাতা ত্রয়ী থেকে। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবিতে সিদ্ধার্থ যেমন হন্যে হয়ে ঘোরে একটি চাকরির জন্য। ষাটের দশকে কলকাতা যে রাজনৈতিক টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল, তার ভেতর তীব্র বেকারত্ব কি করে একটি যুবকের মনে সমাজ বদলের ঘূর্ণি তৈরি করে, কি করে সে অনুধাবন করে বিপ্লব ছাড়া কিছু হবে না, সেটারই এক বয়ান এই ছবি। যদিও সিদ্ধার্থ শেষ পর্যন্ত বিপ্লবী হতে পারে না, বিপ্লবী হয় তার ছোট ভাই টুলু, তার পরও সে ছোটখাটো প্রতিবাদ করে, চাকরির ইন্টারভিউতে, চাকরিদাতাদের বিরুদ্ধে। চাকরিপ্রার্থীরা একে অপরকে চেনে না, তারা নানা সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে আসা মানুষ, কিন্তু সকলেই আবার একটি সূত্রে গাঁথা, তাদের সকলের চাকরি চাই। এই নগরে টিকে থাকতে হবে। এখানে জমিজমা নেই, যে চাষাবাদ করে খাবে। এখানে পুকুর নেই যে মাছের খামার করবে। সকলেই শহরে থাকতে চায়, চাকরিই তাদের মূল ভরসা। এমন বিচ্ছিন্ন কিন্তু একই সুতায় গাঁথা আরেকটি চমৎকার উদাহরণ দেখা যায় ’প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবির শুরুতেই। বেনিয়ামিন যেমনটা বলছিলেন, চলচ্চিত্র যেমন খ- খ- দৃশ্যে বিভক্ত কিন্তু প্রত্যেকেই আবার একটি বয়ান রচনা করে, তেমনি সত্যজিতের এই ছবিতে আমরা দেখি বাসভর্তি মানুষ, নিজেদের গন্তব্যে যাচ্ছে। কেউ কাউকে চেনে না। নিজেদের মতো করে তারা যাচ্ছে, একই যানে চড়ে যাচ্ছে, কারও সঙ্গে কারও কোন আলাপ নেই। হঠাৎ দেখা গেল সকলে একদিকে তাকিয়ে নমস্কার করছে। মানে মন্দিরের দর্শন পেয়েছে সকলে। অর্থাৎ পরস্পরের কাছ থেকে বিযুক্ত মানুষগুলো আর অন্যান্য যে বিষয়ের দ্বারা যুক্ত তার মধ্যে একটি হলো ধর্ম। ধর্মের মন্ত্র এই বিযুক্ত মানুষগুলোকে আবার এক করে রেখেছে। শহরের এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য বটে। বাংলাদেশেও জুমাবারে মসজিদে অনেক মুসল্লি যান, তাদের কে কয়জনকে চেনে? কিন্তু গ্রামে কি এমটা হওয়া সম্ভব? উপাসনালয়ে চাকরির জন্য প্রার্থনা করা যুবকের সংখ্যা কি এখন কমে গেছে? বরং বেড়েছে। কলকাতাতেও তখন, ষাটের দশকে সিদ্ধার্থের মতো চাকরির জন্য উদগ্রীব ও মরিয়া ম্লান মুখের তরুণেরা দ্বারে দ্বারে ঘুরত। আবার এই শহরেই তরুণদের মধ্যেই কেউ কেউ দান মেরে দেয়, চাকরি টিকিয়ে রাখতে হীন কাজ করে। আবার কখনও বা এপারের মাল ওপারে বেঁচে, এমনকি নারীর সম্ভ্রমের বিক্রেতাও হয়ে ওঠে তারা। ‘সীমাবদ্ধ’ ছবিতে আমরা দেখেছি শ্যামলেন্দু নামের এক যুবক কি করে নিজের চাকরি ও ক্যারিয়ারকে উর্ধগামী করে রাখতে কারখানায় বোমা ফাটিয়ে একজনকে আহত করতেও কসুর করে না। শ্যামলেন্দু ছবির শুরুতেই ব্যাখ্যা করে জানান দেয়, বাংলা দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাই দশ লাখের বেশি। তবে সে ওই দলভুক্ত নয়। সে কাজ করে একটি লাইট ও ফ্যান তৈরির একটি বিদেশী কারখানায়। কর্মকর্তা। ছবিতে অ্যাসেম্বলি লাইনে বৈদ্যুতিক পাখা তৈরির বিভিন্ন দৃশ্য দেখানো হয়। এখানে যেন প্রতিধ্বনিত হয় বেনিয়ামিনের বাক্য। তিনি বলেছিলেন, অ্যাসেম্বলি লাইনের মধ্যে যেভাবে পণ্য উৎপাদনের ছন্দ নিয়ন্ত্রণ হয়, সেই প্রক্রিয়া মেনেই চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়। অর্থাৎ চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও নানা স্তরে মানুষ কাজ করে, কারখানার এ্যাসেম্বলি লাইনের মতো বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন কাজ সম্পন্ন হয়, প্রি-প্রোডাকশন থেকে পোস্ট প্রোডাকশন পর্যন্ত, তারপর একটি গোটা চলচ্চিত্র আমরা পাই। এ জন্যই লোকে বলে চলচ্চিত্র কারখানার ভাষায় কথা বলে। তো মুৎসুদ্দি পুঁজির ঠিকাদার এই শ্যামলেন্দু যেভাবে বলছিল, তারা আলো আর হাওয়ার কারবার করে, মূলত আধুনিক সভ্যতায় এভাবেই যা প্রাকৃতিক উপাদান, তা মোড়কে মুড়ে বিক্রি করে। স্থাপত্যকলাকে আয়ত্ত করে যদি দক্ষিণমুখী করে ঘর বানানো হয়, তাহলে কি আদৌ পাখার প্রয়োজন পড়ে? যদি রাস্তাঘাট নির্বিশেষে সব সিমেন্টে না ঢেকে, যদি গাছপালা বেশি করে লাগিয়ে, পরিবেশবান্ধব ঘর বানানো হয়, যদি এই বাংলায় ইউরোপীয় কায়দায় বাক্সবাড়ি না বানিয়ে এখানকার জলবায়ু উপযোগী বাসস্থান তৈরি করা যায়, তাহলে কি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র বসাতে হয় আদৌ? আজকাল তো পানি বোতলে ভরে বিক্রি হচ্ছে, অথচ সুপেয় পানি তো এমনিতেই পাওয়ার কথা মানুষের। এই আধুনিক ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা সকল কিছুকেই বিক্রি করতে চায়। এমনকি বন্ধুর বোনকেও বিক্রি করতে বাঁধে না তার। সত্যজিতের ‘জন অরণ্য’ ছবিতে আমরা মুনাফাভিত্তিক ব্যবসার এমনই কদর্য দিকটি দেখি। ছবিটির একটি বেশ বিখ্যাত দৃশ্য আছে, যেখানে সোমনাথ ও বিশুদার সংলাপ হয় বড় বাজারে হাঁটতে হাঁটতে। এখানেও বেকারত্বের প্রসঙ্গ আছে। সোমনাথ চাকরি খুঁজছে। বিশুদা তাকে বুদ্ধি দেয় ব্যবসা করার। শহরে নাকি টাকা ওড়ে, ধরতে জানতে হয়। বড় বাজারের বিচিত্র সব ব্যবসার দিক তুলে ধরে বিশুদা। এতে লোভ ধরে যায় সোমনাথের। কলেজ পাস করা সোমনাথ চাকরির পেছনে না ছুটে তাই ব্যবসা শুরু করে, মালামাল সরবরাহের ব্যবসা। কম দামে কিনে বেশি দামে বেচার ব্যবসা। খদ্দের ধরতে হয়। খদ্দের ধরতে গেলে তাদের নানা রকম আবদার থাকে। সেগুলো মেটাতে হয়। খদ্দেরকে খুশি করতে গিয়ে সোমনাথের মেয়ে সরবরাহ করতে হয়। শেষতক গিয়ে সে আবিষ্কার করে মেয়েটি তারই ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বোন। এই পরিচয় অবশ্য কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। কারণ এই শহরে সবকিছুর বেচা-বিক্রিই চলে। আর এটা সম্ভব হয় বিচ্ছিন্নতার কারণেই। সোমনাথ যদি বন্ধু সুকুমারের সঙ্গে সংলগ্ন বোধ করত তাহলে সে সুকুমারের বোনকে বাধা দিত। সে বিচ্ছিন্ন বলেই কাজটি করতে শেষ পর্যন্ত তার কোথাও আটকায়নি। এই বিচ্ছিন্নতাবোধ সত্যজিতের ‘মহানগর’ ছবিতে আমরা দেখি এক মধ্যবিত্ত পরিবারের ভেতর। শহরে টিকে থাকার সংগ্রামে যখন এক গৃহবধূ আরতিকে সেলসগার্লের চাকরি নিতে হয়, যখন সারাদিন ক্লান্তিকর কাজ শেষে বাড়ি ফিরে আর সাংসারিক কাজে হাত দিতে মন চায় না, তখন গোটা সংসারটাই যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আরতির কাছ থেকে। এই শহর, এই আধুনিকতা, এই নিরন্তর বেঁচে থাকার লড়াই, পুঁজিবাদী সমাজে, হয়ে ওঠে বিচ্ছিন্নতার নামান্তর। তাই তো আরতিকে বড্ড অপরিচিত ঠেকে স্বামী সুব্রতর। শহরে টিকে থাকার স্বামী-স্ত্রীর প্রচেষ্টার বিপরীতে গ্রাম থেকে আসা আরতির শ^শুর-শাশুড়িকে দেখা যায় বিরক্তি প্রকাশ করতে। তারা চায় গ্রামের মতোই ঘরের বউ ঘরে সংসারের কাজ করুক। নগরের নির্মম বাস্তবতা তারা অনুধাবন করতে পারে, আবার এই বাস্তবতা তাদের মেনে নিতেও কষ্ট হয়। বাঁধে। দুই প্রজন্ম ও দুই ঘরানার এই দ্বন্দ্ব নিয়ে শহর চলে। চলে আসছে। এই ছবিতে কিন্তু শেষ পর্যন্ত শ্যামলেন্দু বা সোমনাথের মতো আধুনিক ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাছে হার স্বীকার করে না আরতি। সে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে চাকরিতে ইস্তফা দেয়। এখানেই যেন আশা সঞ্চারিত হয়। শহরটা শুধু চাকরি টিকিয়ে রাখতে চাওয়া কিছু ইঁদুর দৌড়ে সামিল মানুষদের সমাবেশ নয়, এখানে এখনও মাথা উঁচু করে বাঁচতে চায়, এমন মানুষও আছে। হয়ত তাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্য নেই, কিন্তু তাদের নৈতিক শক্তিটুকু শেষ হয়ে যায়নি। এমন মানুষগুলো একটু যেন বেমানান শহরে। শহরে আরতি নয়, সোমনাথ বা শ্যামলেন্দুকেই যেন বেশি মানায়। এখানে মানুষ স্বার্থপর হবে, একে অপরকে সহজে বিশ^াস করবে না, কারণ যে কোন মুহূর্তে তারা প্রতারণার শিকার হতে পারে, এখানকার মানুষ হবে আত্মকেন্দ্রিক, নিজের চিন্তা আগে করবে, কোন কিছু দেখলেই সেটা বিনা যাচাইয়ে বিশ^াস করে নেবে না, যেহেতু এখানকার মানুষ বিচ্ছিন্ন, একে অপরকে ভাল করে চেনে না, চিনে নেয়ার সুযোগও নেই, তাই শহর এক অদ্ভুত সম্পর্কের জায়গায় পরিণত হয়। এখানে সম্পর্ক নির্ণয় হয় মূলত অর্থের বিচারে। অর্থনৈতিক সামর্থ্য না থাকলে শহরের ঘিঞ্জি দুই কামড়ার বাসায় আপন বাপ-মাকেও পর পর মনে হয়। আর তো বিস্মৃত মামা। সত্যজিতের ‘আগন্তুক’ ছবিতে এমনই বহু বছর আগে নিরুদ্দেশ হওয়া মামা হাজির হলে একটি শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারে যা যা ঘটতে পারে, সবই ঘটে। শেষতক দেখা যায় মামাটি তাদের মতো শহুরে মানসিকতার নয়, তিনি অনেক বেশি বৈশি^ক ও মানবিক। শহরকেন্দ্রিক এসব ছবিতে যে মানুষগুলোর কথা বলেছেন সত্যজিৎ তারা প্রত্যেকেই শহরের আবহাওয়ার মতোই। অচেনা। একা। বিচ্ছিন্ন। তারা যূথবদ্ধ নয়। তারা সমাজে আছে বটে, সামাজিক শক্তি হিসেবে তারা আবিষ্কৃত হয় না। তারা প্রত্যেকেই নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মরিয়া। অপু যেমন গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল, তারপর টিকে থাকার জন্য তার হতে হয়েছিল বাকপটু, সিদ্ধার্থ তো টিকতেই পারেনি, শহর ছেড়ে দূরে চলে যেতে হয়েছিল তাকে, শ্যামলন্দেুকে টিকে থাকার জন্য যে নোংরামি করতে হয়েছে, তার থেকে কম যায়নি সোমনাথ। আরতি টিকে থাকার চেষ্টা করেছে, তবে নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে নয়। চরিত্রগুলো আমাদের সামনে এমনভাবে চিত্রায়িত হয়, মনে হয় এরাই তো শহরের ভাঙ্গা ভাঙ্গা প্রতিচ্ছবি। সিগফ্রিড ক্র্যাকুয়ারের ভাষা ধার নিয়ে বলা যায় ‘ক্যালাইডোস্কোপিক সাইট’। চলচ্চিত্রের ভাষাও ও রকমটাই। বেনিয়ামিন বচনে একজন ব্যক্তি যেমন করে শহরে ট্রাফিক চাক্ষুষ করে, তেমনি করেই চলচ্চিত্র গড়ে ওঠে। অনেক কিছু বাদ দিয়ে, অনেক কিছু নিয়ে সে নির্মিত হয়। শহরে চলার পথে এত কিছু আপনার চারপাশে ঘটতে দেখবেন, সবকিছুকে আপনি আমলে নিতে পারবেন না, নজরবন্দী করতে পারবেন না, নইলে বিপত্তি ঘটবে। তেমনি চলচ্চিত্রও সাবজেক্টিভ উপায়ে সামনে এগোয়। খ-িত শটের মাধ্যমে, অখ- বয়ান হাজির করে। ক্র্যাকুয়ার ও বেনিয়ামিনের মতে চলচ্চিত্র শহরের ভাষায় কথা বলে। এটাকে শহরের মতো করে পর্যবেক্ষণ করতে হবে বলে তাদের মতো। তবে আমরা মনে করি, চলচ্চিত্র অচেতনের ভাষায় কথা বলে। নয় তো মানুষ ঘুমে অচেতন অবস্থায় চলচ্চিত্রের মতো করে স্বপ্ন দেখে কি করে? উল্লিখিত ছবিগুলোও আখেরে সত্যজিতের অচেতনকেই দেখিয়ে দেয়। একজন আপাদমস্তক শহুরে নির্মাতার হাতে কোন রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে শহরের বিনির্মাণ হয়েছে, তা স্পষ্ট এসব ছবিতে। সেই আলোচনা ভিন্ন জায়গায় জারি আছে। দোহাই ১. পিটার লারসেন, (২০১০), আরবান লেজেন্ডস : নোটস অন আ থিম ইন আরলি ফিল্ম থিয়োরি, প্রিবেন কারশম সম্পাদিত সিটি ফ্লিকস : ইন্ডিয়ান সিনেমা এ্যান্ড দ্য আরবান এক্সপেরিয়েন্স, কলকাতা : সিগাল বুকস
×