ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মাল্টিটাস্কিংয়ে স্মৃতিশক্তি কমে!

প্রকাশিত: ১২:৪২, ২৬ এপ্রিল ২০১৯

মাল্টিটাস্কিংয়ে স্মৃতিশক্তি কমে!

ডিজিটাল প্রযুক্তির এই যুগে আমাদের ব্যস্ততার শেষ নেই। সেই সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনের ‘মাল্টিটাস্কিং’ বা একসঙ্গে একাধিক কাজ সম্পন্ন করার চাপ তো রয়েছেই। আমাদের মস্তিষ্ক কীভাবে তা সামাল দিচ্ছে, বিজ্ঞানীরা তা জানার চেষ্টা করছেন। মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে ফেসবুক চ্যাট, হাতে রান্নার খুন্তি- এমন দৃশ্য তেমন বিরল নয়। কিন্তু এমন ‘মাল্টিটাস্কিং’ নাকি স্মৃতিভা-ারের জন্য মোটেই ভাল নয়। অতীতে মানুষের মস্তিষ্ক খেলাচ্ছলে বেশিরভাগ উদ্দীপনায় সাড়া দিতে পারতো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের সামনে চ্যালেঞ্জ বেড়ে চলেছে। আগে শুধু ইলেকট্রনিক সংবাদ মাধ্যমের দৌলতে আমরা আরও ঘনঘন তথ্য পেতাম। আজকের ডিজিটাল জগতে সবকিছু ও সবাই এক নেটওয়ার্কের অংশ হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়। ফলে আমাদের মস্তিষ্ককে অবিরাম উদ্দীপনার ঢেউ সামলাতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি কিন্তু মোটেই আদর্শ নয়। স্নায়ুবিজ্ঞানী ইয়ানা ফান্ডাকোভা বলেন, ‘স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে একটি উদ্দীপক আমাদের কাছে আসে। ফলে মস্তিষ্কের মধ্যে এক প্রক্রিয়া চলে। তারপর পরবর্তী উদ্দীপকের প্রতি মনোযোগ দেওয়া হয়।’ কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ সেই সুযোগ পান না। তাদের অবিরাম তথ্যের বন্যার মুখে পড়তে হয় এবং অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কাজ সারতে হয়। মস্তিষ্ক কীভাবে এই চাপ সামলায়, স্নায়ুবিজ্ঞানী হিসেবে ইয়ানা ফান্ডাকোভা তা জানতে চান। তিনি স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। তাদের সামনে কিছু কঠিন দায়িত্ব ছিল। পরীক্ষার সময় তাদের এই সব দানবের মধ্যে ৯টি পার্থক্য শনাক্ত করতে হয়েছিল। একই সময় বিভিন্ন বোতাম টিপে সঠিক বৈশিষ্ট্য বেছে নিতে হয়েছিল। কঠিন এই কাজের সময় গভীর মনোযোগের প্রয়োজন। এর মাধ্যমে ইয়ানা এমন এক পরিস্থিতির নকল করেছেন, যা আমাদের দৈনন্দিন ব্যস্ততায় ভরা জীবনযাত্রায় দেখা যায়। আমাদের পর পর ও দ্রুত বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে হয়। স্বেচ্ছাসেবীরা কত দ্রুত সহজ কাজগুলো করতে পারেন, এই কর্মসূচীর মাধ্যমে সবার আগে তা পরীক্ষা করা হচ্ছে। তারপর তাদের আরও দ্রুত গতিতে আকার-আকৃতি, রং ও নক্সার প্রতি নজর দিতে হয়। ইয়ানা ফান্ডাকোভা বলেন, ‘এগুলি এমন পরিস্থিতি, যখন মস্তিষ্ককে বিভিন্ন কাজ আলাদা করতে হয়। এ সব কাজ সাধারণত আমরা অবচেতন মনেই করি। কিন্তু নেপথ্যে আমাদের মস্তিষ্ক কঠিন পরিশ্রম করে।’ ইয়ানা পরীক্ষার সময় স্ক্যানারের মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবীদের উপর নজর রাখেন। তিনি সরাসরি তাঁদের মস্তিষ্কে উঁকি মেরে দেখতে চান, মস্তিষ্কের কোন কোন অংশ সক্রিয় হয়ে উঠছে। যেমন খুব জটিল কাজের সময় ফ্রন্টাল লোব-এর প্রয়োজন পড়ে। ইয়ানা বলেন, ‘মস্তিষ্কের এই অংশ ঠিক কপালের পেছনে রয়েছে। কোন কাজের জন্য কতটা ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে, এই অংশই তা স্থির করে দেয়। যে সব পরিস্থিতিতে আমাদের একই সময়ে একাধিক কাজ করতে হয়, তখন নির্বিঘ্নে কাজগুলো সম্পন্ন করতে মস্তিষ্কের এই অংশকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়।’ শিশু ও কিশোররা এমন কাজ কিভাবে সামলায়? তারা এমন এক জগতে জন্মগ্রহণ করেছে, যেখানে প্রতিদিন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানা কাজ করতে হয়। তাছাড়া নতুন প্রযুক্তি তাদের কাছে জলভাত। তারা কি প্রাপ্তবয়স্ক স্বেচ্ছাসেবীদের তুলনায় আরও দ্রুত সমস্যার সমাধান করতে পারে? ইয়ানা ফান্ডাকোভা মনে করেন, ‘আমাদের ও অন্যান্য বিভিন্ন গবেষণার ফল বলছে, যে এমন পরিস্থিতিতে শিশুদের সাড়া দিতে একটু বেশি সময় লাগে। তারা বড়দের তুলনায় সত্যি ঘনঘন ভুল করে।’ দ্রুত ও পর পর কাজ বদল করলে ফ্রন্টাল লোব বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে বাম দিক ও শিশুদের ক্ষেত্রে ডান দিক সেই কাজ করে। ২০ বছর বয়স পর্যন্ত ফ্রন্টাল লোব-এর বিকাশ চালু থাকায় শিশুরা বড়দের মতো এত দ্রুত বিভিন্ন ধরনের কাজ সামলাতে পারে না। বেড়ে চলা চাপ মস্তিষ্কের বিকাশের ওপর ঠিক কতটা প্রভাব ফেলছে, তা জানতে কমপক্ষে ১০ বছর সময় লাগবে। স্মার্টফোন ও ট্যাবলেটের সঙ্গে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম প্রাপ্তবয়স্ক হলে সেই রহস্যের সমাধান হতে পারে। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে শর্ট টার্ম ও লং টার্ম মেমারির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানা গেছে। ব্রাউনশোয়াইগ শহরের নিউরো বায়োলজিস্ট অধ্যাপক মার্টিন কর্টে মস্তিষ্ক গবেষক। নতুন কিছু শিখলে তা ‘লং টার্ম মেমরি’ বা স্মৃতিভা-ারে রাখা এত কঠিন হয় কেন, নিজের টিমের সঙ্গে তা জানার চেষ্টা করছেন তিনি। মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলি প্রোটিন অণু পেতে প্রতিযোগিতার দৌড়ে নামে। দীর্ঘমেয়াদী শিক্ষার জন্য এই প্রোটিন জরুরী। অধ্যাপক কর্টে বলেন, ‘এর কারণ এক আণবিক প্রাচীর, যা স্থির করে দেয় ঠিক কতটা তথ্য শর্ট টার্ম মেমরি থেকে লং টার্ম মেমরি-তে পাঠানো সম্ভব।’ এই পরীক্ষার জন্য গবেষকরা ইঁদুরের মস্তিষ্ক কেটে ভাগ করেছেন। তাঁদের মূল আগ্রহ ‘হিপোক্যাম্পাস’-কে ঘিরে, মস্তিষ্কের যে অংশ তথ্য গ্রহণ করার জন্য অত্যন্ত জরুরী। এই পরীক্ষার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখতে হয়। পরীক্ষার জন্য যে ইঁদুর মারা হয়েছে, তার মস্তিষ্কের কোষ জীবন্ত রাখতে হবে। মস্তিষ্কের পরিবেশের নকল করে, এমন এক বিশেষ তরল দ্রব্য সেই কাজ করে। মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষ মস্তিষ্কের অন্যান্য কোষের সঙ্গে যুক্ত। তাদের মধ্যে ১০,০০০ পর্যন্ত যোগাযোগ সম্ভব। মস্তিষ্কের কোষগুলোর মধ্যে এই সংযোগকে ‘সিন্যাপ্স’ বলা হয়। মস্তিষ্কের এই অংশেই শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়া চলে। অধ্যাপক কর্টে বলেন, ‘এখানে আমরা মস্তিষ্কের কোষগুলোর মধ্যে সংযোগের অংশ দেখতে পাচ্ছি, যাকে সিন্যাপ্স বলা হয়। এখানে তথ্য জমা রাখা হয় সিন্যাপ্স-কে আরও শক্তিশালী করে তুলে। এটা করা যায় আপস্ট্রিম ও ডাউনস্ট্রিম কোষ একই সঙ্গে সক্রিয় হলে।’ দুটিরই সিন্যাপ্স সক্রিয় করলে কোষে ন্যাট্রিয়াম প্রবেশ করে। ক্যালসিয়ামও ঢোকে, যার ফলে সিন্যাপ্সের মধ্যে প্রোটিনের নতুন অণু তৈরি হয়। স্মৃতির চিহ্ন অবশ্য তখনই অক্ষত থাকে, যদি হুবহু একই সিন্যাপ্সের মধ্যে তাকে আরও স্টিমুলেট করা হয়। তখন সেই স্মৃতি লং টার্ম মেমরিতে চলে যায়। ইঁদুরের মস্তিষ্ক কেটে বিজ্ঞানীরা ঠিক সেটাই দেখাতে পেরেছেন। ইলেকট্রোডের মাধ্যমে তাতে ইলেকট্রিক স্টিমুলেশন সৃষ্টি করা হয়েছিল। একই সিন্যাপ্স বার বার স্টিমুলেট করায় স্মৃতির চিহ্ন আরও স্থিতিশীল হয়ে ওঠে। কিন্তু মস্তিষ্কের কোন কোষের আলাদা আলাদা সিন্যাপ্স স্টিমুলেট করা হলে আগের স্মৃতির চিহ্ন মুছে যেতে পারে। অধ্যাপক কর্টে বলেন, ‘এখানে আমরা এমন সিন্যাপ্স দেখতে পাচ্ছি, যা শিক্ষার স্টিমুলেশনের মাধ্যমে শক্তিশালী করা হয়েছে। শিক্ষার স্টিমুলেশনের মাধ্যমে নতুন প্রোটিন মলিকিউল তৈরি হয়েছে। কিন্তু খুব কম সময়ের মধ্যে যদি নতুন করে কিছু শেখা হয় বা মনোযোগ অন্য দিকে চলে যায়, তখন কিন্তু আগের স্মৃতি মুছে যেতে পারে। তখন প্রোটিন মলিকিউল আর এই সিন্যাপ্সে থাকবে না, নতুন চিহ্নের দিকে চলে যাবে। সেটি আগেরটির তুলনায় অনেক দুর্বল হলেও প্রোটিন মলিকিউল চুরি করে শক্তিশালী হয়ে উঠবে। প্রথম শিক্ষা তখন সরে যাবে, দ্বিতীয়টি মনে দাগ কাটবে।’ এই প্রক্রিয়া শিক্ষার ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে। অর্থাৎ শিক্ষার যে সব স্টিমুলেশন একই সিন্যাপ্সে এসে পরস্পরকে শক্তিশালী করে তোলে, সেগুলোই লং টার্ম মেমারিতে স্থান পেতে পারে। তাই ভাল করে শেখার একটা কায়দা রয়েছে। অধ্যাপক কর্টে বলেন, ‘আমাদের পরীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, মাল্টিটাস্কিং এড়িয়ে চলাই ভাল। কারণ সে ক্ষেত্রে কোন পরিকল্পনা ছাড়াই এমন সব সিন্যাপ্স শক্তিশালী করে তোলা হয়, যা হয়ত আমরা চাই না। দ্বিতীয়ত শিক্ষার সময় কম রাখা উচিত, যাতে শেষের অংশ শুরুর অংশ মুছে না দেয়।’ কোষের স্তরে এই পরীক্ষাগুলো মনস্তত্ত্ববিদদের বক্তব্যকেই সমর্থন করে। তারা বহুকাল আগেই বুঝতে পেরেছিলেন মাল্টিটাস্কিং ক্ষতিকর হতে পারে এবং ছোট ছোট লার্নিং ইউনিট মনে রাখা অনেক সহজ। সূত্র : ডয়েচ ভেলে, বিবিসি
×