ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

নুসরাত হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা

প্রকাশিত: ১২:৪৪, ২৬ এপ্রিল ২০১৯

নুসরাত হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা

নুসরাত হত্যা সারাদেশের বিবেক কাঁপানো এক নৃশংসতম মরণকামড়। মধ্যযুগীয় বর্বরতায়, মানবিকতার চরম বিপর্যস্ততায় যে বীভৎসভাবে রাফিকে ঝলছে দেয়া হয় তা ঘটানোর মতো কোন পশুবৃত্তি সভ্য মানুষকে তাড়িত করে চিন্তারও অতীত। ঘটনার যথার্থ অংশীদার যারা তারা এমন সভ্যতা বিবর্জিত মরণনেশায় মেতেই ওঠেনি বরং ধরা পড়ে তেমন সহিংসতার বর্ণনাও দিচ্ছে নিজেদের জবানবন্দিতে। সভ্যতার ক্রমবর্ধমান অগ্রযাত্রায় আমরা কতখানি আধুনিক কিংবা সময়ের পথিক হয়েছি জানি না। তবে বিবেকহীনতার জিঘাংসায় আমাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন বন্যযুগে ফিরে যেতেও বুক কাঁপেনি এমন হৃদয় কাঁপানো ক্ষতবিক্ষত অভিযান সত্যিই এক বিধ্বংসকারী অমানবিক দুর্যোগ। এমনটা হতো না যদি রাফি মাদ্রাসার অধ্যক্ষের কুরুচির ওপর নিজের প্রতিবাদ আর প্রতিরোধক দুঃসাহসিক মনোবলে জিইয়ে না রাখত। মাওলানা সিরাজের বহু অপকর্ম অতীতে অনেক উদীয়মান কিশোরী মাদ্রাসাছাত্রীদের জীবনকে শঙ্কায়, আতঙ্কে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার কাহিনীও রাফি হত্যার ঘটনা পরম্পরায় স্পষ্ট হয়। বহু অঘটনকে ধামাচাপা দিয়ে এই নরপশু অধ্যক্ষ নিরীহ, অসহায় ছাত্রীদের যেভাবে উত্ত্যক্ত করত তাও আজ দিবালোকের মতোই স্পষ্ট। লজ্জায়, অপমানে, শঙ্কায় তারা কখনও মুখ খুলতে পারেনি। কিন্তু ব্যতিক্রমী রাফি মান-সম্মান বাঁচার উপায় খুঁজেছিল প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে। যা কঠোর প্রতিপক্ষের ভিত নাড়িয়ে দেয়। ফলে শুরু হয়ে যায় সত্যিটা চাপা দেয়ার অন্য রকম অপকৌশল। ঘটনার তদন্তে সব বেরিয়ে আসে অর্থ লেন-দেন থেকে শুরু করে প্রভাবশালীদের ক্ষমতার অপপ্রয়োগ শেষ অবধি আত্মহত্যায় রূপ দেয়ার মতো অপকর্মকেও যুক্ত করতে অন্যায়কারীদের বিবেক আর মানবিক বোধ জেগে ওঠেনি। রাফি যদি ঘটনাস্থলেই জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যেত তাহলে ঘটনা কোন্ দিকে মোড় নিত? তা হলে কি এমন জঘন্য হত্যাকা-ের অপরাধীরা সারা জীবন নিশ্চিন্তে, নিরুদ্বেগে জীবন কাটাতে পারত? হয়ত বা না পৃথিবীর বহু রহস্যময় হত্যাযজ্ঞের পেছনে দোর্দ- প্রতাশালীরা শেষ অবধি নিজেদের আড়াল করতে ব্যর্থ হয়। কারণ অপরাধ সংঘটিত হয় পশুত্বের অদম্য জোরে। যেখানে মানবিকতার লেশমাত্র চিহ্নও অবশেষ থাকে না। থাকলে এমন নৃশংসতাও ঘটতে পারে না। রহস্যের কিনার করতে বিজ্ঞ বিশ্লেষকরা হত্যাকারীর কোন না কোন নিদর্শন খুঁজে পায় যা নিজের অজান্তেই তাকে সবার সামনে হাজির করে দেয়। তবে রাফির বেলায় তা ঘটেনি। এখানে প্রাণঘাতী সতীর্থরা হয়ত বা ভুল বশতই তার মুখমণ্ডলে কেরোসিন দেয়নি। ফলে শরীরের বাকি অংশে আগুন দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাফি জ্বলে-পুড়ে ঝলসে গেলেও তার কথা বলার শক্তি সে কিন্তু হারায়নি। ফলে দুই মেয়ের গলার স্বর শুনতে পায়- শুধু তাই নয় তাকে মামলা তুলে নেয়ার হুমকি দেয়ার কথাও ক্ষতবিক্ষত দগ্ধ দেহে বলতে দ্বিধা করেনি। ৫ দিন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে লড়াই করতে করতেও করুণ কণ্ঠে আর্তনাদ করে যায় যাতে এমন দুর্বৃত্তায়নের যথার্থ বিচার আইনী প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রীকেও এমন বাণী পৌঁছে দিতে মৃত্যু পথযাত্রী রাফির ভুল হয়নি। কতখানি দুঃসাহস তার মানসিক জোর থাকলে মফস্বলের এক তেজি তরুণী এমন বাক্য বার্তায় সারা বাংলাকে স্তম্ভিত করে দিতে পারে। এমন স্বাধীনচেতা অদম্য, সাহসী মেয়েরাই পারবে তাদের জন্য একটি নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন আবাসভূমি গড়ে তুলতে। হয়ত বা রাফিকে আগুনে ঝলসে মূল্যবান জীবনটা হারাতে হয়েছে তবু সেখান থেকেই আরও অনেক নিপীড়িত তরুণী দুর্দমনীয় প্রতিরোধে শুধু নিজের জীবনই রক্ষা করবে না পুরো সমাজের অপসংস্কার, অপকর্ম আর কৌশলকেও উপড়ে ফেলতে রাফির মতোই সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে জীবনবাজি রেখে এগিয়ে আসবে। কোন না কোন এক সময় অত্যাচারী আর নিপীড়কের পশুবৃত্তি ধুলায় লুণ্ঠিত হয়েও যেতে পারে। এমন প্রত্যাশায় আগামী দিনগুলো মঙ্গলময় হয়ে ওঠুক।
×