ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শাহ বুলবুল

উপমায় নারী ॥ এক চুমুক বেদনা অথবা সুখ

প্রকাশিত: ১২:৫২, ২৬ এপ্রিল ২০১৯

উপমায় নারী ॥ এক চুমুক বেদনা অথবা সুখ

আলতো মহুয়ার বিভাপদ্মে নারী চিরদিনই প্রাসাদ গেঁথেছেন সাহিত্যের স্বপ্নালোকে। পেঁয়াজখোসা শাড়ির আঁচল পেতে ঈশারায় বুনেছেন উপমার স্বদেশ। কাল থেকে কাল পেরুনো সাহিত্যের প্রতি পরতে নারী উপমার মায়াবী বাসর আজও ষড়ঋতুর মতো সবুজ শ্যামল। বাংলা সাহিত্যের পথ প্রান্তে নারী উপমার এই আগমন কিন্তু ভিন্নতার এবং আলাদা ঢংয়ে। কবে একদিন প্রথমবার দেবীরূপে নারী এসেছিল উপমার দুয়ার খুলে। তারপর.. জননী, ভগ্নী, জায়া, প্রেমিকা, দুহিতা, প্রেয়সী ইত্যাদি আকারে প্রকারে সাহিত্যের উঠোনে নারী আনাগোনা। নারীর আলতো চাহনী খরতাপে পোড়া সাহিত্যের ধুলিধরা মাঠকে সিক্ত করেছেন আবার দীঘিধরা চোখের ঈশারায় সেই স্বপ্নের মাঠকে করেছেন বেদনায় তপ্ত। অর্থাৎ কমলার বেদীর মতো প্রিয় নারীর টুকটুকে ঠোঁট উপমার কল্পিত জলোধার সাঁতরে প্রাণদান ও বিষপান করছেন অহরহ। সাহিত্যে নারী ও নারীর উপমা পথ আর পথিকের মতোই তন্দ্রামুগ্ধ যুগের আবহে বসতি গড়া দুঃখ বেদনার অলিগলি আর সুখের কাব্যিক গ্রাম। উপমায় নারীর এক চিবুক প্রেম প্রাণঘাতী অস্ত্রের পচন ঠেকিয়ে সৃজন করে তকতকে এক সরব জীবন আবার ঘুনার বিষুব কষ্টে কিছু একটা ভালবাসতে চায় অযুত ক্লান্তির ঠিকাবিহীন আতাকামায়। সাহিত্যের এক জমিনেই চাষ হয় জীবনের সবক’টি ফসল তাই হতাশায় রূদ্ধ আর কষ্টের পোকায় বিবর্ণ আর্তনাদ কখনই কাম্য নয়। এখানে নারীর ছন্দময় উপমা জীবন নদীতে ঢেউতুলে জোয়ার আনে আবার ভাটায় বিশ্রাম দিয়ে ক্লান্তি শোষণ করে। কবি লেখদের জীবনে নারীর অনুভব তার ভাষার প্রকাশকে প্রভাবিত করে উপমার আদলে আবর্তিত হয়। যেমনÑহলুদ পাথরে লেখা কষ্টের আঁতুড় করে অপেক্ষমাণ নজরুলের নার্গিস অথবা শরৎ বাবুর নিঝুম বিরহে জর্জরিত একজন অন্নদা দিদি আজও কালের সীমানা ভুলে পাঠক মনে উপমিতভাবে আবিষ্ট আছেন। উপমার রসায়নে কল্পিত নারীর প্রিয় চিবুক শ্রাবণধারার মতো অতীত দিনের কপালে চুমু রেখে যায়; যিনি হতে পারেন একজন মা, মানসী, প্রেয়সী অথবা একজন কষ্টবতী। মূলত আমরা যদি সাহিত্যকে কল্পনার মেঘবাহন মনে করি তাতে যেন নারীÑই একমাত্র অভিযাত্রী যাঁর একটুকরো হাসির রংধনু আবিষ্কার করতে ব্যস্ত মহকালের সঞ্চিত সব উপমা। পোড়াবুকে পুষে রাখা আদরের নারীকে কতটা উপমায় প্রকাশ করা যায় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত উনিশ শতকের বাঙালী সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, গীতগোবিন্দ কাব্যের রচয়িতা কবি জয়দেব, মেঘদূত রচয়িতা কবি কালিদাস, পদ্মাপবতীর মহাকবি আলাওল, সাধক কবি রাধারমণ দত্ত, ফরাসী কবি শার্ল বোদলেয়ার, বনলতা সেন খ্যাত কবি জীবনানন্দ দাশ। উপমার নিপুণ কারিগর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রতিটি উপন্যাসে নারীর রূপ গুণ বর্ণনায় ব্যবহার করেছেন কল্পনার একান্ত ভাষা। মৃণালিনী উপন্যাসের মৃণালিনী, গিরিজয়া, মনোরমা। রাজসিংহ উপন্যাসে রূপনগরের রাজকন্যা চঞ্চলকুমারী, ঈন্দ্রিরা উপন্যাসে সুভাষিণী, রজনী উপন্যাসে লবঙ্গলতা এবং কৃষ্ণকান্তের উইলে রোহিণীর বালুচরী মায়ার বিবরণে উপমায় ডুবেছিলেন বঙ্কিম। রাজপপুত্র হেমচন্দ্র এবং মৃণালিনীর প্রেমকাহিনী নিয়ে ১৮৬৯ সালে রচিত মৃণালিনী উপন্যাসে ভিখারিণীরূপী গায়িকা গিরিজয়ার কথা বলা হয়েছে এভাবেÑ‘মুখখানি প্রফুল্ল, চক্ষু দুটি বড় চঞ্চল, হাস্যময়। লোচনতারা নিবিড়কৃষ্ণ, একটি তারার পাশের্^ একটি তিল। ওষ্ঠাধর ক্ষুদ্র রক্তপ্রভ, তদন্তরে অতি পরিষ্কার অমলশে^ত, কুন্দকলিকাসন্নিভ দুই শ্রেণি দন্ত। কেশগুলো সূক্ষ্ম, গ্রীবার উপরে মোহিনী কবরী, তাহাতে যূথিকার মালা বেষ্টিত। যৌবনসঞ্চারে শরীরের গঠন সুন্দর হইয়াছিল, যেন কৃষ্ণপ্রস্তরে কোন শিল্পকার পুত্তল খোদিত করিয়াছিল।’ কাব্য সাহিত্যে উপমা প্রয়োগের ক্ষেত্রে নারী তিলোত্তমা প্রকৃতির মতো বহমান। কবি শব্দের শিল্পী হয়ে নারীর আঙ্গুল, নাভী, মুখ, চিবুক, উরু, ঠোঁট, বাহু, চোখ ইত্যাদি শিল্পিত উপস্থাপনায় মনোগ্রাহী করেছেন। অনুপম ভাষা আর মার্জিত ছন্দে নিটোল অলংকারের মতো এসব উপমার গন্তব্য কেবলই যে মনবিলাসী তা কিন্তু নয় বরং বিজ্ঞান ও দর্শন বিচারে এর হৃদয়শ^রী স্বপ্নঘোর বিদ্যমান। সেই কবে মালিক মুহম্মদ জায়সীর পদুমাবৎ অবলম্বনে কবি আলাওল রচনা করেছিলেন অনুবাদ কাব্য পদ্মাবতী। সিংহলের রাজকন্যা রূপসী পদ্মবতীর কাজল রাঙা চোখের বর্ণনায় ডাগর চোখা খঞ্জন পাখির তুলনা এনেছেন। উপমার এমন মানবিক ও মৌলিক প্রয়োগ দীর্ঘসময় অতিক্রম করলেও এতটুকু জীর্ণতা আসে না বরং মর্মস্পর্শী উপাখ্যানের মতো ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে কাল থেকে কালের অন্তরে। সাহিত্য উপমায় নারীর কথা বলতে গেলে প্রাচীন ভারতের মহাকবি কালিদাসের কথা বলতেই হয়। অলকাপুরী থেকে রামগিরি পর্বতের বিজন আশ্রমে নির্বাসিত যক্ষ্মের প্রিয়াবিরহের কাতরতা নিয়ে কালিদাস রচনা করেছেন বিরহ কাব্য মেঘদূত। প্রিয়া অলকার প্রতি যক্ষ্মের বেদনা মথিত অনুভব উপমার বাসরে মিলেমিশে একাকার হয়েছে। বিরহে কাতর বর্ষাকাব্য মেঘদূতের উত্তরমেঘ অংশে কালিদাস যক্ষ্মপ্রিয়ার রূপলাবণ্যের সাম্যক ধারণা দিতে গিয়ে বলেছেনÑ পদ্মিনী, তম্বী, শ্যামা, গভীর নাভী, নিতম্ব ভারে মন্দগতি, স্তন্য ভারে অবনতা আর হরিণীর মতো চোখা এই নারীর দ্বিতীয় কোন প্রতিরূপ ঈশ^র গড়েননি। কালিদাস নারীকে উপমার প্রগাঢ় অনুভূতিতে এনে তার বিরহকে মনের এমন জায়গায় গেঁথে রেখেছেন যার বেদনাশ্রিত ক্ষরণ হাজার বছর পরেও হৃদয়গ্রন্থিকে সিক্ত করে। সাহিত্যে নারী ও নারীর উপমা আবেগতাড়িত মানÑঅভিমানের নাব্যয় চিত্রিত হয় ফলে কষ্টের প্রিয়মুখ ফিরে আসে বর্ষার মেঘে আবার বেদনা জমা রেখে ফিরে যায় শ্রাবণের বৃষ্টি হয়ে। কল্পনা বিলাসী কবিমন আবেগের রং দিয়ে প্রিয় নারীর একেকটি অঙ্গ মনের গহীনে পুষে রাখেন আপন উপমায়। ফরাসী কবি শার্ল বোদলেয়ারকে বোহেমিয়ান জীবন থেকে ফিরিয়ে আনতে তার সৎপিতা এক পরিচিত ক্যাপেন্টনের মাধ্যমে প্যারিস থেকে ভারতে পাঠাবেন। বোদলেয়ার ভারতগামী জাহাজে চড়ে জলের ঢেউয়ে দেখলেন প্রিয় সাবাতিয়ের নিটোল চোখ আর মিষ্টিগ্রীবার সুরেলা হাসি। উপমায় ভর করে কবি লিখলেন বিখ্যাত ‘সুন্দর জাহাজ’ কবিতা। যেখানে কবি নারীর আদুরে জঙ্গাকে দেখেছেন সুরাপায়ীদের কণ্ঠের মতো জীয়ন্ত আর স্তন্যকে দেখেছেন ছুটে চলা জাহাজের পালে। শার্ল বোদলেয়ারের ভাষায়Ñ শিথিল মন্থও ছন্দে হেলেÑদুলে ছড়িয়ে দিলি পাল/মহান জঙ্গার আঘাতে বসনের আলোড়ন/জাগায় যাতনার আধার বাসনার আবেদন/যেন রে ডাকিনীরা দুজনে ..। বাংলাভাষার শুদ্ধতম কবি জীবনান্দদাশকে বলা হয় উপমার যাদুকর। জীবনের টানাপোড়েন আর প্রকৃতির মতোই তার কবিতার উপমায় নারী এসেছে রহস্যময়তার গভীরতা নিংড়ে। বেদনাবিদ্ধ সময়ের নির্জন সন্ধ্যায় একপ্রস্থ সুখের ঘ্রাণ পেতে কবি নারীকে অনুভব করেছেন নিঃসঙ্গ বুকে নিশিথের বাতাসের মতো। কবির চিন্তায় স্মৃতির নারী হয়েছেন জামির বনের একলা পাখি। প্রিয়তমার মুখকে দেখেছেন কোশল রাজ্যের সমৃদ্ধনগরী শ্রাবস্তীর রূপে আর মায়ামাখা চোখকে ভেবেছেন পাখির নীড়। কবি জীবনানন্দ দাশ শঙ্খমালা কবিতায় লিখেছেন- ‘কড়ির মতন শাদা মুখ তার, দুইখানা হাত তার হিম; চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম চিতা জ¦লে: দখিন শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায় সেÑআগুনে হায়।’ উপমায় নারী গহীন সবুজের মতো; যার অন্যপাশে সীমাহীন ফসলি মাঠ ছাড়িয়ে বাস করে এক চিলতে প্রেম। সৌন্দর্য বিভায় নিসর্গিত লেখকগণ পানকৌড়ি পাখির মতো সেই প্রেমের জলে একটু একটু করে তৃষ্ণা মেঠান এবং আদুরে উপমায় শোভিত হয় প্রিয়তম নারী।
×