ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হত্যার তালিকা শুধু বাংলাদেশে হয় কেন?

প্রকাশিত: ০৯:০০, ১৪ মে ২০১৯

হত্যার তালিকা শুধু বাংলাদেশে হয় কেন?

নিশ্চয়ই আমরা ভুলিনি ’৭১-এ পাকিস্তানী ফরমান আলী ও বাঙালী যুদ্ধাপরাধীদের নেতা, জামায়াতে ইসলামীর তদানীন্তন আমির গোলাম আযমের দ্বারা পাকিস্তানে এবং বাংলাদেশে প্রথম প্রগতিশীল, স্ব স্ব ক্ষেত্রে খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, চিকিৎসক, লেখক-কবিদের হত্যার জন্য তালিকা প্রণয়ন করা হয়। এই তালিকা অনুসরণ করে ’৭১-এ বিশ্বের বর্বরতম হত্যাকান্ড সংঘটন করে ঐ পাকিস্তানী ও বাঙালী যুদ্ধাপরাধীরা। এর আগে বিশ্ব ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর পরিকল্পিত নিধনযজ্ঞ দেখেছে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে হিটলারের নাজিদের হাতে লাখ লাখ জার্মান ইহুদী নিধনের মধ্যে। সাম্প্রতিককালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের যে গণহত্যা, মাতৃভূমি থেকে বিতাড়নের লক্ষ্যে নির্যাতন, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগ করেছে তার ফল হয়েছে এগারো লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে প্রাণ বাঁচাতে চলে আসা। মিয়ানমার সরকার, সেনাবাহিনী দু’বছর পরও দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা, প্রস্তাব, ফর্মূলা আলোচনা ছাড়া রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন, নাগরিক অধিকার লাভ করে পুনর্বাসিত হওয়ার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এই একবিংশ শতকে সকল সভ্য জাতির চোখের সামনে জবরদস্তিমূলক বাস্তুচ্যুতি ঘটাচ্ছে একটি সরকার। যাহোক, আমরা লক্ষ্য করছি, রোহিঙ্গা সমস্যা থেকে জঙ্গী উত্থান হওয়ার সম্ভাবনা যেমন পুরোমাত্রায় রয়েছে, তেমনি ইরাক-সিরিয়ায় আইএস জঙ্গীদের অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়া এবং সিরিয়ায় এখনও তাদের কিছু শক্তি থেকে যাওয়া ইরাক-সিরিয়াসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার আফগানিস্তান, পাকিস্তানসহ কিছু কিছু পয়েন্টে জঙ্গীবাদের উর্বর ভূমি বজায় থাকায় আইএস, তালেবান, আলকায়দা, আল-শাস্্স ইত্যাদি ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশে সাত-আট বছর আগে একটি মৌলবাদী উগ্র ধর্মীয় দলের দ্বারা মুরতাদ ঘোষিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকার কথা প্রকাশ পেয়েছিল, যার মধ্যে সম্প্রতি হত্যার হুমকি দেয়া অন্তত দুই ব্যক্তির নাম ছিল। অর্থাৎ বাংলাদেশে তথাকথিত জঙ্গী হিসেবে প্রগতিশীল ব্যক্তিদের হত্যার লক্ষ্যে আনসারুল্লা বাংলা টিম, এখন আনসার আল ইসলামও তাদের ভাষায় জেহাদী কর্মকান্ড শুরু করেছে এদেশকে ধর্মরাষ্ট্রে রূপান্তর করার উদ্দেশ্যে। বাংলাদেশে এই মুরতাদ, নাস্তিক ঘোষণা করে তালিকা তৈরির কাজ যা আইনত অপরাধ, সেটির সূচনা করেছিল ’৭১-এ জামায়াত-শিবির মতাদর্শীরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পুনর্জাগরণকারী, গণজাগরণ মঞ্চের আয়োজকদের তালিকা করে হত্যা করার মাধ্যমে। এ সময় জাতি স্বাধীনতার জয় বাংলা স্লোগানকে ’৭১-এর মতো অস্ত্র করে ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে আরও একটি লড়াই শুরু করেছিল। এখানে ভুল করার কোন সুযোগ নেই যে, এরা সেই ’৭১-এর পুরনো শকুন, যারা আমাদের পতাকাকে বারবার খামচে ধরেছে- ’৭১-এ, ’৭৫-এ, ২০০১-২০০৬-এ, আবার ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত। বর্তমানে আবারও মাথা তোলার চেষ্টা দেখতে পাচ্ছে জাতি, যাদের সদা প্রস্তুত পুলিশ, র‌্যাব চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দমন করছে। বলা চলে এরাই তারা এবং তারাই এরা। অনেকে বলছেন, সুলতানা কামালকে কেন হুমকি দেয়া হলো? একটি বিষয় সম্ভবত রয়েছে এর নেপথ্যে। হেফাজতে ইসলামের মুরতাদের তালিকায় তাঁর নাম ছিল কিনা জানি না, তবে হেফাজতের আমিরের নারীকে ভোগ্যপণ্য গণ্য করার পরও সরকার পতন আন্দোলনে ঢাকার একটি অংশ ধ্বংস করার পরও, গার্মেন্টের মহিলা শ্রমিকদের প্রতি মধ্যযুগীয় চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে অশালীন অশ্লীল মন্তব্য করার পর যে বা যারা এ আচরণের স্পষ্ট নিন্দা জানিয়েছেন তাদের মধ্যে সুলতানা কামাল অন্যতম। মুনতাসীর মামুন ও শাহরিয়ার কবির সরকারের উল্টো কাজের বিশেষত সরকারের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিপরীত কার্যাবলীর সমালোচনা প্রায়ই করে থাকেন। তাছাড়া ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে, ট্রাইব্যুনাল গঠনে, অপরাধীদের অপরাধ প্রমাণে এরা দু’জন সাক্ষী ছিলেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- এসব কাজ কাদের কাছে অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে? অবশ্যই যারা ১) ’৭১-এ যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তাদের রাজনৈতিক দল ও পরিবারের কাছে এবং ২) জেএমবিসহ সব জঙ্গী দলের কাছে, যারা কাজী আরেফসহ সন্ত্রাসবিরোধী মুক্তিযোদ্ধা, উদীচীর মতো অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, ছায়ানটের বাংলা বর্ষবরণ, এমনকি, গ্রামীণ মেলা, যাত্রাপালা, বাউল গায়কদের ওপর বোমা হামলা করে বুঝিয়ে দিয়েছিল তারা উগ্র জেহাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠী, যারা বাঙালীর ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির শত্রু এবং ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা তাদের লক্ষ্য। এরাই পরে মিত্র হিসেবে বিএনপির খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে লাভ করার ফলে রাষ্ট্রের মালিকানা চিরতরে তাদের হাতে রাখার লক্ষ্যে রাজনীতিকে প্রতিযোগীহীন করার স্বার্থে হরকত-উল-জিহাদের জঙ্গীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সংঘটিত করে ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশের ওপর ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলা, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা ও আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করা। যে দলটি ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতাকে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি গণ্য করে। খালেদা, তারেকের রাষ্ট্রক্ষমতার চিরস্থায়ী দখলীস্বত্ব স্থাপন আর জঙ্গীদের ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা- একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ তা বলাই বাহুল্য। এরই সঙ্গে যুক্ত ধর্মীয় মুসলিম গোষ্ঠী আহমদিয়াদের ওপর হামলা, তাদের মতো ধর্মভীরু গোষ্ঠীকেও মুরতাদ, কাফের ঘোষণা করার এক অমানবিক ও সাম্প্রদায়িক অন্ধ ভেদবুদ্ধির প্রকাশ, যা একটি বড় মাপের সংবিধানবিরোধী অপরাধ। সরকার যেখানে সব ধর্মীয় গোষ্ঠীর ধর্মচর্চার স্বাধীনতা রক্ষা করতে দায়িত্ববদ্ধ, সেখানে কতগুলো ঘৃণা-প্রচারক মোল্লা-মৌলবী ও হেফাজতে ইসলামের ধর্মান্ধ নেতাদের প্রতিহত করার তেমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি! অথচ ওরা গুটিকয়েক সাঈদীমার্কা ঘৃণা-প্রচারক ইন্টারনেটে আহমদিয়া, প্রগতিশীল ব্যক্তিবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে নিয়মিত। আবার পঞ্চগড়ে আহমদিয়াদের বার্ষিক সম্মেলনটি সংঘটনের কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করে ঐ ঘৃণা-প্রচারকদের প্রতি নমনীয়তা প্রদর্শন করছে, যা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের জন্য চরম অবমাননাকর। এভাবে অন্যায়কারীরা প্রশ্রয় পেয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করে মানুষকে মানুষ গণ্য না করে চরম অপমান করে! আমাদের প্রস্তাব, এসব মুরতাদ, কাফের ঘোষণাকারীদের ’৭১-এর ভূমিকা যেমন নিরীক্ষা করতে হবে, তেমনি তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব অডিট করতে হবে। তেমনি তাদের সংবিধান অবমাননা করার জন্য বিচার ও কঠোর দন্ড প্রদান করতে হবে। এটি করা হলে অবশ্যই জঙ্গীবাদের উগ্র বিষধর সাপ তার ফণা নামাতে বাধ্য হবে। সরকার শীঘ্রই কাফের মুরতাদের তালিকা প্রণয়নকারী, হত্যা পরিচালনাকারীদের গ্রেফতার করে দেশের সংবিধান অনুসারে কঠোর দন্ড দেবে- এটাই জাতি প্রত্যাশা করে। লেখক : শিক্ষাবিদ
×