ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্বপ্নতরীতে নারীর অগ্রযাত্রার স্বপ্ন

প্রকাশিত: ১১:৫০, ১৪ মে ২০১৯

স্বপ্নতরীতে নারীর অগ্রযাত্রার স্বপ্ন

সংগঠকদের শুরুর দিকটা সবসময়ই কষ্টকর। শূন্য থেকে শুরু করে একটা সংগঠনকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করানো চাট্টিখানি কথা নয়। আর নারীদের জন্য একই কাজটা পুরুষদের তুলনায় একটু বেশিই কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং। সমাজে যে কোন কাজেই নারীদের পুরুষের তুলনায় একটু বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। আজকের গল্পটার শুরু এমনই এক ঘটনা থেকে। ২০১৫ সাল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দারিকান্দির মায়মুনা ফারিয়া সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। স্কুল থেকে ফেরার পথে কয়েকজন বখাটে উত্ত্যক্ত করে তাকে। সেদিন তার বড় ভাই চলে আসায় ঘটনা আর বেশি দূর আগায় না। কিন্তু সেদিন তার মনে একটা ভাবনা বার বার ঘুরছিল। কেউ যদি সাহায্য করার মতো না থাকে তাহলে এই পরিস্থিতিতে কী করার আছে? ভয় থেকেই সঞ্চার হলো সাহসের। তারপর স্বপ্নের। ফারিয়া সেদিন স্বপ্ন দেখলেন সমাজের এই সমস্যাগুলো দূর করার। আজকাল রাস্তাঘাট, কর্মস্থল, গণ-পরিবহন এবং পাবলিক প্লেসগুলোতে নারীদের যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার হার খুবই বেশি। এভাবেই এক পর্যায়ে নারীদের নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন ফারিয়া। ‘আমি নারী আমি স্বপ্ন আমি তরী আমিই সংগ্রামী আমিই শক্তি’ এই সেøাগান নিয়ে ২০১৬ সালের জুন মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে তার সংগঠন স্বপ্নতরী। উদ্দেশ্য নারীর আত্মোন্নয়ন ও সুরক্ষার মাধ্যমে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূর করে নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা। সহপাঠীদের সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা করলে কয়েকজন বেশ বিদ্র‍ুপ করে বসে তাকে। তবে সেখানে থেমে যায়নি ফারিয়া। প্রথমে ইন্টারনেট থেকে খুব ছোট ছোট প্রতিরক্ষার কৌশল শেখা এবং তারপর অন্যদের শেখানো। বিপদে পড়লে কারও সাহায্য ছাড়াই যেন একটা মেয়ে সেই বিপদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে এটাই ছিল লক্ষ্য। সেখানে কোন প্রশিক্ষক না থাকায় ইন্টারনেটই ছিল একমাত্র ভরসা। স্কুলের শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবে নিজেরা শিখে তারপর মার্শাল আর্টের খুব সহজ কিছু কৌশল শেখানো হতো অন্যদের। স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং স্কুল কমিটির প্রধান এই বিষয়ে সর্বাত্মক সহায়তা দেন। পরিবার থেকে কিছুটা বাধা থাকলেও তীব্র ইচ্ছা দেখে তারাও উৎসাহ দিতে শুরু করেন। ৩টি স্কুল এবং ২টি কলেজের ৯০০ এর বেশি শিক্ষার্থীকে এভাবে আত্মরক্ষার কৌশল সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেয়া হয়। সাদি, সেতু এবং আনিকা- ৩ জনেই বিভিন্ন সময়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন, ভেঙ্গে না পড়ে বা নিজেদের না গুটিয়ে আজ তারাই নারীর উপর সহিংসতা থামাতে কাজ করে যাচ্ছেন। ২০২৫ সালের ভেতর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সকল নারীদের আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করার পরিকল্পনা আছে তাদের। স্বপ্নতরীর উদ্যোগে বর্তমানে গ্রামে উঠান বৈঠকের আয়োজন করা হচ্ছে। সচেতন করা হচ্ছে নারী পুরুষ সবাইকেই। নারীর অধিকার আলোচিত হচ্ছে এসব বৈঠকে। বিভিন্ন স্কুল কলেজে সেমিনারের মাধ্যমে নারীর উপর সহিংসতা, বাল্য বিবাহের কুফল নিয়ে ধারণা দিচ্ছে এই সংগঠনের কর্মীরা। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধও করা হচ্ছে। ৮ম শ্রেণীতে পড়ার সময় তাদের এক সহপাঠীর বাল্যবিয়ে তারা প্রতিরোধ করতে পেরেছে। মায়মুনা ফারিয়া জানান সম্প্রতি তারা একটি মোবাইল এ্যাপ তৈরির কাজ শুরু করেছেন যেটা দিয়ে কেউ হয়রানির শিকার হলে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন এবং স্বেচ্ছাসেবকদের সাহায্য নিতে পারবে। দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতিত নারীদের আলোর মুখ দেখাতে স্বপ্নতরী ‘অভিশপ্ত জীবনের পরিসমাপ্ত’ নামে একটি বিশেষ প্রকল্প চালু করেছে। বর্তমানে ৫০ জন স্বেচ্ছাসেবক আছে সংগঠনের। দারিকান্দি গ্রাম থেকে শুরু হওয়া এই সংগঠনের কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়েছে পুরো উপজেলায়। এই কাজের সবচেয়ে বড় উৎসাহ কে জানতে চাইলে মায়মুনা ফারিয়া বলেন, ‘আমার বড় ভাই সবসময় আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন আর আনন্দের ব্যাপার হলো আমাদের ছেলে বন্ধুরাই সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে আমাদের।’ সমাজে নারী পুরুষ সমতা ফেরাতে এবং নারীর অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করায় স্বপ্নতরী ২০১৮ সালে জয় বাংলা ইয়ুথ এ্যাওয়ার্ড লাভ করে।
×